ছবিটি বেবির। বস্তিবাসী বেবী, তার প্রসব যন্ত্রণা লাঘবের জন্য এমন ভাবে কাপড়ের দড়ি টাঙিয়েছেন ঘরের মধ্যে। প্রসব যন্ত্রণা যখন বাড়ছে সেই দড়ি ধরে জোরে টেনে দাঁতে দাঁত চিপে যন্ত্রণা সহ্য করছেন। সেইসঙ্গে নিজের ইউটেরাসে চাপ দিয়ে বাচ্চা বের করার চেষ্টা চলছে। আজকে ব্রেস ব্রিজের ইন্দিরা পল্লী ভিজিটে গিয়ে বেবির এই অবস্থা দেখলাম। না, এই এলাকায় এটা নতুন ঘটনা নয়, ইন্দিরাপল্লীতে এমনভাবে বাড়িতে বাচ্চা হওয়াটা নিয়মিত ব্যাপার। জায়গাটা খাস কলকাতাতে হয়েও হোম ডেলিভারির একটা পকেট।
ইন্দিরা পল্লী বস্তির বেবির বয়স প্রায় ৩০-এর কাছাকাছি। এর আগে চারটি সন্তান হয়েছে তার। ১৫ বছরের বড় সন্তানটি মৃত। হাসপাতাল থেকে ২৪শে ডিসেম্বর তার প্রসবের ডেট দেওয়া হয়েছিল। পূর্ণ গর্ভিণী বেবির গত রবিবার রাত থেকে জল ভাঙছে, কিন্তু স্বামী তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে নারাজ । কারণ হাসপাতালে নিয়ে যেতে অনেক হ্যাপা। আবার খরচো বটে। তার চেয়ে বউ বাড়িতেই খালাস হবে (বাচ্চার জন্ম দেবে)। হাসপাতালে নিয়ে গেলে আবার ছোট অন্য দুইজন বাচ্চাকে কে দেখবে? বাচ্চা বাড়িতে হলে কোথাও যেতেও হবে না আবার টাকা-পয়সাও খরচ হবে না। রেললাইন পার করে রাস্তা, গর্ভবতী স্ত্রীকে গাড়ি ডেকে হাসপাতলে নিয়ে যেতে এখন অনেক টাকা খরচ। আমাদের মবিলাইজার মেয়েরা অনেক বলে কয়ে হাসপাতালের কার্ড করিয়েছিল, যাতে বেবি হাসপাতালে প্রসব করতে পারে, তাহলে সে এবং তার সন্তান জন্মের পর প্রথম টিকা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় ওষুধ, চিকিৎসাগুলি পাবে। ইন্দিরা পল্লী থেকে সবচেয়ে কাছে বিদ্যাসাগর হাসপাতাল। সেখানে যাওয়ার জন্য মেন রোড থেকে সরাসরি বাস নেই, ট্যাক্সি বা অন্য কোন গাড়িই ভরসা। তাই ঘরের মধ্যেই এই বন্দোবস্ত তাদের।
ঘটনাটা দেখার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা চেষ্টা করতে লাগলাম বেবীকে কিভাবে হাসপাতালে পাঠানো যায়! ওই এলাকা কলকাতা পুরসভার ৮০ নম্বর ইউ পি এইচ সি র (প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র) অন্তর্গত। সেখানে প্রসব করার মতো পরিকাঠামো তো নেইই, সেই সঙ্গে ওই বস্তির জন্য কোন আশাকর্মী বরাদ্দ না থাকায় আমরা তাদের কোন সাহায্য পাবো না। আবার জেলার ১০২ নাম্বার ডায়াল করে অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবাও কলকাতায় চালু নেই, তাই ওদিকটাও বন্ধ।
আমরা ওনার স্বামীর উপর চাপ তৈরি করার জন্য আশেপাশের প্রতিবেশীদের জনমত তৈরি করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু দেখলাম তারাও মনে করছেন যেহেতু স্বামীর হাতে বেশি টাকা পয়সা নেই তাই বাড়িতে হয়ে যাওয়াই ভালো। তেমন হলে আশেপাশে বাচ্চা ধরার দাইমা আছেন কিংবা এমন নাকি বাবাজীও আছে, যে ফু দিয়েই প্রসব যন্ত্রণা ঠিক করে দিতে পারে। আমরা বেবিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
আমার আজকের এই ঘটনাটা ফেসবুকে বলার কারণ দুটো। প্রথমটা আমাদের স্বাস্থ্য পরিষেবার বাস্তব অবস্থা এবং দ্বিতীয়টা লিঙ্গ বৈষম্য।
লিঙ্গ বৈষম্য আছে, সবাই মোটামুটি সেটা জানে। কিভাবে সেটা সংখ্যালঘুর ক্ষতি করে সেটা বোঝানোর জন্যই এই ঘটনাটার উল্লেখ। আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হন পরিবারের বউরা। তারা বংশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যম হলেও তাদের স্বাস্থ্যই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত হয়। পরিসংখ্যান বলছে স্বাস্থ্যপরিষেবার সুযোগ গ্রহণে বাড়ির বউরাই সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে আছেন। এবং সেটা সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই সমানভাবে বর্তমান। ইন্দিরা পল্লীতে বসবাসকারী এই দিন আনা খেটে খাওয়া পরিবারের বউটির মতনই অবহেলিত হন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের যেকোনো স্ত্রী বা কোন উচ্চবিত্ত পরিবারের গৃহবধূ। বাড়ির পুষ্টিকর খাবারে তার অধিকার সবচেয়ে কম (মায়েরা নিজের মুখের খাবারও অন্যকে তুলে দেন), বিশ্রাম নেওয়ার অবসর সবচেয়ে কম (সারাদিন তো ঘরেই থাকো, কি যে করো?)। এমনকি নিজের স্বাস্থ্যের দিকে গুরুত্ব দেওয়ার অধিকারটাও সবচেয়ে কম। ( আজ হঠাৎ বাড়িতে গিয়ে বলুন তো, কাল থেকে আপনি জিমে যাবেন, দেখুন কি হয়?) এবং বছরের পর বছর এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা টিকে থাকে। কারন তাঁরা নিজেদের উপর হয়ে চলা এই বঞ্চনা বা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। তারা এখনো নিজেরা নিজেদের স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। (বাড়ির বউদের রোগ ধরা পড়ে সবচেয়ে শেষে, যখন সেটার অবস্থা বেশ গুরুতর হয়।) তার হয়ে বাড়ির অন্য কোন সদস্য তো আরো ভাবেন না। (কারণ মেয়েরা ঘর চালাবে সেটাই নিয়ম) পরিবারকে চালানোর গুরুদায়িত্বের বোঝা খুব সুচারুভাবে সমাজ মেয়েদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে। ভালো বউ, ভালো মেয়ে এই সব কিছুর তকমা পেতে এখনো মেয়েরা মরিয়া। সমাজের দৃষ্টিতে মেয়েরা এখনো সন্তান উৎপাদন করে সম্পত্তির মালিকানা বজায় রাখার ভবিষ্যৎ তৈরি করবেন। অথচ তারা সম্পত্তির মালিকানা দাবি করতে পারবেন না। তারা বাড়ির কাজকর্ম দেখবেন কারণ এই বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে পরিবারতান্ত্রিক (পিতৃতান্ত্রিক) কাঠামোটাকে বজায় রাখতে হবে। তাইতো সবাই লক্ষ্মীমন্ত্ মেয়ের খোঁজ চালায়।। অর্থাৎ সে ঘরে থাকবে, সবার দেখাশোনা করবে, অন্যের ইচ্ছেয় চলবে, তাদের নিজেদের সিদ্ধান্তগুলিও অন্যেরা নেবে। তাইতো মেয়েদের বেড়ে ওঠার মধ্যে দিয়েই তাদের ইচ্ছে গুলোকেও এমন ভাবে পাস কাটিয়ে যাওয়া হবে যাতে তার প্রতি হয়ে চলা এইসব শোষণ ও বঞ্চনাকে সে চিনতে পারবে না। রূপকথা বা ঠাকুরমার ঝুলির মতো লৌকিক জীবনের গল্পগুলিতেও মেয়েদের এমন দৃষ্টান্তই তুলে ধরা হয়েছে। দুখু কারো কথা শোনে না নিজের ইচ্ছায় চলে তাই সে সুখুর চেয়ে কম ভাগ্যবতী। তার গা ভর্তি সোনা, তার সোনার বরন রূপ, তার বিয়ে হচ্ছে রাজপুত্রের সঙ্গে। আর দুঃখু অন্যের কথা শোনে না তাই সে কুরূপা, তার স্বামী ব্যাঙ।
মেয়েরা কমনীয় এবং পুরুষের চেয়ে দুর্বল চেহারার হলে পরিবারের পক্ষে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সোজা।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজ যুগ যুগ ধরে মেয়েদের এইধরনের চরিত্র এবং চেহারার এই কাঠামোকেই লালিত করেছে। ফলে “সারভাইভাল অফ ফিটেস্ট” এই তথ্য মেনে প্রাকৃতিকভাবেই মেয়েরা ক্রমশ কমনীয় নরম সরম হয়ে উঠেছে।
একই সঙ্গে ভয়াবহ ও হৃদয়বিদারক।