দিদিমণির গল্পের আসরে তাঁর টোটোভ্রমণের গল্প শুনছিলাম। টোটোভ্রমণ না বলে তীব্র হর্নের ডানায় ভর করে এক টোটোউড়ানই বলা যায় তাকে।
দিদিমণির টোটোভ্রমণের গল্পয় আমার নিজের দেখা অনেক কটা গল্প একসঙ্গে মনে পড়ে গেল। আর স্মৃতির স্লুইস গেট খুলে গেলে সে এক বেজায় ম্যানমেড বন্যা। ঠেলাঠেলি করে বেরোতে চায় সব। এই গল্পের মাথায় পা দিয়ে বেরোতে চায় ওই গল্প। এ এক বেজায় ঝামেলা।
আমাদের বালক বেলায় সবে উড়তে শেখা মধ্যবিত্ত যুবকদের কেউ কেউ স্কুটার কিনত। এই আমলের শৌখিন ডাকনামের স্কুটি না। পুরোদস্তুর স্কুটার। তখন আবার স্কুটার কিনতে লাইন দিতে হত। ডিলারের কাছে নাম লিখিয়ে কয়েক মাসের অপেক্ষা। সেই সব অপেক্ষা করেটরে পাড়ার নকুলদা একটা স্কুটার কিনল। ভেস্পা কোম্পানির। তার আগে চালানো শিখেছিল বন্ধুদের এর ওর স্কুটার ধার করে।
নিজের স্কুটার চালানোর শুরু থেকেই, আশ্চর্য একটা কাজ করত সে। অবিরত হর্ন বাজাতে বাজাতে চালাত ওর পক্ষীরাজ। হর্ন বাজত বিশেষ একটা রিদমে। প্যাঁপ্প্যা প্যাঁ… প্যাঁপোর প্যাঁ… প্যাঁপ্প্যা প্যাঁ… প্যাঁপোর প্যাঁ এই রকম। পাড়ায় সেই রকম রিদম শুনলেই আমরা বুঝতাম, নকুলদা স্কুটারে। হয় বেরোচ্ছে নয় ফিরছে। অনেকে আবার সেই আওয়াজ শুনে ঘড়ি মেলাত। নকুলদা ছিল বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে।
বেশ কয়েক বছর পর আমরা একটু বড় তখন, একদিন নকুলদাকে চেপে ধরলাম। ‘তোমার এই কনস্ট্যান্ট হর্ন বাজানোর রহস্যটা কী? বলতেই হবে!’
দাদা লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, ‘তোরা তো জানিস, আমি বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে। জানিস না?’
‘তাতে কী?’
‘আরে, মা তো কিছুতেই স্কুটার কিনতে দেবে না। কে নাকি মাকে বুঝিয়েছে শয়তানের চাকা!’
‘তার জন্য ওই সর্বদা প্যাঁপোর প্যাঁপোর?’
‘তার জন্যেই তো। তোরা শুনিস প্যাঁ প্যাঁ আওয়াজ। আমার মা শোনে, ছেলের স্কুটারের হর্ন বলছে, আছি গো আছি, টিঁকেই আছি।’
তারও কয়েক বছর পর দাদার মা মারা গেলেন। নকুলদা একলা মানুষ। বিয়েটিয়ে করেনি।
সে এখনও সেই রকমই সশব্দে স্কুটার চালায়। বিয়ে করলে না হয় বুঝতাম, বউদিকে জানান দিতে হর্ন বাজায়।
সেই আমরাই ফের বললাম, ‘নকুলদা জ্যেঠিমা তো নেই। এখনও কেন তবে?’
নকুলদা ফ্যাকাশে হেসে বলল, ‘ নেই মানে বাড়িতে নেই। কিন্তু আকাশে বাতাসে মিশে আছে তো! তাই আগের চাইতেও মন দিয়ে হর্ন বাজাতে হয়।’
নকুলদার গল্পের পরেই ঝাঁপিয়ে পড়ল অমিতের গল্পটা। আমার বন্ধু কলকাতার বড়বাজারের ছেলে অমিত। যাদবপুর আর বেঙ্গালুরুর আইআইএসটি হয়েটয়ে নরওয়ে না সুইডেন কোথায় যেন… এখনও বাইরেই থাকে।
তো সেবার দেশে ফেরার পর আমাদেরকে বিদেশ বাসের অভিজ্ঞতা গল্প করে বলেছিল। এমনিতে বিরাট ফাজিল টাইপের ছেলে। নিজেকে নিয়ে মজা করতে ভালোবাসে খুব।
শুনেছি বিরাট বৈজ্ঞানিক সে। ওই ঈশ্বর কণাটনারও পরের বিষয় কীসব যেন।
আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে শুধোলাম, ‘হ্যাঁ রে, এদেশে তো কেউ তোকে নিয়ে মাতামাতি করে না। তা ওদেশে?’
বলল, ‘না, ওখানেও তেমন কিছু নয়। আমাদের ইনস্টিট্যুটেই তেরোজন নোবেল পাওয়া লোক। কে আর আমাকে নিয়ে … হুঃ! ওই একবারই খালি আমায় দেখতে ট্রাফিক জ্যাম মতন হয়ে গেছিল!’
আমরা আঁতকে উঠে বললাম, ‘ট্র্যাফিক জ্যাম? মানে আমাদের এখানে উত্তম কুমারকে দেখতে পেলে যেমন হত? বলিস কী!’
লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, ‘প্রথম দিকে, বুঝলি তো, সবে গেছি তখন। রাস্তায় গাড়ির ভিড় থাকে না এমনিতে। সেদিন অন্য দিনের তুলনায় তাও একটু বেশি। আমারও সেদিন খুব তাড়া। ভুল করে বারবার হর্ন বাজিয়ে সামনের গাড়িটাকে সাইড দিতে বলেছি, এদেশে যা করতাম। কী বলব মাইরি, সারি সারি গাড়ি হর্ন শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল। সবাই গাড়ির দরজা খুলে সেই কনকনে ঠাণ্ডায় ভিড় করে নেমে এসেছে। সবাই দেখতে চায়… কে এই নিস্তব্ধতা ভঙ্গকারী মহাপাতক!’
বাড়িয়ে বলছে বুঝলাম। তবে এটাও বুঝলাম, অকারণে তো বটেই, এমন কী কারণেও হর্ন বাজানো বেশ আপত্তির ওই সব দেশে।
তবে হর্নের কথাই যখন উঠল আরও যা দেখেছিলাম আমার ছেলেবেলায়, সেটাও কম উল্লেখযোগ্য নয়। মামাবাড়ি গেছি। সেখানেই দেখেছিলাম। হর্ন ফিট করা গরুর গাড়ি। ইলেকট্রিক হর্ন না। রবারের… টিপে বাজাতে হয়, সেই ভেঁপু। সেই গঞ্জের খামারুদের বড়কর্তা মারা যাবার পর সম্পত্তির ভাগ বাঁটোয়ারা হয়েছে। একেবারে চুল চেরা। পুরোনো আমলের একটা জিপ ছিল বুড়ো কর্তার। সেই জিপটাও ভাগাভাগি হল। কেউ পেল টায়ারগুলো। সেই টায়ার টাঙানো দোলনায় দোল খেয়েছি আমিও। কেউ পেল লোহার খাঁচাটা। অন্য কেউ সিটগুলো। রামু কাহার, বুড়ো খামারুর খাস বেয়ারা, তাকে দেওয়া হল অচল জিপটার সেই ভেঁপু হর্ন। সেই হর্নই সে তার গরুর গাড়িতে লাগিয়ে নিয়েছিল।
এখন আমিও ওই কী বলে ভার্চুয়াল হর্ন শুনি নিত্যদিন। পেছন থেকে হর্ন বাজিয়ে তাড়া দিচ্ছে কেউ, যাও ফিনিশিং রোপটা ছোঁও গিয়ে তাড়াতাড়ি। আমি নিজেও জেদে হর্ন বাজাচ্ছি, আছি গো আছি…
এই হল সবে মিলে যাকে বলে …এক নষ্ট আর ভ্রষ্ট জীবনের হরণকথা… হর্নস অফ ডাইলেমা!