আমার এক তরুণী সহকর্মীর মৃত্যুর পরে পরিচিত মহলে দুটি কথা খুব বেশি করে ঘোরাফেরা করছে। তাদের জন্য এই লেখা। কেউ কেউ বলছেন, তরুণী চিকিৎসক-অধ্যাপক চাকরি ছেড়ে দিল না কেন? এর উত্তরে এটাই বলা যায় যে চাকরি ছেড়ে দেয়াটা সহজ পথ। ওই মেয়েটি হয়তো আমার মতো ছিল যে সরকারি সিস্টেমের মধ্যে থেকে মানুষের জন্য কিছু করতে চেয়েছিল তাই সে নিজের যোগ্যতাবলে অর্জিত ওই চাকরিটি ছেড়ে দিতে চায় নি। সে আমার মতোই হয়তো “আশাবাদী বোকা” ছিল যে মনে করতো সিস্টেম তার প্রতি একদিন সুবিচার করবে। সে জন্যই চাকরি ছেড়ে দিয়ে সমস্যা সমাধানের পথ সে খুঁজে নিতে চায় নি।
দ্বিতীয় যে প্রশ্নটা উঠে আসছে সে কেন আত্মহননের পথ বেছে নিল। এর উত্তরে বলবো, কে কোন অবস্থায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় সেটা বলা খুব মুশকিল। অন্যের কথা জানি না, ওই তরুণী জনস্বাস্থ্যের অধ্যাপিকা মেয়েটি আমার একদমই অপরিচিত তাই নিজের কথাই কেবল বলতে পারি।
আমি নিজে গত ছয় বছর ধরে বাড়ির বাইরে। আরো কতদিন থাকতে হবে কে জানে। জার্সির রং না বদলালে হয়তো বাকি কর্মজীবনটাই। এই সময়টা ধরে ছোট ছেলেটা ক্লাস এইট থেকে ফার্স্ট ইয়ার হয়ে গেল। তার জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টা আমার বাইরে বাইরেই কাটলো। নিজের চাকরি সামলে, সংসার, ছেলে মানুষ করা – সবটাই আমার স্ত্রী একা হাতে সামলালো। এখন মাঝে মধ্যে সে বলে যে আর পারছে না, ক্লান্ত হয়ে যায়। বয়েস বাড়ছে তো। আমি মাসে একবার সপ্তাহ অন্তে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি পাই। প্রতিটা ছুটির দিনে ও। প্রায় সব উৎসবের দিনে গ্রামের নিরানন্দ মেসবাড়িতে পরে থাকতে হয়। কাজের জায়াগায় আনন্দের সাথে উপরি পাওয়া হল বড় মেজ সেজ কুচি রাজনৈতিক নেতাদের মাতব্বরি, তাদের স্বার্থে আঘাত লাগলে হুমকি, অকথ্য গালাগালি। স্রেফ গায়ে হাত পড়াটাই বাকি আছে। তিনটে পদের দায়িত্ব সামলাতে হয় কোনো অতিরিক্ত পারিশ্রমিক ছাড়াই।
দুদিন বাদে পুজো আসছে। গত পুজোগুলোর স্মৃতি ভিড় করে আসছে। বাইরে পুজোর ঢাকের শব্দ হয়, আমি একা নির্জন মেসবাড়িটায় ছাদে ভুতের মতো বসে থাকি। ছাদের পাঁচিলটা খুব একটা উঁচু নয়। গাড়িটা মাঝে মধ্যে কোনো এক অমোঘ আকর্ষণে খাদের দিকে এগিয়ে যেতে চায়। যন্ত্রণার হয়তো শেষ হয়ে যাবে সহজে। শেষ মুহূর্তে তাকে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে সরিয়ে আনতে হয় কোনো এক অদৃশ্য টানে। হয়তো কোনও একদিন স্টিয়ারিং আর ঘুরবে না।
এর পরে ফেসবুকে, আলোচনায় হয়তো অনেকেই লিখবে, সমুদ্র/ সমুদ্রদা লোকটা ভালো ছিল কিন্তু বড়ই বোকা ছিল। কেন চাকরিটা ছেড়ে দিল না। ভালো ছিল কিন্ত মনের জোর ছিল না, কেন ওই পথ বেছে নিল – ইত্যাদি ইত্যাদি আফসোস।
সিস্টেম যদি না পাল্টাতে পারি, এমন আফসোস আমাদের আবার করতে হবে, বারবার করতে হবে। একদিন পাল্টাবে, আমরাই পাল্টাবো এই আশায় টানেই স্টিয়ারিংটা ঘুরে যাচ্ছে এখোনো। কিন্তু কতদিন ঘুরবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই।
সুন্দর!