১৯৯৬। ডাক্তারি পাশ করে ইনটার্ন। আমরা তখন তৃণ’মূল’ কর্মী। ফুল ফোটেনি। ক্যান্টিনে বসে চা আর চপ খাচ্ছি। চপ তখনও শিল্প হয়নি। নখের কোণে রক্ত লেগে আছে। সেই সময়ে এত ডিসপোজেবল গ্লাভস চালু হয়নি। সিস্টাররা গ্লাভস সাবান জলে ধুয়ে, শুকিয়ে পাউডারে চুবিয়ে গরম ভাপে সেদ্ধ করে আমাদের দিত। মাঝে মাঝেই তাই গ্লাভসে ফুটো থাকতো। যাই হোক হাত ধুতে গেলে চপ আর থাকবে না। তাই ওই হাতেই খেয়ে নিলাম।
ইন্টার্নশিপে আমাদের কাজ ছিল Burn ward এর পেশেন্টদের ড্রেসিং করা। তাঁদের গায়ে মাঝে মাঝে সাদা maggots থাকতো। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড আর স্যালাইন দিয়ে পরিস্কার করতে হয়। দুর্গন্ধ বেরতো। কিন্তু নাকে মাস্ক থাকতো না।
২০২০। সময় বদলে গেছে। চারিদিকে ফুল আর fool এর ছয়লাপ । গ্লাভস আর মাস্ক ছাড়া কিছুই ভাবা যায় না। কোভিড-এর মতো এমন বিদঘুটে সমস্যা ডাক্তারি জীবনে আগে আসেনি। জীবন থেকে চপ হাওয়া, শুধুই চাপ- কাজের চাপ। বেঁচে থাকাই চাপের। মনের মধ্যে ভয়, ওই বুঝি ভাইরাস শরীরে ঢুকলো। বাড়িতে ঢোকালাম। অনেকে প্র্যাকটিস কমিয়ে দিয়েছেন। কারণ যত কম লোকের কাছে আসবে ততই সংক্রমিত হওয়ার ভয় কম থাকবে। আসলে ডাক্তারদের কাছে অনেকেই আসে, কিন্তু কাছের লোক খুব কম হয়। অনেকে আবার উদয়াস্ত কাজ করে যাচ্ছেন, কিন্তু গত তিন চার মাস বেতন পাচ্ছেন না। শেষ পর্যন্ত ধর্নায় বসতে হলো। চিকিৎসকরা যেন একটা দীর্ঘ অন্ধকার টানেলের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছে। যার শেষ কোথায় তারা জানে না। শুধু জানেন চলতে হবে। থামলে চলবে না।
পাশাপাশি একথাও বলা দরকার, করোনার মতো যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে প্রায় সমস্ত ডাক্তার ইতিবাচক চিন্তাভাবনা নিয়ে রোগীদের চিকিৎসা করে চলেছেন, বুকে ভয়,মুখে হাসি। কারণ একজন হাসিখুশি, সুখি ডাক্তার মানে রোগীও সুখি।
গত কয়েক মাসে দেখেছি আমাদের সহকর্মীরা কেবলমাত্র চিকিৎসা ও রোগীর প্রতি সহানুভূতির ক্ষেত্রেই নিজেদের সেরা হিসেবে পরিচয় দেননি, নিজেদের জীবনকেও অনেক সমৃদ্ধ করে তুলতে পেরেছেন। তাঁদের কারও কারও শিল্পকর্ম বা কবিতা দেখে বোঝার উপায় নেই যে তাঁরা পেশাগতভাবে এই সবের সঙ্গে যুক্ত নন। অনেক অভিজ্ঞ ডাক্তার আবার তাঁদের অভিজ্ঞতা সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করছেন। যার মাধ্যমে অনেকেই উপকৃত হচ্ছেন। এইসব গুণ তাঁদের মধ্যে আগেও ছিল কিন্তু প্রকাশের সুযোগ ছিল না। বছরের পর বছর তা চাপা পড়েই ছিল। যদিও অন্যের জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতা যে তাঁদের আসল দায়িত্ব, তাও ভোলেননি। এর জন্য অনেক সময় তাঁদের দামও চোকাতে হয়েছ্ যা গভীরভাবে ব্যক্তিগত। আমরা শুধু চিকিৎসকদের মৃত্যুর খবর রাখি, কিন্তু এই কভিডে তাদের তিনগুণ বাড়ির লোক মারা গেছেন।
কাজেই সাদা কোট পরা ব্যক্তিরা এই খারাপ সময়েও নিজেদের কিছুটা নতুন ভাবে আবিষ্কার করেছে। তাঁদের মাঝে দেওয়াল না তুলে তাঁদের আলিঙ্গন করুন। আর আমাদের সব থেকে বেশি উপকার করতে পারেন নিজেদের সুস্থ রেখে, বিভিন্ন স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলে।
কালীপুজো ভালো কাটুক।
দারুন। সবাই চাইছে আপনারাই শুধু দায়িত্ববোধ দেখাবেন।