হাত ধোয়া যখন অস্তিত্ব রক্ষার অসামান্য হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে প্রায় ১৭০ বছরের পুরনো একটা গল্প বলি।
সময়টা ১৮৪৭ এর আশেপাশে। ইগন্যাজ ফিলিপ সেমেলওয়াইজ ভিয়েনা জেনারেল হাসপাতালে কর্মরত স্ত্রীরোগ চিকিৎসক। সে সময় প্রসূতি মৃত্যুর একটা বড় কারণ ছিল প্রসব পরবর্তী জ্বর (puerperal fever)। দুটি ম্যাটারনিটি ওয়ার্ডে কাজ করতেন সেমেলওয়াইজ। সন্তানসম্ভবা মায়েদের একদিন অন্তর ভর্তি করা হত ওয়ার্ড দুটিতে। প্রথমটি ছিল স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের অধীনে। অন্যটি ছিল মূলত নার্স বা মিডওয়াইফদের তত্ত্বাবধানে। হবু মায়েরা নাকি বলতেন রাস্তায় ডেলিভারি হোক তবু এক নম্বর ওয়ার্ডে নয়। প্রথম ওয়ার্ডটিতে যে সংক্রমণজনিত মাতৃমৃত্যুর হার প্রায় তিনগুণ বেশি! প্রসবের পর প্রতি দশ জনে এক জন জ্বরে পড়ে মারা যান সেখানে।
কারণ খুঁজতে লাগলেন সেমেলওয়াইজ। তফাত হিসেবে পেলেন শুধু ওয়ার্ডটিতে মেডিকেল স্টুডেন্টদের অবাধ আনাগোনা, অবশ্যই পড়াশোনার কারণে। এই স্টুডেন্টরা আবার শিক্ষার কারণে শব ব্যবচ্ছেদও করতেন। অন্যথায় দুই ওয়ার্ডে মায়েদের মধ্যে সংক্রমণ রোধের বাকি সব ব্যবস্থা ছিল অভিন্ন। দিনে দিনে সেমেলওয়াইজের ধারণা আরও বদ্ধমূল হল। সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকের ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার উপর প্রবল জোর দিলেন তিনি। সামান্য কিছু অভ্যেস পরিবর্তন করে এক ধাক্কায় সংক্রমণজনিত প্রসূতিমৃত্যুর হার নেমে এল এক শতাংশেরও কমে।
বারংবার হাত ধোয়ার উপযোগিতা নিয়ে তিনি লিখে ফেললেন বেশ কয়েকটি পেপার। কিন্তু তাঁর ব্যাখ্যা তৎকালীন চিকিৎসকদের কাছে তেমন গ্রহণযোগ্য মনে হল না। তাঁদের অধিকাংশ তখনও সংক্রমণের কারণ হিসেবে অনিয়ন্ত্রিত কোষ্ঠ্য কাঠিন্যকেই দায়ী করতেন এবং যথেচ্ছ পরিমাণে ক্যাস্টর অয়েল জাতীয় ওষুধ খাওয়াতেন। লেগে গেল সংঘাত। ব্যক্তির বিরুদ্ধে সমষ্টি, একযোগে। গভীর বিদ্রূপের শিকার হলেন ইগন্যাজ। তীব্র ভাষায় প্রত্যাঘাতও আনলেন সমালোচকদের উপর। কিন্তু বেশি দিন পারলেন না। চলে গেলেন চরম মানসিক অবসাদে, হতাশায়। স্ত্রীর সমর্থনও হারালেন। অবশেষে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হল পাগলা গারদে। শোনা যায় রক্ষীদের শারীরিক অত্যাচারে মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যেই সেখানে প্রাণ হারিয়েছিলেন জন্মসূত্রে হাঙ্গেরিয়ান ৪৭ বছর বয়সী এই মহান চিকিৎসক বিজ্ঞানী।
কাজের স্বীকৃতি তিনি পেয়েছিলেন, তবে মৃত্যুর অনেক বছর পর লুই পাস্তুর, জোসেফ লিষ্টার ও রবার্ট কখ্ তাঁদের “জার্ম থিয়োরি” প্রতিষ্ঠিত করার পর।
কোভিড ১৯ অতিমারী রুখতে মানুষ যখন দিশেহারা, প্রতিষেধকহীনতায় সমাজ যখন অসহায়, যথাযথ হাত ধোয়াই তখন হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল প্রতিরোধী হাতিয়ার। সংকট কালে এহেন মহান চিকিৎসককে গুগল স্মরণ করলো চার দিন আগে (২০ মার্চ ২০২০) তাদের দৈনন্দিন ডুডল এর মারফত। আপনিও হয়তো লক্ষ্য করেছেন সেই ছবি।