এত বছরের ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ গ্রহণের প্রথা বাতিল করে নতুন ডাক্তারবাবুদের ‘চরক শপথ’ পড়ানোর ভাবনা শুরু হয়েছে, এমন কথা প্রকাশ্যে আসতেই ব্যাপক শোরগোল। পক্ষে যাঁরা, তাঁরা বলছেন – এদেশে পশ্চিমা চিকিৎসাপদ্ধতি এসেছে তো সবে দুশো-আড়াইশো বছর, কিন্তু মহর্ষি চরক আমাদের চিরকালীন সম্পদ। ঠিকই। কিন্তু মহর্ষি চরক নির্দিষ্ট পথে চিকিৎসা না করেও তাঁর নামাঙ্কিত শপথ নিলে ব্যাপারটা কি সম্মানজনক? প্রতিযুক্তিতে বলা যায়, আজকালকার ডাক্তারবাবুরা কি হিপোক্রেটিস-এর পথ ধরে চিকিৎসা করে থাকেন? সেও ঠিক বটে। হিপোক্রেটিস-এর সময়ের চিকিৎসাতত্ত্ব তো কবেই তামাদি হয়ে গিয়েছে। অবশ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হিপোক্রেটিসের শপথটির আধুনিকীকরণ ঘটেছে (যদিও মূল জায়গাগুলো অপরিবর্তিতই থেকেছে)। অনেক মেডিকেল কলেজে তো পাস করার পর নতুন ডাক্তারবাবুরা ওয়ার্ল্ড মেডিকেল এসোসিয়েশন প্রণীত ডিক্লেয়ারেশন অফ জেনেভা অনুসারী শপথ নেন, যা ‘হিপোক্রেটিক ওথ’-এর আধুনিক সেকুলার সংস্করণ। অর্থাৎ, প্রাচীন সুরে বাঁধা হলেও এতদিন যে শপথবাক্য অনুসৃত হচ্ছিল, তা যথেষ্ট সমকালীন। প্রস্তাবিত চরক শপথ তেমন হবে তো?
তবে কথার পিঠে কথা দিয়ে বিতর্কের নিষ্পত্তি হওয়া মুশকিল। মজার ব্যাপার হলো, যে দুই মহারথীর নামাঙ্কিত শপথবাক্য নিয়ে এই তর্ক জমে উঠেছে, সেগুলি আদপেই তাঁদের লেখা কিনা, সে নিয়ে সংশয় প্রচুর। জটিল তর্কে না ঢুকলেও বুনিয়াদি প্রশ্নটা থাকেই, চিকিৎসকের আবার শপথ কেন? চিকিৎসাশাস্ত্রকে অনেকে বলেন বিজ্ঞান, অনেকে বিজ্ঞান আর শিল্পের মাঝামাঝি কিছু। অথচ বিজ্ঞানী বা শিল্পী, কাউকেই পেশায় ঢোকার মুহূর্তে শপথ নিতে হয় না। নিতে হয় মন্ত্রী-শান্ত্রীদের, আদালতের বিচারকদের, এমনকি বাদি-বিবাদি পক্ষের সাক্ষীদেরও – সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা পেশাকে এঁদের কারও সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা মুশকিল। তাহলে?
দেখুন, শপথ ব্যাপারটা প্রতিশ্রুতির চাইতে গভীর। মূল ‘হিপোক্রেটিক ওথ’-ই বলুন, বা ‘চরক শপথ’, শপথ নেওয়া হয় ঈশ্বরের নামে। ধর্মনিরপেক্ষ শপথ নেওয়া হয়, ‘যা কিছু পবিত্র ও শাশ্বত বলে বিশ্বাস করি’ তার নামে। আদতে শপথ চিকিৎসাশাস্ত্রের যে মূল স্পিরিট, তার নামে। লক্ষ্যণীয়, রাষ্ট্রের উপস্থিতি শপথগ্রহণের ক্ষেত্রে থাকে না (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে অবশ্য শপথগ্রহণ হতো রাষ্ট্রের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে), বয়ানেও তেমন রাষ্ট্রানুরাগী বক্তব্য নেই – এ শপথ দেশ-কাল-লোকাচারের উর্দ্ধে উঠে রক্ষণীয়। শপথগ্রহণ হয় জনসমক্ষে, অর্থাৎ বৃহত্তর সমাজের সামনে শপথে আবদ্ধ হওয়া। শপথ-অনুসারী আচরণের ব্যাপারে নব্যচিকিৎসক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন নিজের কাছেও, সেহেতু ‘আমার সর্বোচ্চ সাধ্যমতো’ জাতীয় শব্দবন্ধের ব্যবহার। এবং নৈতিকতার সঙ্গে জীবনচর্যার অনিবার্য যোগাযোগের কারণেই চিকিৎসকের শপথের মধ্যে সুনির্দিষ্ট আচরণসম্মত জীবনযাপনের উল্লেখ। শপথবাক্য একটিবার পড়ে দেখলেই (হিপোক্রেটিস বা চরক, উভয়ক্ষেত্রেই) স্পষ্ট, এ কোনও সাময়িক চুক্তি জাতীয় ব্যাপার নয়, পেশাজীবনের সমগ্র তো বটেই, এ শপথ চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করছেন যিনি, সেই ব্যক্তিমানুষটির আগামী জীবনকে সামগ্রিকভাবেই নির্দিষ্ট কিছু বিধিতে বাঁধতে চাইছে। এবং এই শপথ-অনুসারী যাপনের মাধ্যমেই পার্থিব সুখ – যশ অর্থ সম্মান ইত্যাদি – অর্জন করা সম্ভব, সে কথাও বলা হয়েছে। রয়েছে শপথভঙ্গে বিপরীত পরিণতির উল্লেখও, সে শাস্তিও আদালত-নির্ধারিত সাজার অধিক।
অথচ চিকিৎসকদের তো এমনিতেই বিভিন্ন রকম কোড অফ এথিক্স মেনে চলতে হয়। এই শপথের ভিন্ন তাৎপর্য তাহলে কোথায়? প্রথমত, ‘কোড অফ এথিক্স’ মেনে চলা উচিত অবশ্যই, কিন্তু “যা কিছু শাশ্বত, তার সামনে আমি শপথ নিচ্ছি” এই মর্মে শপথের তাৎপর্য অনেক গভীর। অনেক ‘কোড’ ভাঙা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, কিন্তু শপথ নেওয়া হয় দেশ-জাতি-কাল-এর সীমা ছাড়িয়ে মহোত্তম কিছুর নামে। সেই শপথ ভাঙার বিচ্যুতির তাৎপর্য আইনের বিচারের চাইতে গভীর। দ্বিতীয়ত, ‘কোড অফ এথিক্স’ সময়ের সঙ্গে বদলায়। কিন্তু চিকিৎসকের শপথের মূল কথাগুলো প্রায় অপরিবর্তিত (সামান্য কিছু বদল বাদ দিলে)। এবং এই শপথ গ্রহণের মাধ্যমেই নব্য-চিকিৎসক যুগ যুগ ধরে চলে আসা এক অবিচ্ছিন্ন ধারার অংশ হয়ে ওঠেন – মানবতার ইতিহাসে মহোত্তম কিছু দায়রক্ষার অছি হয়ে ওঠেন। মানুষের চূড়ান্ত অসহায়তা, একান্ত গোপনীয়তা, দুঃখযন্ত্রণা আশানিরাশা জীবন-মরণ যে পেশার সঙ্গে জড়িত, সেখানে পা রাখার মুহূর্তে শপথ গ্রহণ, সম্ভবত, অবান্তর নয়। অবান্তর হতে পারে না।
হিপোক্রেটিসের নামাঙ্কিত শপথই বলুন বা ‘চরক শপথ’, দুইয়ের ক্ষেত্রে মোদ্দা কথাগুলো একই। মিলের কারণও রয়েছে যথেষ্ট। ‘চরক শপথ’-এর কথাগুলো নতুন নয়। চরক সংহিতা-র অনেক আগে থেকেই যাপন-শৈলীর মোদ্দা কথাগুলো আমাদের শাস্ত্রগ্রন্থাদিতে পাওয়া যায়। যেমন ধরুন, তৈত্তিরীয় উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ের একাদশ অনুবাকে গুরু অন্তেবাসী শিষ্যকে যে পথ অনুসরণ করার উপদেশ দিচ্ছেন, তার সঙ্গে ‘চরক শপথ’-এর মূল বক্তব্যের আশ্চর্য মিল। অপরদিকে, ‘হিপোক্রেটিক ওথ’-এ পিথাগোরিয়ান দার্শনিকদের ধ্যানধারণার প্রতিফলন। যে পিথাগোরিয়ান দর্শনের উপর প্রাচ্য দর্শনের প্রভাব সুবিদিত। এমতাবস্থায় “হিপোক্রেটিক ওথ”-এর সঙ্গে “চরক শপথ”-এর মিলটি স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে একটির পরিবর্তে আরেকটি শিরোধার্য করলে গেল-গেল রব তোলার মানে হয় না। ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ প্রাচীন বয়ানে এখন আর নেওয়া হয় না। যেমন, কোনও মহিলাকে গর্ভপাতে সাহায্য না করার শপথ বর্তমানে অবান্তর। ঠিক তেমন করেই ‘চরক শপথ’-এর অবান্তর অংশগুলো ছেঁটে নিলে (যেমন, পুবদিকে অগ্নিসাক্ষী, দ্বিজত্ব, পরিবারের পুরুষের অনুপস্থিতিতে রোগিণীকে না দেখার অঙ্গীকার ইত্যাদি), সেটিকে এদেশের নব্য-চিকিৎসকদের শপথ-বয়ান হিসেবে মেনে না নেওয়ার কারণ নেই।
তবু কিছু কথা রয়েই যায়। কোন শপথ নেওয়া হচ্ছে, তার চাইতেও ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ শপথটি রক্ষিত হচ্ছে কিনা। ব্যক্তি-চিকিৎসক তাঁর নিজস্ব বিচ্যুতির কারণে শপথভঙ্গ করলে তা নিন্দনীয় অবশ্যই, কিন্তু চিকিৎসার সামগ্রিক প্রেক্ষিত যদি এমন দাঁড়ায়, যেখানে শপথ রক্ষা একেবারেই অসম্ভব, বা শপথ-নির্দিষ্ট পথটি কাঁঠালের আমসত্ত্ব তুল্য, তাহলে? সরকার যদি চিকিৎসা-ব্যবস্থাটিকে ব্যবসার বা মুনাফা-অর্জনের ক্ষেত্র হিসেবে স্বীকার করে নেন, তাহলে হিপোক্রেটিস বা চরক, যাঁর নামাঙ্কিত শপথই হোক না কেন, তার মূল স্পিরিট রক্ষা করে চিকিৎসা কি আদৌ সম্ভব? রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতির বাজারে চাচা-আপন-প্রাণ-বাঁচা চিকিৎসাপদ্ধতির মুহূর্তে রোগীর স্বার্থকে চূড়ান্ত ভাবার শপথ রক্ষার সম্ভাবনা কেমন? যেখানে ‘কোড অফ এথিক্স’-এর চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় ‘মেডিকেল ল’ এবং ক্রেতা সুরক্ষার মারপ্যাঁচ, সেখানে এই শপথগ্রহণে আনুষ্ঠানিকতার অধিক কিছু সত্য থাকে কি?
সবশেষে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি তোলা যাক। হঠাৎ এই বদলের ভাবনা কেন? একটি একটি করে গাছের গুণাগুণ বিচার করতে বসলে জঙ্গলটা প্রায়শই ভুলে যেতে হয়। ‘হিপোক্রেটিক ওথ’-এর জায়গায় ‘চরক শপথ’ – ইতরবিশেষ নেই। কিন্তু সরকারের সামগ্রিক কাজকম্মের প্রেক্ষিতে দেখলে? শিক্ষার প্রতিটি পর্যায়ে অতীত গৌরবের ধুয়ো তোলা ইদানীং রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান শাসকের কাছ থেকে এমন ক্রিয়াকলাপ অবশ্য অপ্রত্যাশিতও নয়। উমবার্তো একো তাঁর Ur-Fascism নিবন্ধে ফ্যাসিবাদের ধর্মগুলো চিহ্নিত করতে গিয়ে প্রথমেই যেটি উল্লেখ করেছেন, তা হল – কাল্ট অফ ট্র্যাডিশন। জাতীয় আত্মানুসন্ধান ও ঐতিহ্যের নামে এক বিকৃত ইতিহাস-চর্চাকে সমাজচিন্তার মূলস্রোত করে ফেলা। অতীত-গৌরবের নামে যে ঐতিহ্যের ধুয়ো তোলা হয়, তা সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী কিছু ঐতিহাসিক/আধা-ঐতিহাসিক সত্যের সমন্বয়ে নির্মিত। আবার, অতীত উৎকর্ষই যেহেতু শ্রেষ্ঠ, নতুন করে শেখা-জানার কিছু আর বাকি থাকে না – জ্ঞানান্বেষণ বা গবেষণা বলতে, অতীত শ্রেষ্ঠত্বকেই ঠিকভাবে জানা, অতীত গ্রন্থরাজি হতে আলটপকা উদ্ধৃতি তুলে আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে তাকে সমকালীন জ্ঞানের পূর্বাভাস হিসেবে দেখার ও দেখানোর চেষ্টা করা। একো-র কথাগুলো মাথায় রাখলে বুঝতে অসুবিধে হয় না, ঠিক কেন দেশে প্রযুক্তি শিক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানটি বৈদিক যুগের বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে ব্রতী হয়, বা ঠিক কেন দেশে চিকিৎসা শিক্ষার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানটি গুরুতর অসুস্থ রোগীর ক্ষেত্রে গায়ত্রী মন্ত্র জপের উপকারিতার মতো বিষয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করতে থাকেন।
অতএব, ‘হিপোক্রেটিক ওথ’-এর সঙ্গে ‘চরক শপথ’-এর সুবিধে-অসুবিধে যাথার্থ্য উপযোগিতা ইত্যকার তুলনামূলক আলোচনা করার মধ্যে দিয়ে দেশের স্বাস্থ্যশিক্ষার সর্বোচ্চ নিয়ামকের এই ভাবনার তাৎপর্য বোঝা যাবে না। ঠিক যেমন, যোগাভ্যাস-ধ্যান-এর গুণাগুণ বিষয়ক তর্ক-বিতর্ক দিয়ে কখনোই ধরা যাবে না, কেন ডাক্তারি ছাত্রদের হপ্তাদুয়েকের যোগশিক্ষা আবশ্যিক করা হল, বা কেন মেডিকেল কলেজে ‘যোগ দিবস’ পালন বাধ্যতামূলক করে ফেলা হল। চিনতে হলে, এই সব ছোট ছোট পদক্ষেপ ঠিক কোন লক্ষ্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে শুরু হয়েছে – এবং অনেকদূর অব্দি এগিয়েও আসা গিয়েছে – সেই লক্ষ্যটিকে চেনা জরুরি।
আর এই বিপদটিকে নির্ভুল চিনতে পারলেই কোনও তাত্ত্বিক কচকচির অবকাশ থাকে না। বোঝা যায়, এখুনি এই বিপজ্জনক যাত্রার বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়াতে পারলে, চিকিৎসকের শপথ – তা সে হিপোক্রেটিসের নামাঙ্কিতই হোক বা চরকের – সে শপথ রক্ষার পরিবেশ-পরিস্থিতি তো দূর, অদূর ভবিষ্যতে দেশে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসাবিদ্যার প্রায়োগিক চর্চার সুযোগ বা পরিসরটুকুও লুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা।
মূল রচনাটি ১৬ই ফেব্রুয়ারী ২০২২ এই সময় পত্রিকায় প্রকাশিত।
Dear Bishan — liked your critical essay on mad.mad, rush to prove their pseudo patriotism for the GENUINE — by a bunch of chest thumping ( Hail Caesar type) — well connected scientific medicine trained doctors — who want to show the world — MAKE in –INDIA MEDICINE( not ‘made in India’ of earlier decades) — is AGELESS & SUPREME.!
— Shade of DARKNESS is becoming DARKAR — just below the leaping flame of ARROGANCE — of DEEPAM –a symbol of KNOWLEDGE walking on all fours