প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবী। যুদ্ধের ঘা বিষিয়ে গিয়ে মারা যাচ্ছেন হাজার হাজার সৈন্য। সামান্য কাটাছেঁড়া মানেই মৃত্যুর ভ্রূকুটি!! প্রসূতি আর নবজাতক মৃত্যু প্রায় জলভাত। চিকিৎসা বিজ্ঞান খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে.. বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা বলতে যা বোঝায়, তা প্রায় ভবিষ্যতের গর্ভে।
এরকমই দুর্যোগের দিনে হঠাৎ অজান্তেই টুপ করে ঝরে পড়েছিল একটি অমৃত। পেনিসিলিন। সালটা ১৯২৮। বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফ্লেমিং-এর পরীক্ষাগারে স্ট্যাফাইলোকক্কাসের (ঘা, পুঁজের জীবাণু) জীবাণু ভরা কাচের পাত্রে অজান্তেই জন্মে যায় একটি ছত্রাক- পেনিসিলিয়াম। যে ছত্রাক ব্যাক্টিরিয়া-ঘাতক। পরের সময়টুকু ইতিহাস। মোটামুটিভাবে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার সূচনাকাল বলতে পেনিসিলিন আবিষ্কারকেই ধরা হয়। অ্যান্টিবায়োটিকের বলে বলীয়ান পৃথিবী ধরেই নিয়েছে সংক্রমণের যুগ শেষ হয়ে এলো প্রায়। সাথে সাথেই শুরু হয়েছে যথেচ্ছাচার। যে কোনও রোগে তো বটেই এমনকি গবাদি পশুর ওজন বাড়াতে কিংবা প্রসাধনী সামগ্রী হিসেবেও অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার শুরু হয়। ১৯৪৫ সালের এক সভায় ফ্লেমিং জনগণকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধ না করা গেলে ভবিষ্যতে সত্যিকারের প্রয়োজনের সময় অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করবে না। বাস্তবে হলোও তাই। তার পরের দশকগুলোতে ধীরে ধীরে ব্যাক্টিরিয়া নতুন আবিষ্কৃত অ্যান্টিবায়োটিকেও ‘অমর’ হয়ে গেছে মূলত আমাদের অবিমৃষ্যকারিতায়।
ফলাফল? WHO-র হিসেব বলছে বছরে সাত লক্ষ মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাক্টিরিয়া সংক্রমণে মারা যায়। CDC বলছে শুধুমাত্র আমেরিকায় বছরে ২.৮ মিলিয়ন ইনফেকশন হয় অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু দ্বারা। আর প্রায় হাজার ত্রিশ মানুষ মারা যান। স্বাভাবিকভাবেই এদেশে সে সংখ্যাটা অনেক বেশি। বছরে শুধুমাত্র শিশুমৃত্যু ৫৮০০০!! WHO মনে করছে সংখ্যাটা ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে দশ মিলিয়ন হবে।
আর ইতিহাস, বিজ্ঞান সম্পর্কে উদাসীন আপনি কী অবলীলায় তিন বার হাগু করে দুটো *রফ্লস-টিজেড কিংবা *টু দোকান থেকে কিনে খেয়ে ফেলেন অবলীলায়!!
জাম্পকাট.. করোনা আতঙ্কিত ভারতবর্ষ।
কাল ICMR -এর ঘোষণার পরে মোটামুটি সবাই হুমড়ি খেয়ে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কিনে বাজার থেকে হাপিশ করে ফেলেছেন। কেউ একবারও পড়ে দেখার প্রয়োজন অনুভব করেন নি, এই ঘোষণা শুধুমাত্র সন্দেহজনক রোগীর চিকিৎসায় যুক্ত স্বাস্থ্যকর্মী কিংবা প্রমাণিত কোভিড রোগীর দেখভালের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের জন্য। তাছাড়া, কোনও গাইডলাইনই এখনও পুরোপুরি ভাবে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত নয়, এখনও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন। অথচ, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই দেদার বিকিয়ে গেল হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। মাস্ক পরে ছবি তোলার মতোই হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে সান্ধ্য চা খেলেন তামাম ভারতবাসী।
বেশি কিছু না, শুধু সাইড এফেক্টগুলো বলে যাই.. (সাধারণ বমিভাব, পাতলা পায়খানাগুলো ছেড়ে দিন) হৃৎযন্ত্রের ছন্দপতন, হার্ট ফেলিওর, চোখের রেটিনার গন্ডগোল, রক্তাল্পতা, ব্রণ, চুল উঠে যাওয়া, খিঁচুনি, দেখতে সমস্যা, মানসিক রোগ, পেচ্ছাবের বেগ ধরে রাখার অসুবিধে, শুনতে না পাওয়া, কান ভোঁ ভোঁ করা, আমবাত ও অন্যান্য অ্যালার্জি, লিভার ফেলিওর, প্যারালাইসিস, সোরিয়াসিস ও পরফাইরিয়ার মতো চর্মরোগ বেড়ে যাওয়া, মাথা ঘোরা..
যাক গে, এসব বলে-টলে লাভ নেই। এসব লিখেও কী লাভ হয় জানিনা। এদেশে সবাই ডাক্তার। এই লেখাটা পড়তে যত সময় লাগে তার মধ্যেই শ’য়ে শ’য়ে মানুষ ভিড় জমিয়েছেন ওষুধ দোকানে..
‘দাদা, দু পিস *জিথ্রাল দিন তো’ আর ‘ওই যে কী একটা করোনা মারার ওষুধ বেরিয়েছে ওইটা চার পাতা’
চেয়ে দ্যাখ তোপসে, দিগন্তে মেঘ জমেছে। ঘন কালো মেঘ। আলো পড়ে এলো..