পুরো স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার ভিত নড়ে গেছে। অথচ রোগ-বালাইয়ের খামতি নেই। করোনা ছাড়াও আরও অগুনতি রোগ বহাল তবিয়তে আছে। অনেকেই বাইরে বেরিয়ে ডাক্তার দেখাতে পারছেন না বা সাহস করে উঠতে পারছেন না। তাঁদের অসহায়তার কথা ভেবে এই লেখা। শিশুদের সাধারণ কিছু সমস্যার বাড়িতে রেখেই প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যাপারে জেনে নেবো…
১. জ্বরঃ
জ্বর কোনও রোগ নয় বরং রোগের উপসর্গ। বাড়িতে শুধু উপসর্গের আরাম দেওয়া সম্ভব। বগলের তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপরে হ’লে জ্বরের ওষুধ (প্যারাসিটামল) দিন। প্রতি কেজির জন্য ১৫ মিগ্রা হিসেবে দিন। অর্থাৎ, ১০ কেজির বাচ্চাকে ১৫০ মিগ্রা প্যারাসিটামল দিতে হবে। বাজার চলতি প্যারাসিটামল সিরাপের প্রতি ৫ মিলিতে সাধারণত ১২০ মিগ্রা/ ১২৫ মিগ্রা/ ২৫০ মিগ্রা ওষুধ থাকে। সেই হিসেবে ১০ কেজি বাচ্চার জন্য (১২৫ মিগ্রা/ ৫ মিলি) সিরাপের ৬ মিলি কিংবা (২৫০ মিগ্রা/ ৫ মিলি) সিরাপের ৩ মিলি দিতে হবে। একইভাবে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট ভেঙে জলে মিশিয়ে খাওয়াতে পারেন। জ্বর দেখে প্যারাসিটামল সারাদিনে ৫-৬ বার অব্দি দেওয়া যেতে পারে। বেশি জ্বর এলে স্বাভাবিক তাপমাত্রার জলে ভালো করে গোটা গা মুছিয়ে দিন। বরফ জল ব্যবহার করবেন না। জ্বরের বাচ্চা স্বাভাবিক ভাবেই স্নান করবে, ভাত খাবে। বেশি করে জল খাওয়াবেন। (কিছু পরীক্ষামূলক স্টাডিতে হুড়মুড়িয়ে জ্বর না কমানোর কথা বলা আছে। জটিলতার কথা ভেবে এ লেখায় সে ব্যাপারে আলোচনা করবো না)। জ্বরের ওষুধ হিসেবে আইবুপ্রোফেনও ব্যবহার করা যায়। তবে সেটা ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া না করাই ভালো। শুধু জ্বরের জন্য অ্যাসপিরিন, মেফেনামিক অ্যাসিড ইত্যাদি ওষুধ ব্যবহার করবেন না।
২. সাধারণ জ্বর তড়কাঃ
জ্বর-তড়কা মৃগীরোগ নয়। ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী বাচ্চাদের জ্বরের সাথে খিঁচুনি বা জ্বর-তড়কা একটি খুব সাধারণ রোগ। জ্বরের সাথে হাত-পা শক্ত হয়ে যায়, চোখ উল্টে যায়, মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোতে থাকে, নিজে থেকে পেচ্ছাব-পায়খানা হয়ে যেতে পারে। যদিও বাড়ির লোকেদের জন্য এটি খুবই ভীতিপ্রদ কিন্তু আসলে রোগটা বেশ নিরীহ। সাধারণত এর জন্য মাথার ক্ষতি বা বুদ্ধিবিকাশে সমস্যা হয় না। জ্বর-তড়কার জন্য জ্বরের মাত্রা তত গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং জ্বর কত দ্রুত বাড়ছে সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তড়কার সময় শান্ত থাকুন। বাচ্চা শুয়ে থাকলে কাঁধ থেকে মাথাটা উঁচু করে ধরে রাখুন। গা-মুছিয়ে দিন। দাঁত লেগে গেলে ছাড়ানোর চেষ্টা করবেন না। (কিছু কিছু জ্বর তড়কা খারাপ হয়। যদিও তার সংখ্যা খুব কম। এখানে সে ব্যাপারে আলোচনা করবো না)। কখনও মাথার ইনফেকশনের জন্যও এরকম জ্বরের সাথে খিঁচুনি হ’তে পারে। সে ব্যাপারে চিন্তার ভার আপনার চিকিৎসকের ওপরেই ছেড়ে দিন। সাধারণ জ্বর-তড়কা ২৪ ঘন্টার জ্বরে সাধারণত একবারই হয়। একাধিকবার তড়কা হ’লে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে যান।
৩. পাতলা পায়খানাঃ
এই লেখায় আমরা হঠাৎ করে শুরু হওয়া পাতলা পায়খানা নিয়ে আলোচনা করবো। শিশুদের অধিকাংশ পাতলা পায়খানা ভাইরাসঘটিত। জনশূন্যতা রোধ করাই মূল লক্ষ্য। জলশূন্যতা হ’লে বাচ্চার চোখ বসে যাবে, চোখের জল কমে যাবে, মুখ-জিভ শুকিয়ে যাবে, তেষ্টা বাড়বে, পেচ্ছাব কমে যাবে এবং হলুদ হয়ে যাবে, পেটের চামড়া টেনে ছেড়ে দিলে অনেক দেরি করে আগের অবস্থানে ফিরে আসবে। মারাত্মক জলশূন্যতায় বাচ্চা সম্পূর্ণভাবে নেতিয়ে পড়ে, জল খাওয়ার ক্ষমতাও চলে যায়। বেশি জলশূন্যতার চিকিৎসা হাসপাতাল ছাড়া করা সম্ভব নয়। জলশূন্যতা না থাকলে বাড়িতেই ও আর এস দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা যায়। বাচ্চা যতবার পাতলা পায়খানা করবে ততটা পরিমাণ ও আর এস খাওয়াতে হবে। মোটামুটি ভাবে সেটা প্রতি কেজিতে ৫-১০ মিলি হয়। অর্থাৎ, ১০ কেজি বাচ্চার প্রতিবার পাতলা পায়খানার জন্য ৫০-১০০ মিলি ও আর এস লাগবে। WHO ও আর এস ছাড়াও বাড়িতে এক গ্লাস (২৫০ মিলি) জলে দেড়-দু’চামচ চিনি, তিন আঙুলের এক চিমটে সাধারণ নুন, আধখানা পাতিলেবু দিয়ে ও আর এস বানানো যায়। ডাবের জল, ডালের জল, ভাতের পাতলা ফ্যানে নুন মিশিয়ে খাওয়ানো যায়। নুন নেই এমন তরল যেমন ফ্রুট জুস, বিভিন্ন কোল্ড ড্রিংকস, শুধু গ্লুকোজ ইত্যাদি খাওয়াবেন না। বেশি জলশূন্যতা দেখা দিলে, পায়খানার সাথে রক্ত এলে, বারবার বমি হ’লে ডাক্তারের কাছে যান। লোপেরামাইড জাতীয় চট করে পায়খানা বন্ধ করার ওষুধ দেবেন না। ওফ্লক্সাসিন-অরনিডাজোল, ওফ্লক্সাসিন-মেট্রোনিডাজোল, সিপ্রোফ্লক্সাসিন-মেট্রোনিডাজোল ইত্যাদি খিচুড়ি অ্যান্টিবায়োটিক অযৌক্তিক। যদিও ওষুধগুলি আলাদাভাবে উপসর্গ অনুযায়ী এক-একটি ব্যবহার করা যায়। ডাক্তার না দেখিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক দেবেন না।
৪. সাধারণ কাশিঃ
এক্ষেত্রেও বেশিরভাগ ভাইরাস ঘটিত। বেশি করে জল খাওয়ান। নাক বন্ধ হ’লে নর্মাল স্যালাইন নাকের ড্রপ দিন। একটু বড় বাচ্চাদের নুন-জলে গার্গল করান। মাথায় গামছা ঢেকে গরম জলের ভাপ টানান। কাশি খুব বাড়লে বা শ্বাসকষ্ট হ’লে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। যাদের আগে থেকেই ইনহেলার নিতে হয় তাদের ইনহেলার শুরু করে দেওয়াই ভালো। তারপর চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ইনহেলারের ডোজ ঠিক করুন। কিছু বিরল রোগী ছাড়া কাশি বন্ধ করার বা শ্বাসনালী শুকিয়ে দেওয়ার ওষুধ (ক্লোরফেনিরামিন, ফিনাইলএফ্রিন, কোডিন, প্রোমেথাজিন, ডেক্সট্রোমেথোরফেন জাতীয় ওষুধের কম্বিনেশন) দেওয়া উচিত নয়।
৫. শিশুদের কোভিডঃ
এ ব্যাপারে আগেই বিস্তারিত ভাবে লিখেছি। কমেন্ট বক্সে লিংক রইলো।
বি. দ্র.-এগুলোকে শুধুই প্রাথমিক ঘরোয়া চিকিৎসা হিসেবে নিন। কখনও সন্দেহ হ’লে অবশ্যই বাড়ির পাশের হাসপাতাল বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।