“ক্রেয়ন তুমি এই ছোটো ছোটো পাওয়াকে সুখ বলো? এর জন্য আমি আমার জীবন বিক্রি করবো? না আমি বরং মৃত্যু চাইবো। হয়তো একদিন শুনবে আমাকে দেখে সমস্ত দেশবাসী তোমার বিরুদ্ধে চলে গেছে… তুমি রাজনীতির রান্নাঘরের চর্বি নোংরা মেখে বসে আছো…তোমাদের কাছে সুখ মানে এক টুকরো হাড়, তোমার লোভী জিভ ল্বকল্বক করছে ঐ হাড়ের টুকরোর জন্যে… ক্রেয়ন এই তুচ্ছ জিনিস আমি চাই না… আমার জীবন অনেক বড়ো…”(স্বাতীলেখা এভাবেই লকলক কথাটা উচ্চারণ করেছিলেন)
সম্ভবতঃ এই হলো আন্তিগোনের ডায়ালগ-দীর্ঘ যুগান্তরে সঠিক মনে রাখা সম্ভব নয়। স্বাতীলেখার আন্তিগোনে। আমাকে আজও ভাবায়, চালায় সেই কৈশোরবেলার আন্তিগোনে।
আমার ছোটোবেলাটা কেটেছে এঁদো মফস্বলে। আমি অ্যাকাদেমি, রবীন্দ্রসদন চিনতাম না। তবুও স্বাতীলেখা, অজিতেশ, রুদ্রপ্রসাদ, মনোজ মিত্রকে চিনতাম। কল্যাণীতে নাট্যমেলা হতো। ফী বছর। নাটক প্রতিযোগিতা হতো। কৈশোরের দিনগুলোতে এই সব নাটক, সিনেমা আর বইপত্তর আমার জীবনটাকে গড়ে দিয়েছে। (যদিও প্রৌঢ় বয়সে অ্যাকাদেমিতে স্বাতীলেখার অজ্ঞাতবাস আমার একটা প্রিয়তম নাটক)
শতরঞ্চিতে বসে খড়ির গন্ডি, ‘আন্তিগোনে। গ্যালিলেই।শের আফগান।
তাই ওষুধ কোম্পানির বিদেশ ভ্রমণের ডাক এলে বলতে পারি “বিক্রি হবো। নিশ্চয়ই হবো। তবে যদি নাসার থেকে চাঁদে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন তবেই। দুদিনের ইওরোপ ব্যাড়ানোর জন্য নয়…”
ধন্যবাদ আন্তিগোনে। তুমি আমার ভাঙা মেরুদণ্ডে জোর এনে দিয়েছো। এই সব ছোটো ছোটো পার্থিব সুখের জন্য বিক্রি হতে নেই-এটা শিখিয়ে দিয়েছো। আমি অতি সামান্য মানুষ, কারো সঙ্গে আমার মতে মেলে না। তবু আমি বেঁচে আছি আন্তিগোনে-শুধু তোমার জন্য। তোমাদের জন্য।
হ্যাঁ আন্তিগোনে, খড়ির গন্ডি, গ্যালিলেই গ্যালিলিও বা নরক গুলজার আমাকে বিপরীতধর্মী করেছে। তাই আমি লিখে যাই। আগে পরিযায়ী এবং ভিক্ষা দেওয়া নিয়ে লিখেছি, স্বপ্নের দেশের স্বপ্ন নিয়ে লিখেছি। এখন চারপাশে হাসপাতালে ডাক্তারের বিল নিয়ে নানা কথা আসছে। এবারে আমি শুধু আমার ব্যক্তিগত- কেবলমাত্র একান্ত ব্যক্তিগত কিছু কথা ভাগ করে নেবো। সিদ্ধান্ত আপনাদের।
বহুকাল আগের কথা। তবে বিলগুলো এখনও সযত্নে রক্ষিত আছে। সুতরাং ফেসবুকিয় চ্যালেঞ্জ নিতে সক্ষম।
ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাস সংলগ্ন একটা হাসপাতাল। এক বৃদ্ধাকে, এক প্রৌঢ় ডাক্তার তার মাকে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য ভর্তি করেছে। বৃদ্ধা নিজে সরকারি ডাক্তার ছিলেন,সরকারি হাসপাতালের বাইরে কোনোদিন টাকা নিয়ে রোগী দ্যাখেন নি। বেঁচে থাকা একমাত্র ছেলের তৃতীয় হার্ট অ্যাটাকে ক্যাথ ল্যাবে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হওয়ার পর থেকেই অসংলগ্ন ব্যবহার করছিলেন। খাচ্ছিলেন না। একই কথা বারবার বলে যাচ্ছিলেন। বিশেষতঃ জীবিত সন্তানের শৈশবের গল্পগুলি। সেই প্রৌঢ় টেকো ডাক্তার এবং কলেজ সম্পর্কে এক ডাক্তার বৌদির তত্ত্বাবধানে। ডায়াগনসিস হলো গভীর ডিমেনশিয়া। ডাক্তার পুত্র ছুটি লিখে, ক্রেডিট কার্ড সোয়াইপ করে বিল মিটিয়ে মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো।
বিল দেখে মনটা খুঁৎখুঁৎ করছিলো। পুত্রের নামে পাঁচদিনে দশ হাজার টাকা এবং কলেজের ডাক্তার বৌদিরও তাই।মোট ডাক্তারের ফিজ কুড়ি হাজার টাকা। এছাড়া দীর্ঘদিন আইসিইউতে থাকলে যে সেন্ট্রাল লাইন করা হয় তার এবং আনুসাঙ্গিক অনেক কিছুর জন্য টাকা ধরা হয়েছে। অথচ….
কলেজের ডাক্তার বৌদিকেও ফোন করে জানা গ্যালো তিনিও কোনও ফিজ লেখেন নি।
পরের দিন হাসপাতালে যেতেই সহাস্য স্বীকারোক্তি “স্যর এগুলো আমাদের রুটিন বিলিং, আপনাকে এক্ষুণি ফেরৎ দিয়ে দিচ্ছি”। আমি আর কোনোদিন কর্পোরেট হাসপাতালে রোগী ভর্তি করি নি।
এর আগেও এই ধরণের ঘটনা এই প্রৌঢ়ের কপালে ঘটেছে।
বিল ফাইনাল করার আগে সংশ্লিষ্ট বিভাগে ঐ রোগীর দায়প্রাপ্তদের সই এবং অনুমতি নেওয়া হয় এরকমটা কোথাও শুনিনি। সব ক্ষেত্রেই ধরে নেওয়া হয় ডাক্তার দায়ী। এবং সামাজিক মাধ্যমে ডাক্তারের বিরুদ্ধে বিষোদগার চলতে থাকে। প্রায়শঃই মনে হয় আমরা মধ্যযুগে বাস করছি। নিজের হাতে আইন। নিজেই বিচারকর্তা। সওয়াল নেই, জবাব নেই, আছে সীমাহীন উদ্দেশহীন ক্রোধ।
হয়তো যাঁরা ইন-হাউস ডাক্তার তাঁরা বিলে টাকার পরিমাণ জানেন, অথবা জানেন না। তবে ছোট নার্সিং হোম (ছোটো কথাটার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী, আসলে ছোটো বড়ো বলে কিছু হয়না) প্রায় সময়েই বিলে টাকার অঙ্ক ডাক্তারকে জানিয়ে দ্যায়। শুধু তাই নয় গরীব রোগী হলে কতো টাকা ভিজিট নেবে সেটাও জেনে ন্যায়।
হয়তো কর্পোরেট হাসপাতালে ডাক্তাররা সব জানেন। মাথার ওপরের ছাতাটা সরে যাওয়ার ভয়ে কিছু বলতে পারেন না। তবে ওঁদের বাড়ির লোকের সঙ্গে একই রকম ঘটনা ঘটে, সেটা জানি।
অথচ একজন ইন্টারভেনশন অর্থাৎ অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে তো একটা কর্পোরেট হাসপাতালে থাকতেই হবে। একটা সাধারণ নার্সিং হোমে এই সবের ব্যবস্থা রাখা সম্ভব নয়। সরকারি হাসপাতালে ক’টাতে এই সবের ব্যবস্থা আছে? সরকারি ব্যবস্থায় একজন সুপার স্পেশালিস্ট ডাক্তারকে হয়তো গ্রামের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে অথবা সদর হাসপাতালে রেখে দেওয়া হচ্ছে- বছরের পর বছর, অব্যবহারে বিদ্যাহ্রাস হবেই হবে।
আবার এর জন্য প্রয়োজনীয় অপারেশন থিয়েটারের কর্মী, ক্যাথ ল্যাব, আইসিসিইউ এবং এর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ পাওয়া স্বাস্থ্য কর্মী রাখা ছোটো সেট আপে সম্ভব নয়। সির্ফ মুশকিল নহি, না মুমকিন হ্যায়। সুতরাং ডাক্তারকে যেতেই হবে ঐ সব বড়ো বড়ো হাসপাতালে। টাকাটা হয়তো প্রাথমিক প্রয়োজন তবে একমাত্র প্রয়োজন নয়। অধীত বিদ্যার প্রয়োগটাও একটা প্রয়োজন।
সুতরাং প্রতিবাদ কার বিরুদ্ধে করতে হবে?কর্পোরেটদের বিরুদ্ধে?নাকি সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি করার জন্য?
প্রশ্নটা আপনাদের কাছে।
আন্তিগোনে কিন্তু রাজার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করেছিল। আজ্ঞাবহ জল্লাদের বিরুদ্ধে নয়। খুঁজে বার করুন আপনার আসল শত্রুকে। রাজনীতির দরকার নেই। এখন রাজনীতি মানেই স্বার্থান্বেষী মানুষের জটলা। নিজেই উদাহরণ তৈরি করুন। দেখবেন রাজা ভয় পাবে। পাশে মানুষ থাকবে।
অসামান্য।
ধন্যবাদ দাদা