প্রায় ছাব্বিশ বছর আগে, এক রবিবারের ক্ষান্তবর্ষণ সকালে, উন্নততর অর্ধাংশের হাতে তৈরী টিপিন খেয়ে, সদ্যক্রীত পেরী ম্যাসন হাতে তক্তপোশে পিঠ দিয়েছি। তীব্র শব্দে দূরভাষের আওয়াজে উঠতে হলো।
তখন আমি হাওড়ায় এক কেন্দ্রীয় সরকারি হাসপাতালে কর্মরত। থাকি হাসপাতালের উল্টো দিকে রাস্তার ওপারে সরকারী আবাসে। যদিও সেদিন আমার ‘অন কল’ ডিউটি নয় তবুও হাসপাতালের কাছে থাকি বলে মাঝে-মধ্যেই ডাক পরে। দূরভাষের ওপারে আমার এক সহকর্মী অস্থিরোগ বিশেষজ্ঞ, বললো ‘দাদা, একটি টেন্ডন ইনজুরি’ রোগী এসেছে, আপনি যদি একবার..’ উন্নততর অর্ধাংশের রোষকষায়িত বহ্নি লোচন উপেক্ষা করেই যেতে হলো।
গিয়ে দেখি কুড়ি বাইশ বছরের এক সাফাই কর্মী তার বাড়ির অ্যাকরিয়াম পরিষ্কার করতে গিয়ে কাঁচ ভেঙে ডান হাতের কবজির একটু ওপরে কেটে গেছে অনেকখানি। ভালো করে পরীক্ষা করে দেখি ওর হাতের রেডিয়াল আর আলনার ধমনী দুটোই কেটে গেছে, সেই সঙ্গে মিডিয়ন স্নায়ু এবং কয়েকটি টেন্ডন ও কবজির ঠিক ওপর থেকে কেটে গেছে। যার অর্থ ওর ডান হাতে কোন রক্ত সঞ্চালন হচ্ছে না। আঙুলে ইনজেকশনের সূঁচ ফুটিয়ে দেখলাম কোন রক্ত বেরলো না। অবিলম্বে কিছু না করলে এই তরুণ টির ডান হাত বাদ দিতে হবে।
সেই সময় আমাদের কোন রোগীকে কোথাও পাঠানোর উপায় ছিল না, এক মাত্র কোনও মেডিক্যাল কলেজ ছাড়া, কিন্তু সেখানেও এই রোগীর ভর্তি ও দ্রুত অস্ত্রোপচারের সম্ভাবনা কম।আর যত সময় যাবে এই অসহায় তরুণটির হাত বাদ দেওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। আঘাত লাগার পর ইতিমধ্যেই প্রায় দু ঘন্টা কেটে গেছে। আর চার ঘন্টার মধ্যে যা করার করতে হবে। মুশকিল হচ্ছে আমাদের হাসপাতালে ভাসকুলার সার্জারির কোন পরিকাঠামো নেই, যন্ত্রপাতি নেই, কোন ভাসকুলার সার্জনও নেই।
আমি নিজে চেন্নাইতে ‘হ্যান্ড সার্জারি’ ফেলোশিপ করার সময় কিছু ভাসকুলার সার্জারি দেখেছি। আর আমার অভিজ্ঞতা বলতে লার্নিং রুমে বসে, গ্লাভসের টুকরো আর গাছের পাতার টুকরো সেলাই। ওই অসহায় তরুণটির মুখের দিকে তাকিয়ে,বাড়ির লোকজনের সাথে কথা বলে, এক দুঃসাহসে ভর করে সিদ্ধান্ত নিলাম, একটা চেষ্টা আমি করবো।
আমাদের হাসপাতালে চক্ষুবিভাগে কিছু পুরনো যন্ত্রপাতি ছিলো, তা থেকে কয়েকটি বেছে নিয়ে জীবাণুমুক্ত করা হলো। সেলাইয়ের জন্য দুটি 8 ‘0’ সিল্ক খুঁজে পেলাম। এইগুলি এই ধরনের সার্জারির উপযুক্ত নয়, কিন্তু ভিখারীদেরতো কোন পছন্দের অবকাশ নেই। রবিবার বলে কোন অ্যানাস্থেটিস্টকে ও পাওয়া গেল না। রোগীকে অপারেশন টেবিলে তুলে তাকে ‘ব্রেকিয়াল ব্লক’ অ্যানাস্থেশিয়া আমিই দিলাম। তার পর হাত ধুয়ে আমার সহকর্মীকে নিয়ে অপারেশনে নেমে পড়লাম।
যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা, আমার অনভিজ্ঞতা, দ্রুত অপারেশন শেষ না করতে পারলে হাতে পচন ধরবে, এতগুলি প্রতিবন্ধকতা আমার সামনে ছিল। অ্যানাস্থেটিস্ট না থাকাতো ছেড়েই দিলাম। অপারেশনের সময় ছিন্ন ধমনী থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত বন্ধ করার জন্য কোন ‘ভাসকুলার ক্লাম্প’ আমার ছিলো না, তাই আমার সহকর্মীকে আর্টারি ফরসেপসে গজ পেঁচিয়ে চেপে ধরে থাকতে বলেছিলাম। একে একে রেডিয়াল আর আলনার ধমনীকে জোড়া লাগালাম, তারপর রোগীর আঙুলে সূঁচ ফোঁটাতেই আঙুল দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো, নিজের হৃৎপিণ্ডের ধুক্পুকুনি একটু কমলো। ছিন্ন মিডিয়ন স্নায়ু আর টেন্ডনগুলিও জোড়া দিলাম। তারপর হাতে প্লাস্টার করে গ্লাভস খুললাম।
আমার সহকর্মী অস্থিরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মজা করে বললেন যদি ভাসকুলার সার্জারি এতোই সোজা হয় আর এই হাত যদি বাঁচে উনি অস্থিরোগ চিকিৎসা ছেড়ে দেবেন। আমার অসীম সৌভাগ্য যে ঐ তরুণ সাফাইকর্মীর ডান হাতটি আমি বাঁচাতে পেরেছিলাম আর আমার সহকর্মীও অস্থিরোগ চিকিৎসা ত্যাগ করেন নি।
আজ এই CPA-র যুগে এই ধরনের দুঃসাহস বোধহয় আমি দেখাতাম না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যখন কিঞ্চিৎ আড়ষ্ট হাতে ওই সাফাই কর্মীটি আমায় হাত জোড় করে নমস্কার করত তখন আমার চিকিৎসক জীবনের অসংখ্য যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিত।
Apni asadharon ekjan manus. R doctor hisabe apnar surgery atuloniyo. Sudhu sahos noi apni manobikotar dharmo grahon korechen. Amar jibone apni srestho manus. Chesta korbo apnar pothe cholte.
এত প্রশস্তি আমার প্রাপ্য নয় । আমি এক অতি নগন্য চিকিৎসক । আমার সীমাবদ্ধতা, দীনতা আমি জানি ।আমার অসীম সৌভাগ্য যে আপনাদের সকলের সাথে আমি কাজ করার সুযোগ পেয়ছি ।
প্রণাম নেবেন ডক্টর। আপনার surgery র হাত এর মতই লেখার হাত। আরও অনেক লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
অনেক ধন্যবাদ । চেষ্টা করব ।
এই রকম ঘটনার সাক্ষী আমি।বছর দশেক আগে এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা এসেছিলেন ওয়াশিং মেসিনে ইনজিওর্ড হয়ে।বাড়িতে কেউ ছিল না,প্রতিবেশী নিয়ে এসেছিলেন।আপনি অসাধারণ দক্ষতার সাথে পাঁচটি আঙুল রিপেয়ার করেছিলেন। আমি অ্যাসিস্ট করেছিলাম।এখনো ওয়াশিং মেসিনে হাত দিলে আপনার দেওয়া উপদেশ গুলি মনে পড়ে আর সাবধান হয়ে যায়।প্রণাম নেবেন।
অনেক ধন্যবাদ । খুব ভালো থাকবেন।
Amar pranam neben sir… apni eto bhalo manush ebong surgeon sir sei jonnyo apnake khub e respect kori.. tar sathe aj apnar lekha ta mon chhuye gelo.. khub bhalo thakben sir
Thank you very much.???
আপনার হাতে দিয়েছিলেন,কত হাতের ভার।
হাতের অপরেশনে বিধাতা,হাত দেন নি আর।।
বৃহস্পতিবার আপনার চব্বিশ ঘন্টা ডিউটি ।
আঙুল কাটা রোগী এলে,অপরেশন বিউটি।।
জুড়বে আঙ্গুল অবশ্যই, সচল হবে হাত।
ডঃ কীর্তনীয়া দিলে হাত,হবেই বাজীমাত।।
খুব সুন্দর কবিতা, তবে এত প্রশংসা আমার প্রাপ্য নয় ।
খুব ভাল কাজ। খুব ভাল লেখা, অনিরুদ্ধ।
অনেক ধন্যবাদ দাদা ।
খুব ভালো লাগলো আপনার লেখা। গুনী মানুষ রা সব বিষয়ে ই গুনী হয়।
প্রনাম নেবেন, ভালো থাকবেন স্যার
অনেক ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।
আপনি একজন সু চিকিৎসক শুধু নয়,সু লেখক ও,আপনার লেখাতে বুঝলাম যে আপনি এত বড়ো মনের মানুষ।সুস্থ থাকুন।ভালো থাকুন।প্রনাম নেবেন। ? সোনালী।
অনেক ধন্যবাদ, খুব ভালো থেকো।
Apnar lekha porle bojha jaye apni anek baro moner manus..ato sahridayota..ato sahanubhuti..tarsathe binamrota..sob miliye apnar sathe swayong bhagoban k tulona korle bindumatro bhul hobe na..
জীবনে এ এক পরম প্রাপ্তি। এখনকার সময়ে এই পরিসেবা কল্পনাতীত !
অসীম সাহস আর নিজের আত্মবিশ্বাস না থাকলে এমন কাজ করা একরকম অসম্ভব।
ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না।
শুধু মাত্র কুর্ণিশ জানাই এমন প্রচেষ্টাকে।
অনেক ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।