(১৮৫৩ সালে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ছবি। পাশে ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত সংবাদ। সূত্রঃ ওয়েলকাম লাইব্রেরি, লন্ডন)
এর আগের অংশে নেটিভ মেডিক্যাল ইন্সটিটিউশনের (NMI) অবলুপ্তি নিয়ে বলেছিলাম – “১৮৩৩ সালে বেন্টিঙ্ক এদেশে মেডিক্যাল শিক্ষার হাল-হকিকত বোঝার জন্য এবং নতুন মেডিক্যাল শিক্ষার খুঁটিনাটি বুঝতে একটি কমিটি তৈরি করলেন – “for the purpose of enquiring into the condition of the then existing medical institutions and of revising the whole question of Indian medical education. The members of this Committee were: Surgeon John Grant, Apothecary (Medical Store-keeper) of the Company; J. C. C. Sutherland Esqr., Secretary to the Education Committee; C. C. Trevelyan Esqr., Deputy Secretary to the Political Department; Assistant Surgeon Spens of the Bodyguard; Assistant Surgeon M. J. Bramley, Assistant Marine Surgeon; and Babu Ram Comul Sen.” (Centenary of the Calcutta Medical College, 1935, p. 7) ২০ অক্টোবর, ১৮৩৪-এ এই কমিটি একটি দীর্ঘ রিপোর্ট জমা দেয়। খুব সংক্ষিপ্ত আকারে বললে কমিটির রেকমেন্ডেশন ছিল এরকম – “(1) The absence of a proper qualifying standard of admission; (2) scantiness of means of tuition; (3) the entire omission of practical human anatomy in the course of instruction; (4) want of regularity in the time of admitting students; (5) the shortness of the period of study; (6) the want of means and appliances for the convenience of private study; (7) the desultory character of the students’ attendance on the practical means of instruction; (8) the inconclusive nature of the power and authority wherewith the Superintendent is vested; (9) the mode of conducting the final examination.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮)”
বলেছিলাম – “NMI-এর অবলুপ্তি ঘটার পরে ১৮৩৫-এর মে মাসে এই স্কুলে পাঠরত ভিন্ন প্রদেশের ছাত্ররা নিজেদের পয়সায় নৌকো ভাড়া করে, ওখানে পড়ানো বইগুলো বগলদাবা করে চলে গেল। এরা মিশে গেল স্থানীয় জনতার মাঝে নতুন মেডিক্যাল জ্ঞান নিয়ে। সরকার এদের দিকে আর ফিরেও তাকায়নি।” (সীমা আলাভি, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৯৮-৯৯) কিন্তু ১ জানুয়ারি, ১৮৩৯ সালের সরকারি হিসেব থেকে জানা যায় বাংলা প্রেসিডেন্সিতে মোট ৩০৫ জন “নেটিভ ডক্টর” কর্মরত ছিল। এদের মধ্যে ১২৪ জন পাস করেছিল NMI থেকে। (Centenary of the Calcutta Medical College, পৃঃ ৯)
ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে উপনিবেশিক স্বার্থের কাজে পূর্ণত ব্যবহার করা হয়েছে NMI-কে। আবার প্রয়োজন মিটে গেলে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে।
NMI-এর উপজাত হিসেবে উপনিবেশিক ভারতের মানুষ নতুন ধরণের চিকিৎসা ও শিক্ষাপদ্ধতি পেয়েছে। এর ফলভোগ করেছে। তবে ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে বড় সত্যি হল এশিয়ার প্রথম আধুনিক মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষাক্রমকে গ্রহণ করার উপযুক্ত সামাজিক মানসিকতা এবং ছাত্রের জোগানের পথ সুগম করেছে NMI।
শিল্পজগতের মতো মেডিক্যাল জ্ঞান উৎপাদনেরও ভিন্ন প্রক্রিয়া ভারতে চালু হয়েছিল (যেমনটা ইউরোপেও হয়েছিল) – তবে কলকারখানায় নয়, শিক্ষার প্রাঙ্গনে, medical cosmology-তে।
বেন্টিঙ্ক, বেন্থাম এবং মেডিক্যাল কলেজের আবহ রচনা
ভারত থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পদ লুঠের একটি হিসেব দিয়েছেন উইলিয়াম ডারলিম্পল। প্রথম যে ভারতীয় শব্দগুলো ইংরেজি অভিধানে প্রবেশ করে তার একটি ছিল “loot”। “What the people of England did understand very clearly was the unprecedented amount of money – or to use the newly Anglicized word loot – that Clive was bringing back with him.” (The Anarchy, পৃঃ ১৩৮) ডারলিম্পল জানাচ্ছেন – ক্লাইভ নগদে এবং রত্নসম্ভারে ১,২০০,০০০ পাউন্ড অর্থ নিয়ে ফিরেছেন এবং তাঁর স্ত্রীর হেফাজতে যে রত্নসম্ভার ছিল তার পরিমাণ ২০০,০০০ পাউন্ড। এখনকার হিসেবে, ডারলিম্পলের হিসেব অনুযায়ী, যথাক্রমে ১২৬ মিলিয়ন পাউন্ড এবং ২১ মিলিয়ন পাউন্ড। (প্রাগুক্তঃ পৃঃ ১৩৯) এই ছিল লুঠের পরিমাণ।
১৮২৭ সালে উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক বাংলার গভর্নর জেনারেল হয়ে ভারতে দ্বিতীয়বার আসেন। এর আগে তিনি মাদ্রাজে সরকারের কর্তাব্যক্তি হিসেবে কাজ করেছিলেন। এদেশে এসে প্রথম যে কাজটিতে হাত দিয়েছিলেন তাহল একের পর এক যুদ্ধে বিদ্ধ্বস্ত এবং প্রায় শূণ্য কোষাগারকে লাভের মুখ দেখানো। সি এ বেইলি তাঁর Indian Society and the Making of the British Empire গ্রন্থে বলছেন – “Between 1829 and 1835 he transformed a budget deficit of one and a half million pounds sterling into a surplus of a half a million pounds … Worst of all British India found stability neither on its internal and or external frontiers … It is against this background that Bentinck’s social and educational reforms must be set … The Governor General was certainly influenced by the utilitarian philosophy of government urged by James Mill. (পৃঃ ১২১। নজরটান আমার।) লুঠ এবং যুদ্ধের কারণে বেন্টিঙ্কের সময়ে অর্থের ঘাটতি চলতে থাকে। এই ঘাটতি বেন্টিঙ্ক পূরণ করেন।
এর ফলে ১৮৩৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রায় রদ হয়ে যাওয়া চার্টারের নবীকরণ ঘটে। এবং এর প্রশাসনিক পুরস্কার হিসেবে বেন্টিঙ্ক ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল হিসেবে মনোনীত হলেন।
আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য, তৎকালীন ভারতের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার অভাব নিয়ে যে অভিমত ঐতিহাসিক বেইলি ব্যক্ত করেছেন বেন্টিঙ্ক তার বিপরীত কথা বলেছেন বন্ধু পিটার অবারকে লেখা একটি চিঠিতে – “he has seen danger in the Benares affair and Kol insurrection. My firm opinion on the contrary is that no dominion in the world is more secure against internal insurrection”। (C H Philips, ed., Correspondence of Lord William Cavendish Bentinck, vol. 2, পৃঃ ১২৭৯-১২৮০)
ভারতের দায়িত্বভার নেবার আগে বেন্টিঙ্ক “indeed subscribed in 1826 for two shares in the newly founded University College, London – an institution under combined Whig, Benthamite and Dissenting control, and a forward battalion in the ‘march of mind’…”. (John Rosselli, Lord William Bentinck: The Making of a Liberal Imperialist, 1774-1839, 1974, পৃঃ ৮৫)
১৮২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডন (UCL) রক্ষণশীল ইংল্যান্ডের স্থবির মেডিক্যাল শিক্ষার গোড়ায় আঘাত করেছিল। অক্সফোর্ড এবং কেম্ব্রিজের বিপরীতে ইউনিভার্সিটি কলেজের ছাত্রদের প্রয়োজন ছিলনা “subscription to the thirty nine Articles of the Church of England. This new university tried in the 1830s to join the theoretical study of science to the practical work of the clinic, as was already underway in Germany.” (Thomas Neville Bonner, Becoming a Physician: Medical education in Britain, France, Germany, and the United States, 1750–1945) এরকম এক অবস্থানের ফলে এই ইউনিভার্সিটি নিঃসন্দেহে সেসময়ে র্যাডিক্যাল ছিল। এই কাজগুলো করতে গিয়ে UCL-কে অনেক বিপত্তি ও বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে – “Likewise in Britain, when the new University of London tried in the 1830s to join the theoretical study of science to the practical work of the clinic, as was done in Germany, the hospital teachers at St. Bartholomew’s objected strenuously that the new school was superior “in no respect” and that it was “much inferior” to others in its practical instruction.” (Bonner, Becoming a Physician, পৃঃ ১৪৪)
রসেলির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী UCL-এর ওপরে ছিল – “Whig, Benthamite and Dissenting control, and a forward battalion in the ‘march of mind’…”। (John Rosselli, Lord William Bentinck: The Making of a Liberal Imperialist, 1774-1839, 1974, পৃঃ ৮৫) ফলে এই শেয়ার কেনা বেন্টিঙ্কের রক্ষণশীলতা বিরোধী মানসিকতা প্রকাশ করে অবশ্যই। UCL-এর শেয়ার কেনার ১ বছর পরেই বেন্টিঙ্কের ভারতে আগমন।
ভারতে আসার আগে বেন্টিঙ্ক জেরেমি বেন্থামের সাথে দেখা করে আসেন। তিনি বেন্থামের কাছ থেকে তাঁর যুগান্তকারী পুস্তক Panopticon উপহার পান। বেন্থাম লিখছেন – “While writing, it has occurred to me to add a copy of a work called Panopticon … it is in the hands of the your new Governor-general, Lord William Bentinck”। (The Works of Jeremy Bentham, ed. John Bowring, vol. X, 1843, পৃঃ ৫৯১) এই প্যানপ্টিকনকে অনুসরণ করে আন্দামানের সেলুলার জেল তৈরি হয়। প্যানপ্টিকন নিয়ে আলোচনা করে ফুকোর Discipline and Punish এক নতুন চিন্তার ইতিহাস রচনা করেছে।
বেন্থাম আরও জানাচ্ছেন যে ১৮২৭ সালের নভেম্বর মাসে বেন্টিঙ্কের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের সময়ে বেন্টিঙ্ক তাঁকে বলেছিলেন – “I am going to British India; but I shall not be Governor-General. It is you that will be Governor-General.” (The Works of Jeremy Bentham, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৭৭) এরকম প্রভাব ছিল বেন্টিঙ্কের চিন্তাভাবনার ওপরে প্যানপ্টিকনের লেখক জেরেমি বেন্থামের।
প্রসঙ্গত, গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করা দরকার যে বেন্থামের ক্ষেত্রে Utilitarianism-এর দর্শন তাঁর নিজের জীবনকে এতটাই পরিচালিত করেছিল যে মাত্র ২১ বছর বয়সে ১৭৬৯ সালে তিনি তাঁর মরদেহ ডিসেকশনের জন্য উইল করেছিলেন। ১৮৩২ সালে তাঁর মৃত্যুর তিনি প্রথম মরণোত্তর দেহদানকারী হিসেবে এক ঐতিহাসিক উচ্চতায় পৌঁছে যান। ডিসেকশনের পরে তাঁর দেহ এখনও UCL-এ auto-icon হিসেবে প্রদর্শনীর জন্য রাখা আছে। ফলে বেন্টিঙ্কের শিক্ষা সংস্কারের কাজের ওপরে বেন্থামের গভীর প্রভাব লক্ষ্যণীয়।
(বর্তমানে রক্ষিত বেন্থামের দেহ)
রসেলি তাঁর গবেষণা গ্রন্থে বেন্টিঙ্কের ব্যাপারে জানাচ্ছেন – “as early as 1829 he looked to ‘the British language as one of the agents in making a united, regenerated, imperial India. By 1833-34 he had in his mind a ‘plan of national education’ in India.” (Rosselli, Lord William Bentinck, পৃঃ ২১৫)
এরকম একটি প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক পার্সিভাল স্পিয়ার তাঁর “Bentinck and Education” প্রবন্ধে (সংকলিত হয়েছে Thomas R Metcalfe সম্পাদিত Modern India – An Interpretive Anthology গ্রন্থে, পৃঃ ২৪০-২৬০) মন্তব্য করেন যে “ভারতের পরিবর্তনের দিকে তাকানোর আগে আমাদের তাকাতে হবে ইংল্যান্ডের দিকে যেখানে এই নীতির পরিবর্তনের হদিশ পাওয়া যাবে। The two sources of these ideas were, briefly, the Evangelical and the Utilitarian.” (পৃঃ ২৪৫) স্পিয়ার আরেকটি বিষয়ের দিকে পাঠকের মনো্যোগ আকর্ষণ করেছেন – “The West loves a sign, and when it finds no large buildings labelled “the Smith College” or “the Jones High School” it is apt to assume that there is no such thing as education in the land.” (পৃঃ ২৪৭)
যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃহদাকৃতি নাই হবে তাহলে সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষালয় হিসেবে মর্যাদা পাবার যোগ্য নয়। ফলে, NMI-এর যুগ পেরিয়ে, যেখানে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েই ওঠেনি এবং সুপারিন্টেন্ডেন্টের জন্য ভাড়া নেওয়া বাড়িতে পড়ানো হত, শুরু হল বৃহৎ অবয়বের প্রতিষ্ঠান মেডিক্যাল কলেজের যুগ। তাহলে যে “sign” পশ্চিম পছন্দ করে তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলো বলে দাবী করা যায়।
(১৮৩৯ সালে মেডিক্যাল কলেজের প্ল্যানের চিত্র)
মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠা
এরকম এক পটভূমিতে আমরা ১৮৩৫ সালের ২৮ জানুয়ারি যে ঐতিহাসিক সরকারি নির্দেশনামায় (G.O. 28 OF 28 January, 1835) মেডিক্যাল কলেজের সুস্পষ্ট ধারাগুলো বিন্যস্ত করা হয়েছিল সেগুলো বুঝে নিই। মোট ৩৫টি ধারার ৪ নম্বর ধারায় বলা হল – “That this college shall be under the control of the education committee.” NMI-এর যুগের মেডিক্যাল বোর্ড এবং সামরিক কর্তৃত্বের অবসান হল। মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষা চলে এল এডুকেশন কমিটির অধীনে।
৫ নম্বর ধারায় বলা হল – “That the education committee shall have the assistance of the following medical officers, ex-officio. The Surgeon of the General Hospital, the Surgeon of the Native Hospital, the Garrison Surgeon of Fort William, the Superintendent of the Eye Infirmary, and the Apothecary to the Hon’ble Company.” ১০ নম্বর ধারায় বলা হল ছাত্র সংখ্যা ৫০ জনের মধ্যে থাকবে।
খেয়াল করতে হবে, NMI-এর যুগে শিক্ষার বাহন ছিল দেশীয় ভাষা, যেমন নাগরি, ফার্সি, আরবি বা উর্দু, এবং এজন্য ছাত্রদের হিন্দি এবং ফার্সি জানা আবশ্যিক ছিল। ১৮২২ সালের এই বোধ ১৩ বছরের মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে শিক্ষার একমাত্র বাহন হল ইংরেজি। ৮ নম্বর ধারায় বলা হল ছাত্রদের ইংরেজি এবং বাংলা অথবা ইংরেজি এবং হিন্দুস্তানী ভাষার জ্ঞান আবশ্যিক। বেন্টিঙ্ক তাঁর বন্ধু পিটার অবারকে ১২ মে, ১৮৩৪-এ লিখছেন – “Three thousand boys are learning English at this moment in Calcutta and the same desire for knowledge is universally spreading.” (Philips, Correspondence of Lord William Cavendish Bentinck, vol. 2, p. 1279) ১৮৩৪ সালের মে মাসে কলকাতায় ৩০০০ ছাত্র ইংরেজি শিখছে। এ ঘটনা নীতি নির্ধারক সর্বোচ্চ কর্তার কাছে অবশ্যই ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পরে আরেক জায়গায় বলছেন – “Within a few years however, the progress of education in Calcutta has been exceedingly rapid”। (প্রাগুক্তঃ পৃঃ ১৩৯৯)
প্রসঙ্গত আরেকটি তথ্য আমাদের বিবেচনার দাবী রাখে। ১৮৩৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে (মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার সময়কালে) কলকাতার ৬,৯৪৫ জন হিন্দু অধিবাসী (যার মধ্যে হিন্দু কলেজের সমস্ত পরিচালকেরাও ছিলেন) বেন্টিঙ্কের কাছে এক স্মারকলিপি দেয় “praying that the existing restrictions on the use of English in the law courts be removed.” (A. F. Salahuddin Ahmed, Social Ideas and Social Change in Bengal, 1818-1835, Papyrus, Calcutta, 2003, পৃঃ ২০৪)
ফলে মেডিক্যাল কলেজ তৈরির নির্দেশনামায় ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক করার ক্ষেত্রে কোন দ্বিধা কাজ করার সঙ্গত কোন কারণ ছিলনা। ১৩ বছরের মধ্যে শিক্ষাগ্রহণের চেতনায়, বোধে এবং সামাজিক গ্রাহ্যতায় ইংরেজি ভাষা চালকের আসনে বসে গেছে।
এসময়ে আমরা একবার একটি কম জানা ইতিহাস স্মরণ করে নিতে পারি। ১৮২৮ সালে রবার্ট মন্টগোমারি মার্টিন (একজন সিভিল সার্ভেন্ট এবং হং কং-এর কলোনিয়াল ট্রেজারার ছিলেন ১৮৪৪-৪৫ সময়কালে) কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজ তৈরির প্রথম প্রস্তাব দেন। কিন্তু সরকার সে প্রস্তাব নাকচ করে দেয় সময়োপযোগী নয় বলে। মার্টিনের কথা – “A medical college at Calcutta (the project and plan of which was laid by me before Lord Wiiliam Bentinck, in 1828, but rejected at the time by the Supreme Government, lest Hindoo prejudices should be offended) is now in full operation, and producing much good.” (Robert Montgomery Martin, Statistics of the colonies of the British Empire in the West Indies, South America, Asia, Austral-Asia, Africa, and Europe…, পৃঃ ৩০৫) অর্থাৎ, ১৮২৮ সালে যা সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিল, ১৮৩৫-এ এসে তা একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণের জন্ম দিল। এখানে বেন্টিঙ্কের চিঠির তাৎপর্য নিহিত রয়েছে – “Within a few years however, the progress of education in Calcutta has been exceedingly rapid”।
৯ নম্বর ধারায় বলা হল – “That the candidates shall be examined by the education committee and the superintendent of the institution, and that the selection of the pupils shall be determined by the extent of their acquirements.” NMI-এর যুগে মোটের উপরে হিন্দি, ফার্সি, উর্দু, হিন্দিতে কাজ চালানোর মতো জ্ঞান থাকলেই ভর্তি হবার সুযোগ ছিল। এমনকি একজন কুলিও ভর্তি হতে পারত। কিন্তু মেডিক্যাল কলেজে এসে ছাত্র নির্বাচন প্রক্রিয়ার গোড়ায় আমূল পরিবর্তন ঘটে গেল।
১৩ নম্বর ধারায় বলা হল – “That the formation of these classes (১২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছিল ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস এবং থার্ড ক্লাস, এই তিন ধরণের ক্লাস থাকবে মেডিক্যাল কলেজে, সে প্রেক্ষিতে ১৩ নম্বর ধারা) shall be entrusted to the management of the education committee and the superintendent of the institution, it being distinctly understood that the classification will depend upon the acquirements of the pupils, and not upon the period of their studies”। এখানেও খুব পরিষ্কার ভাষায় কেবলমাত্র ছাত্রদের মেধা বিবেচনা করার কথা লিখিত হল। আর পুরনো ধরণে সিনিয়রিটি কিংবা উঁচুমহলের যোগযোগ দিয়ে ক্লাসের স্থান নির্ধারণ চলবেনা। কেবলমাত্র নিজের মেধা, দক্ষতা এবং কৃতকার্যতা দিয়ে অর্জন করতে হবে ডিগ্রি। যদিও একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা, যত সময় এগিয়েছে তত উপনিবেশিক প্রশাসনে এবং শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বজনপোষণ এবং চাটুকারিতা উন্নতির সোপান বেয়ে ওপরে ওঠার এক সবিশেষ ক্ষেত্র ছিল।
কিন্তু প্রথম যুগের এই নির্দেশাবলী বোঝায়, ছাত্রকে শিক্ষার বুনিয়াদ মজবুত করে আসতে হবে। এবং যেভাবে এডুকেশন কমিটি এবং সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছাত্রদের নির্বাচিত করবে তার মধ্যে আজকের যুগের মারাত্মক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এন্ট্রান্স পরীক্ষার ছায়া দেখা যায়। একটু লঘু করে বললে একে কি প্রোটো-এন্ট্রান্স একজামিনেশন বলা যায়?
NMI প্রতিষ্ঠার নির্দেশিকায় প্রথম “public servants” এবং এর অনুসারী “public service”-এর ধারণা আসে। মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার ৩৫টি ধারার নির্দেশিকাতেও এ ধারণা পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হল। ১৯ নম্বর ধারাতে বলা হল – “That the public service shall be supplied with native doctors from the institution … The selection shall be regulated by the extent of the professional acquirements.” এ ঘটনার সুদূরপ্রসারী ফলাফল হল যে ডাক্তারি পেশাও আইসিএস বা সমধর্মী সরকারি পেশার সাথে একগোত্রে চলে এল। ফলে এদের মাইনে থেকে রিটায়ারমেন্ট সবই নির্দিষ্ট সরকারি নিয়ম মেনে হবে এবং এরা ২৪ ঘন্টার জন্য যেকোন মুহূর্তে কাজের ডাক পড়লে যেতে বাধ্য থাকল। শুধু তাই নয়, এবার থেকে চাকুরিরত ডাক্তাররা যারা চিকিৎসা নিতে আসছে তাদের কাছে নিজেদের কাজের জন্য দায়বদ্ধ থাকল। শুরু হল প্রশাসনিকভাবে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
১৪ নম্বর ধারায় বলা হল, মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র হিসেবে ৪ বছরের কম বা ৬ বছরের বেশি থাকতে পারবেনা। ১৫ নম্বরে স্পষ্ট ভাষায় জানানো হল – “That all foundations pupils be required to learn the principles and practice of the medical science in strict accordance with the mode adopted in Europe.” NMI-তে ইউরোপীয় বিজ্ঞানকে vernacularize করা হয়েছিল, আর এখানে সরাসরি ইউরোপেীয় পদ্ধতিকে কঠোরভাবে অনুসরণ করে চিকিৎসাবিজ্ঞান শেখার কথা বলা হল।
১৬ নম্বর ধারায়, প্রথম ধাপে, যে ছাত্ররা তাদের লেখাপড়া সফলভাবে সম্পন্ন করেছে তাদেরকে সুপারিন্টেন্ডেন্টের স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেট পেতে হবে বলা হল। এই সার্টিফিকেট পেলে, এরপরের ধাপে, ১৭ নম্বর ধারায় বলা হল – “That the final examination for granting certificates of qualification to practise surgery and medicine, or for admission into the service”। অর্থাৎ, স্বাধীন প্রাইভেট প্র্যাকটিস কিংবা চাকরিতে প্রবেশ করা – দুটো রাস্তাই খোলা রইল।
২১ নম্বর ধারায় বলা হল – এডুকেশন কমিটির দায়িত্ব হল ক্লাস করার জন্য একটি “suitable building for the college, a library, anatomical preparations, and all other objects of indispensible necessity to the education of the pupils” ইত্যাদি সমস্ত কিছুর ব্যবস্থা করা।
সহজ কথা হল, স্কুলের পর্যায় পেরিয়ে একটি কলেজের সূচনা হল যেখানে ইউরোপীয় পদ্ধতিতে মেডিক্যাল শিক্ষা দেওয়া হবে। এজন্য, ২৮ নম্বরে বলা হল, “That the superindent shall be aided in his duties by a European assistant”, যার মাইনে হবে সুপারিন্টেন্ডেন্টের অর্ধেক ৬০০ টাকা প্রতিমাসে।
ব্যাপারটা দাঁড়ালো যে, কলেজ শুরু হল বটে তবে মাত্র দুজন শিক্ষক নিয়ে (একজন সুপারিন্টেন্ডেন্ট ও তাঁর একজন সহকারী) এবং মেডিসিন ও সার্জারি শিক্ষার বিষয় হিসেবে প্রধান গুরুত্ব পেল। মেডিক্যাল সায়ান্সের অন্যান্য শাখা তখনও জন্মলগ্নের মেডিক্যাল কলেজের সিলেবাসের চৌহদ্দির বাইরে। সুপারিন্টেন্ডেন্ট (পরবর্তীতে এর পরিবর্তে প্রিন্সিপাল পদের সৃষ্টি করা হয়) হিসেবে দায়িত্ব পেলেন এম জে ব্রামলে। ১৯ জানুয়ারি, ১৮৩৭-এ ব্রামলের অকাল মৃত্যুর পরে প্রিন্সিপাল পদটি পরিবর্তিত হল সেক্রেটারিতে। প্রথম সেক্রেটারি হলেন ডেভিড হেয়ার। বেশ কয়েক বছর পরে আবার প্রিন্সিপাল পদের পুনঃপ্রবর্তন হয়।
বেঙ্গল সিভিল অর্ডার নম্বর ৩, ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৭-এ নতুন কিছু শিক্ষক এবং শিক্ষার শাখা যুক্ত হল। অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন সি সি এগার্টন সার্জারি এবং ক্লিনিক্যাল সার্জারির প্রফেসর হিসেবে, সার্জন নাথানিয়েল ওয়ালিচ (যিনি বোটানিক্যাল গার্ডেনের সুপারিন্টেনডেন্ট ছিলেন) প্রফেসর অফ বোটানি, অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন টি চ্যাপম্যান ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের লেকচারার হিসেবে, অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন জন ম্যাককোশ ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের লেকচারার হিসেবে, আর ও’শনেসি অ্যানাটমির ডেমোন্সট্রেটর হিসেবে, এবং ডেভিড হেয়ার সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দিলেন।
আমরা আগে দেখা দেখলাম, ২১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে যে কলেজে অ্যানাটমিক্যাল প্রিপারেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু ডিসেকশন করতে হবে একথা কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। মজার ব্যাপার, যে স্পিরিট থেকে বেন্টিঙ্ক ইংরেজি মাধ্যমে মেডিক্যাল শিক্ষা দেবার যৌক্তিকতা বুঝতে পেরেছিলেন, সে স্পিরিট থেকেই ২৮ জানুয়ারি, ১৮৩৫-এর ঐতিহাসিক সরকারি ঘোষণার দুদিন আগে ২৬ জানুয়ারি, ১৮৩৫-এ নিজে মেডিক্যাল শিক্ষার ওপরে একটি নোট তৈরি করেছিলেন। এতে সরকারি ঘোষণার অনেকগুলো ধারাই ছিল। কিন্তু শেষ ধারা ১৪ নম্বরে সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন – “That all the foundation pupils be expected to practise human dissection and perform operations upon the dead body, or be discharged.” (Philips, Correspondence, vol. 2, পৃঃ ১৪০৩)। মোদ্দা কথা হল, ডিসেকশনকে বাধ্যতামূলক করা হল। এবং এ শর্ত রাখা হল যে “হয় ডিসেকশন করো কিংবা বেরিয়ে যাও।” স্বয়ং গভর্নর জেনারেল যখন একথা বলছেন তখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত মেডিক্যাল ডিসেকশন করার ক্ষেত্রে আর কোন প্রতিবন্ধকতাই রইল না। NMI-এ ভেড়ার ওপরে করা zootomy উত্তীর্ণ হল মেডিক্যাল কলেজের cadaveric dissection-এ। এশিয়ায় মেডিক্যাল শিক্ষার নতুন ইতিহাস রচিত হল।
কিন্তু মেডিক্যাল কলেজ তৈরির সাথে সাথেই ডিসেকশন করা সম্ভব হয়নি। এর জন্য ১ ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৫ (সেদিন থেকে কলেজের পঠনপাঠন শুরু হয়) থেকে ২৮ অক্টোবর, ১৮৩৬ অব্দি অপেক্ষা করতে হয়েছে। এসময়ের মধ্যে ছাত্রদের auditory, ocular, verbal, psychic এবং moral acculturations-এর মধ্য দিয়ে নতুন মানুষ হিসেবে গড়ে নিতে হয়েছে। ইউরোপীয় পদ্ধতিতে মেডিক্যাল শিক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত করে নিতে হয়েছে। ইউরোপীয় পদ্ধতিকে internalize করতে শিখতে হয়েছে ছাত্রদের।
বেন্থামের যে প্যানপ্টিকনের কথা বলেছিলাম (একটু স্থুল করে বললে সবাই রাষ্ট্রের নজরদারিতে থাকবে) মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা সেই প্যানপ্টিকনের আওতায় চলে এল।
মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার বেশ কিছুদিন পরে জন ক্লার্ক মার্শম্যান তাঁর The History of India (vol. 3, 1867)-তে বলছেন – “The most eminent medical officers in the service were placed in professors’ chairs; a library and a museum were established … Natives of high caste were found to resort freely to the dissecting room, and to handle the scalpel with as much indifference as European students.” (পৃঃ ৬৮-৬৯)
মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার মাসখানেকের মধ্যে ১৮৩৫ সালের মার্চ মাসে বেন্টিঙ্ক ইংল্যান্ডে ফিরে যান। ১৮৩৬ সালে পরবর্তী গভর্নর জেনারেল হয়ে আসেন অকল্যান্ড। এখানে গভর্নর জেনারেলের দায়িত্বে ছিলেন ১৮৪২ অবধি। ফলে মেডিক্যাল কলেজের গুরুত্বপূর্ণ সময়ের বৃদ্ধি ও বিকাশ অকল্যান্ডের শাসনকালের সাথে যুক্ত।
আমরা পরের কিস্তিতে অকালপ্রয়াত প্রিন্সিপাল ব্রামলের অসমাপ্ত রিপোর্ট নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করবো। সেখানে পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসের এই বহুস্তরায়িত চিত্রের সন্ধান পাবো।
NMI থেকে CMCতে উত্তরণ এবং ভারতীয় চিকিৎসার ইতিহাসে সুনির্দিষ্ট নতুন যুগের যে শুরু ১৮৩৪ সালে তার বিবরণী চমৎকার লিপিবদ্ধ করেছেন লেখক ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য। শুরুতে সাহেবী স্বার্থ সংরক্ষণ করার চেষ্টা তো থাকবেই। কিন্তু ব্রিটিশ রাজের এই প্রচেষ্টা অবশ্যই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতেই হবে। অবশ্যই ভারতীয় সমাজ সমৃদ্ধ হয়েছেন এবং হচ্ছেন আজও।
মেডিকাল কলেজের বিভিন্ন অলিন্দে ঘোরাফেরা করলে আজও শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়ে যায়। পরের কিস্তির জন্য আগ্রহে অপেক্ষা করছি।
ধারাবাহিক এই লেখাটি ভারতীয় চিকিৎসার ইতিহাসে এক মুল্যবান দলিল হয়ে থাকবে। অসাধারণ ।
ধারাবাহিক এই লেখাটি ভারতীয় চিকিৎসার ইতিহাসে এক মুল্যবান দলিল হয়ে থাকবে। অসাধারণ।
Dear Jayanto — went trough your latest essay several times — but it requires even deeper introspection.Obviously your discursive presentation is entirely different from all other researchers in this field — a few that I know off. Bentham and Bentinck have come out to us in total different colour spectrum in your well researched paper — to tell honestly — in quite a bit of “revelations”.Next time I am in London — hope to visit Bentham’s Preserved Body. It reminds me of Prof. J.B.S Halden’s (One of Founding Father of Population Genetics) embalmed body in Rangaraya Medical College in Kakinada, Andhra Pradesh. As an “aside”– William Bentinck”– while at Madras had to face a Court Martial proceeding — for his poor handling of ” Vellore Fort — EEIC’s Native Indian Army Brigades armed rebellion/mutiny — in 1805 — the first such incidence in Colonial India. I brought this here as ‘aside’–because their is much of ignorance among us in Bengal about happenings in 19th. century India. He was sent on punishment postings in war ravaged Sicily to subdue some such happenings -amongst — British troops in chaos of Post Napoleonic war. Coming back to main body of the essay — your well argumentative portrayal stands in variants to the pictures we get through Seema Alvi ,Poonam Bala or even Pandya’s write up on Grant Medical College of Bombay — and veers close to David Arnold. Big Kudos to your multi variant essay. Keep going — Regards — n.da
আমার আন্তরিক ধন্যবাদ গ্রহণ করুন, নির্মাল্যদা!
commendable and highly informative. Style is distinctive with didactive semiotic not seen usually elsewhere. — nirmalyada
Dear Jayanta — the scenario of opposition to the establishment of a classical western medical institute in colonial Calcutta was not seen in the same intense in Madras or Bombay. Madras presidency and Bombay presidency were equally famous for their indigenous Indian Medicine system — for Ayurveda ,Siddha and Unani Tib traditional medicines. Can you throw the special reasons — the way Ram Comal Sen and the then Bhdralok Semaj initially tried their best to thwart off the plan of dismantling NMI and replacing it with a full fledged Western type Medical School ? They brought up the case of SUSHRUTA SAMHITA to counter the western assertions of deficiency in Anatomical knowledge and Surgical inefficiency in native medical practices. Anyway your dedicated approach to the subject is nonpareil…..n.da