গত দুবছর ধরে স্লোগানটা পাল্টে নিয়েছিলাম… “বি নেগেটিভ”, “বি পজিটিভ” নয় মোটেই। এই মন্ত্র জপেই কাটিয়ে দিলাম বেশ অনেকদিন। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। কুটটুস নভেম্বরেই এই ঝঞ্ঝাট কাটিয়ে এসেছিল। বাকি ছিলাম আমরা।
প্রথমেই দেবযানী। Rapid Antigen Kit-এই “পজিটিভ”, আমার তখন তত symptom নেই। ইদুর মহাশয় (RAT) তাই যথাযথ কামড়ালেন না। দুদিন বাদে অগত্যা RTPCR, এবারে আর বাঁচা গেল না।
এইবারে নিভৃতবাসের ব্যবস্থাপনা। প্রথম দুদিন বেশ জ্বর, গায়ে হাত পায়ে অসহ্য ব্যথা, কাশি, দুর্বলতা। সামান্য ওষুধ-বিষুধের আশ্রয়। লক্ষণগুলো কমতে থাকলো। কিন্তু দুর্বলতা আর কাশি। সেটা আর কমে না। শেষ অবধি চিকিৎসকের পরামর্শে স্টেরয়েড চালু করতে হল, দিন তিনেক আগে থেকে। তাতে spasm আর কাশি কিছুটা কমেছে বটে। তবে সাতদিনের মাথাতেও তেমন আগাপাশতলা সুস্থ বোধ করছি না। আসলে ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, COPD ইত্যাদি বয়সজনিত রোগ বেশ কিছুদিন হল ধরে ফেলেছে। তারসঙ্গে অণুজীবের আক্রমণ, একটু কাহিলই করে দিয়েছে। দেবযানী অবশ্য সুস্থ। কোমরে ব্যথা ছাড়া আর বেশী কিছু সমস্যা নেই।
******************************
আসলে ধান ভানতে গিয়ে নিজেদের অসুখের গীত গাইলাম।
বলতে চাইছিলাম, অন্য গল্প। ছোটবেলায় এইসব অসুখ বিসুখ হলে কাদের কাছে যেতাম, কি করতাম, সেইসব গল্পগুজব করার লক্ষ্যেই লেখাটা শুরু করে ছিলাম, কিন্তু “নার্সিসাস”-এর কল্যাণে প্রথমেই নিজেদের কথা একটু সাতকাহন বলা হয়ে গেল।
যা হোক, প্রথমেই বলে নিই, পান্ডাপাড়ায় যে গলিতে আমাদের বাড়ী, সেই গলির নাম “মন্টু ডাক্তারের গলি”। সেই সুবাদে ছোটবেলায় খুব সহজেই এলাকাটা চিহ্নিত করা যেত।
আর মন্টু ডাক্তার, মানে যার নামে গলি সেই ডা: মনোতোষ রায়কে আমি যে কেন ছোটবেলার থেকেই “মন্টুকাকু” ডাকতাম, সেই রহস্যটা আর ভেদ হয়নি, সম্ভবত: বাবা সম্মানার্থে মন্টুদা ডাকতেন, তাই। ছোটবেলায় কাকুর কোলে যেমন ঘুরেওছি, আবার ইনজেকশন-এর গুঁতোও খেয়েছি।
উনি কিন্তু মোটেও “কোয়াক” ছিলেন না, জলপাইগুড়ির জ্যাকসন মেডিক্যাল স্কুল থেকে পাশ করা তৎকালীন “এলএমএফ” ডাক্তার ছিলেন। সর্দি, কাশি, পেট ব্যথা, জ্বর, পাতলা পায়খানা… সবকিছুতেই ভরসা ছিল মন্টুকাকু।
সকালে আর বিকেলে বাড়িতেই দেখতেন, আর দিনবাজারে বিশ্বনাথের কচুরির দোকানের উল্টোদিকে ছিল ওনার দিনের আর সন্ধ্যার পরিপাটি চেম্বার। মারোয়ারি পট্টিতে ওনার প্রায় একচেটিয়া মক্কেল ছিল। ঔ ফার্মেসী থেকে বোতলে করে দাগ দেওয়া মিক্সচার দেওয়া হত, দিনে কয় দাগ খেতে হবে তার আবার নির্দেশও থাকতো। এছাড়া পুরিয়াও দেওয়া হত, কাগজের প্যাকেটে মোড়া। সেসব প্রচুর খেয়েছি।
পরে আবার উনি “সেপট্রান” বা “ব্যাকক্ট্রিম ডিএস” প্রচুর লিখতেন। পরে গলার ইনফেকশন একটু বেশী হলে “Althrosin (Erithromycin) লিখতেন। আর শেষের দিকে, যখন অনেকটাই বয়স, অসুস্থতাও বেড়েছিল, তখন প্রায় একচেটিয়া Wymox (বিভিন্ন মাত্রার Amoxicillin) লিখতেন, সঙ্গে probiotic, vizylac.
একবার ক্লাস সেভেনে পড়ি যখন আমার তুমুল হাম-জ্বর হয়েছিল। আমাদের সময় হামের টিকা সেভাবে চালু হয়নি। সেইসময় প্রবল জ্বর, ১০৪°F অবধি উঠেছিল। জলপট্টি, গায় স্পঞ্জ করে দেওয়া, মা আমাকে নিয়েই পড়েছিল, আর সঙ্গে খুব খারাপ পায়খানাও হয়েছিল। মন্টুকাকু দুবেলা এসে দেখেছিলেন তাই নয়, কেন শরীরের চাকা চাকা দাগ হয়, পায়খানা কেন খারাপ হয়েছে, সব ধৈর্য্য ধরে বুঝিয়েছিলেন, আমাকে, বাড়ির লোককেও।
আগে বাড়িতে আসলেও ফিস নিতে চাইতেন না, বাবা তাও পাঁচ, দশ বা কুড়ি টাকা বুকপকেটে গুঁজে দিত। পরে অবশ্য ফিস নিতেন, ওনারও সংসার চালানোর চাপ বেড়েছিল।
আমার দিদির higher secondary (১৯৭৫)-র খবর মন্টুকাকুই দিয়েছিল, তখন এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে রেজাল্ট দিত, রোল নম্বর বললে বলত। আর পাড়ায় টেলিফোন ছিল একমাত্র ওনার বাড়িতেই। নম্বর ছিল, ৯২ (যতদূর মনে পরে!) তখন STD ছিল না। ট্রাংককল বুক করতে হত। একবার ট্রাংককল আসলে, বাড়িতে খবর দিলে, গিয়ে ঠায় বসে থাকতে হত। আরেকটা কি ছিল, “স্ট্রেট ট্রাংক ডায়ালিং”। তাতে কম বসতে হত। বড়মামা কলকাতা থেকে মাঝে মাঝে ফোন করত। আর দিদিভাই কলকাতায় পড়তে গিয়ে মাঝে মাঝে প্রয়োজনে করত বটে!!
মন্টুকাকু বড় অমায়িক, ভালো মানুষ ছিলেন। কলকাতায় ডাক্তারি পড়ার সময়, যখন শহরে ফিরতাম, গলির মধ্যে দেখা হলেই, সাইকেল থামিয়ে, “জগন্নাথ” বলে বেশ কিছুক্ষণ পড়াশোনার অগ্রগতি, আধুনিক চিকিৎসার গতিপ্রকৃতি, কলকাতার জীবন এইসব নিয়ে বন্ধুর মত আলাপ করতেন।
পৃত্রিপ্রতিম মানুষটির বিয়োগে বড় কষ্ট পেয়েছিলাম, শেষ বয়সে প্রচুর ভুগেছিলেন উনি।
একটা ছোট গল্প দিয়ে শেষ করি। সিক্স-সেভেন-এ পড়ি, অতটা লায়েক হয়নি।
আমাদের জেঠুর বাড়িতে এক পিসতুতো দাদা, নিজের দাদার মতোই, থাকতেন। এখানে চাকরী করতেন।
একদিন হঠাৎ জেঠু এসে বললো ,”ছেলেটা” উদভ্রান্তের মত করছে (এমনিতেই জেঠুর উদ্বেগ একটু বেশী ছিল!) ওর নাকি জিভ ভিতরের দিকে ঢুকে যাচ্ছে, ছটফট করছে। বাবা প্রথমে রোগীকে দেখে যথারীতি মন্টুকাকুকে খুঁজতে বেরোলো।
সেদিন আবার বাড়িতে কিসের পুজোর আয়োজন ছিল, “কালাচাঁদ” না কি যেন! তাতে বেশ বেজায় স্বাদের ক্ষীরের নারুর “হরির লুঠ” হত, বেশ দারুণ খেতে লাগতো।
এরইমধ্যে মন্টুকাকু সন্ধ্যার চেম্বার শেষ করে সাইকেলে ফিরছিল। ওই পথেই জেঠুর বাড়ী গেল। সব পরীক্ষা-টরীক্ষা করে বলল, “ভয়ের কিছু নেই, ভাঙের সরবত খেয়েছে, বেশ কিছুটা খেয়েছে, তারপরে আবার ক্ষীরের নারুর প্রাসাদ.… একটু লেগে গেছে। ভালো করে নুন জল খাইয়ে বমি করাও, কাল ঠিক হয়ে যাবে।” (বেচারা, নিপাট ভালো ছেলের কি নিদারুণ ডায়াগনসিস!)
হঠাৎ করে মনে পরে গেল, সেদিন তো হোলি! আমাদের শহরের আসল দোল!!…
******************************
আজ এইখানেই রাখি। মন্টু কাকুর গল্পই শেষ হওয়ার নয়। আরো অনেক চিকিৎসকের কথা মনে পরছে। অনেকের সাথে যোগাযোগ ছিল, অনেকের সাথে নয়, তবু তাদের কর্মকাণ্ডের বিবরণ শুনেছি। এমনকি এখানকার এক চিকিৎসককে কলেজে শিক্ষক হিসেবও পেয়েছি। সেইসব গল্প সময় সুযোগে বলা যাবে।
আজকের লেখাটা অজাতশত্রু, একজন অত্যন্ত ভালোমানুষ, ডাক্তারবাবু আমার পরমপ্রিয় মন্টুকাকুর স্মৃতিতর্পণ হয়েই থাক।