প্রথম পর্ব—ল্যামার্কের জিরাফ ও ভাইজম্যানের ইঁদুর
জাঁ ব্যাপতিস্তে ল্যামার্ক। ফরাসী বিজ্ঞানী। তিনি ডারউইনের অনেক আগে বিবর্তনের একটি সুসংহত তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। তখন ১৮০৯ সাল, পাশ্চাত্যে রেনেসাঁ শেষ হয়ে প্রথম শিল্পবিপ্লবের সময়। ভারত তথা কলকাতায় পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারের একেবারে গোড়ার যুগ চলছে, হিন্দু কলেজ স্থাপিত হবে এর আট বছর পরে। আর কলকাতার মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হবে তারও ১৮ বছর পরে। সেই সময়ে জীববিজ্ঞানে অনেক কিছু অজানা ছিল, বিবর্তনের প্রমাণ তেমন যোগাড় হয়নি। জীববিজ্ঞানের সেই প্রাথমিক যুগে ল্যামার্ক বলেছিলেন, জীবের দেহে বিভিন্ন রসের প্রাকৃতিক প্রবণতা থেকে জটিল ও উন্নত জীব সৃষ্টি হয়। আর পরিবেশের সঙ্গে জীবের মানিয়ে নেবার জন্য দরকার প্রয়োজনীয় অভিযোজন।
ল্যামার্ক ভেবেছিলেন, কোনও অঙ্গ একই কাজে বেশি করে ব্যবহার করলে সেই অঙ্গের উন্নতি ও বিকাশ হয়। এর এক জনপ্রিয় উদাহরণ হল জিরাফের লম্বা গলা। জিরাফ মগডালের পাতা খেতে চায়। তাই সে গলা লম্বা করার চেষ্টা করেছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম চেষ্টার ফলে আস্তে আস্তে জিরাফের গলা লম্বা হয়েছে। এক প্রজন্মে গলা যেটুকু লম্বা হয়েছে, সেটুকু পরের প্রজন্ম উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছে। সেই প্রজন্ম চেষ্টা করে গলা আরেকটু লম্বা করেছে। এই তত্ত্বকে বলে ব্যবহার ও অব্যবহারের তত্ত্ব। যে অঙ্গ যে কাজে বেশি ব্যবহার করা হবে, সেই অঙ্গ সেই কাজের জন্য বংশানুক্রমে বেশি উপযুক্ত হয়ে উঠবে। (তথ্যসূত্র ১)
অভিযোজনের এই পদ্ধতিগত ধারণা কিন্তু ল্যামার্কের নিজস্ব নয়। এটা প্রকৃতপক্ষে তখনকার দিনের সর্বজনীন ধারণা ছিল। এমনকি এখনও সাধারণভাবে ভাবা হয়, বাবা পণ্ডিত হলে ছেলেও পণ্ডিত হবে। অর্থাৎ কেউ নিজের চেষ্টায় জ্ঞান বাড়ালে, সেই অর্জিত গুণটি পরের প্রজন্মে বজায় থাকবে। ধারণাটি ভুল। অর্জিত গুণ পরের প্রজন্মে যায় না। তবে তখন সময়টা ছিল একটু ভিন্ন। ল্যামার্ক ডারউইনের থেকে ৫৫ বছরের বড় ছিলেন। ল্যামার্কের দুর্ভাগ্য, এই প্রচলিত ভুল ধারণাটি তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে গেল।
ল্যামার্কবাদ বলতে এখন পূর্বসূরীর অর্জিত গুণ উত্তরসূরীতে বর্তানোর কথা বোঝানো হয়। এ নিয়ে ঊনবিংশ শতকের শেষ থেকে বিংশ শতকের প্রথমার্ধে বহু বিতর্ক হয়েছে। ডারউইনবাদের বিকাশের পরেও কেউ কেউ ভেবেছেন, অর্জিত গুণ পরের প্রজন্মে যেতে পারে। ডারউইনবাদীরা তাদের ‘ল্যামার্কবাদী’ আখ্যায় ভূষিত করেছেন। ‘ল্যামার্কবাদী’ কথাটা প্রায় একটা অপমানসূচক সম্বোধনে পরিণত হয়েছে। ল্যামার্কের মূল কৃতিত্ব কিন্তু বিবর্তনকে সমর্থন করা, তার সপক্ষে উদাহরণ দেওয়া ও বিবর্তনের কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজতে চেষ্টা করা। সেটা মানুষ প্রায় ভুলেই গেছে।
আমরা বলি, ডারউইন প্রথম বিবর্তনের বিজ্ঞানসম্মত কারণ ব্যাখ্যা করেন। দেখা যাক জিরাফের গলা লম্বা হওয়া নিয়ে তাঁর ব্যাখ্যা কী ছিল। ডারউইন বললেন, একই জিরাফ পিতামাতার সব সন্তানের গলা সমান লম্বা নয়। যাদের গলা বেঁটে তাদের খাদ্য কম জোটে বলে তারা কম দিন বাঁচে আর তাদের বংশধর কম হয়। যাদের গলা লম্বা তারা গাছের মগডাল থেকে পাতা খেয়ে বেশি দিন বাঁচে ও তাদের বংশধরের সংখ্যা বেশি হয়। এই বংশধরদের গলা গড়ে বেশি লম্বা হয়। এইভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জিরাফদের মধ্যে গলা লম্বা হবার বৈশিষ্ট্য বাড়ে। কিন্তু কীভাবে একটি বৈশিষ্ট্য পরের প্রজন্মে সঞ্চারিত হয় তা ডারউইন বলতে পারেননি। আর ল্যামার্ক সেটাই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। ল্যামার্কের ব্যাখ্যা ভুল ছিল। (পাদটীকা ও তথ্যসূত্র ২)
ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব প্রকাশের কিছু পরে, ১৮৬৫ সালে, গ্রেগর যোহান মেন্ডেল-এর বংশগতির পরীক্ষা নিয়ে গবেষণা প্রকাশিত হয়। কিন্তু ৩৫ বছর ধরে তা অনাদৃত ছিল। কয়েকজন বিজ্ঞানী ১৯০০ সালে তার মূল্য প্রথম বুঝতে পারলেন। সেই সূত্র ধরে বংশগতির একক জিন-এর ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়। ডারউইন জিরাফের দুটি শাবকের মধ্যে গলার দৈর্ঘ্যের জন্মগত ফারাক ও সেই ফারাক বংশানুক্রমে প্রবাহিত করার কথা বলেছিলেন। এত দিনে জিনের ধারণার সাহায্যে এই ফারাকের কারণ ও বংশানুক্রমে তা প্রবাহিত হবার প্রকৃত পদ্ধতি বোঝা গেল।
জিনতত্ত্ব প্রস্তাব করেছে যে ‘জন্মগত গুণাবলী’ পরের প্রজন্মে প্রবাহিত হয়, কিন্তু ‘অর্জিত গুণাবলী’ পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত হয় না। পরীক্ষায় তা ‘প্রায়’ প্রমাণিত হয়েছে। ‘প্রায়’ কেন, তা ক্রমশ প্রকাশ্য। জিনতত্ত্ব বলে, আপনি জিমে গিয়ে ব্যায়াম করে সুপুষ্ট মাংসপেশির অধিকারী হতে পারেন, তাতে আপনার পুত্র বা কন্যার পেশল চেহারা হবার সম্ভাবনা বিন্দুমাত্র বাড়ে না। অন্যদিকে, আপনার চেহারা যদি পারিবারিক ধাত অনুসারেই পেশিসমৃদ্ধ হয়, তাহলে আপনার পুত্র বা কন্যা কোনও চেষ্টা ছাড়াও পেশল গঠন পেতে পারে। এই কথাগুলো অজস্র পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে।
ল্যামার্কের তত্ত্বকে ভুল বলে প্রমাণ করার কাজে যারা পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন জার্মান বিজ্ঞানী আগুস্ট ফ্রেইডরিখ লিওপোল্ড ভাইজম্যান। তিনি ইঁদুর নিয়ে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানে সবথেকে বিখ্যাত পরীক্ষাটি করেন। কট্টর ডারউইন-পন্থী ও ল্যামার্কবাদ বিরোধী ভাইজম্যান ৯০১-টি ইঁদুর (mouse) ধরে তাদের লেজ কেটে দিয়েছিলেন। পাঁচটি প্রজন্ম ধরে ইঁদুরদের লেজ কেটেও একটিও লেজকাটা ইঁদুর জন্মায়নি। (তথ্যসূত্র ৩) ১৮৮৮ সালে এই পরীক্ষার ফল দেখিয়ে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, কোনও অর্জিত বৈশিষ্ট্য বংশপরম্পরায় যেতে পারে না। ভাইজম্যানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরে মূলধারার জীববিজ্ঞানে ল্যামার্ক অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেন।
কিন্তু ভাইজম্যান যে সমস্ত ইঁদুরের লেজ কেটে উঠতে পারেননি, সেটা ২০১৪ সালে প্রমাণিত হবে। তবে সে কথার আগে আমরা একবার যাব নেদারল্যান্ড তথা হল্যান্ডে।
সময় ১৯৪৪ সালের শীতকাল। বিশ্বের আকাশে তখন দুর্যোগের ঘনঘটা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়।
সে কথা পরের পর্বে।
চিত্রসূচি
১) জাঁ ব্যাপতিস্তে ল্যামার্ক (চিত্রঋণ–উইকিপিডিয়া)
২) ল্যামার্কের জিরাফ আর ডারউইনের জিরাফ (চিত্রঋণ—slideshare.net)
পাদটীকা ও তথ্যসূত্র
১) Early Concepts of Evolution: Jean Baptiste Lamarck. The History of Evolutionary Thought. https://evolution.berkeley.edu/evolibrary/article/history_09
২) প্রসঙ্গত, ডারউইন নিজেও একই পিতামাতার সন্তানদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যের ফারাক কেমন করে হয় তার ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছিলেন। ডারউইনের সেই ব্যাখ্যা ল্যামার্কের ব্যাখ্যার মতই ভুল ছিল। (তথ্যসূত্র Zou Y. Charles Darwin’s Theory of Pangenesis. The Embryo Project Encyclopedia. Published: 2014-07-20. https://embryo.asu.edu/pages/charles-darwins-theory-pangenesis
৩) August Friedrich Leopold Weismann (1834-1914). Yawen Zou. The Embryo Project Encyclopedia. Published: 2014-05-23. https://embryo.asu.edu/pages/august-friedrich-leopold-weismann-1834-1914