তুই আবার এসেছিস?
হ্যাঁ, এসেছি … তো…?
না… মানে একই রোগী যদি রোজ ডাক্তারের কাছে আসে, তাহলে ডাক্তারের আত্মবিশ্বাসে চির ধরে… মনের মধ্যে খচ খচ করে।
করুক। তা বলে রোগী ডাক্তারের কাছে আসবে না… কী অদ্ভুত। এতো ভঙ্গুর আত্মবিশ্বাস নিয়ে তুমি চিকিৎসা করো কী করে?
বল, তোর আজ আবার কী সমস্যা হলো?
সে সমস্যার সমাধান তুমি করতে পারবে না ডাক্তারদা। স্বয়ং ঈশ্বর এলেও পারবেন না। আমি গো হারান হেরে গেছি।
তাহলে ফালতু আমার সময় নষ্ট করছিস কেন? পালা।
আচ্ছা তাড়িয়ে দিচ্ছ? মুখটা যদি আগুনে পোড়া না হত, তাহলে এতো সহজে একটা মেয়েকে চলে যেতে বলতে পারতে?
একেবারে চুপ কর। কী ভেবেছিস নিজেকে? আর একটা কথা বললেই ঘুষি মেরে তোর নাক ফাটিয়ে দেব।
তাই দাও না ডাক্তারদা।
আর জ্বালাস না। কী দরকার বল।
আজ তোমায় একটা জিনিস দিতে এসেছি। আমার তো দামী কিছু দেওয়ার ক্ষমতা নেই… তাই।
কী এনেছিস… এটা তো ফটো… এতো প্যাক করে এনেছিস কেন?
সামান্য একটা উপহার… তাও যদি সাজিয়ে না দি… আমার তো আর সাজা হবে না।
তোর সত্যি মারের দরকার।
ভেবেছিলাম পরে খুলতে বলব। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তুমি এটা আমার সামনেই খোলো।
তুই শুধু শুধু আমার জন্য উপহার আনতে গেলি কেন? তোর শরীরের এই অবস্থা… কেমো নিতে হচ্ছে… হিমোগ্লোবিন এতো কম…
সে জন্যই তো নিয়ে এলাম। জানিনা আর সুযোগ পাব কিনা? শুধু তোমাকে নয়… আরও দু-তিনজনকে দেব। এই পোড়া মেয়েটাকে দেখে যারা মুখ ঘুরিয়ে নেয়নি… যাঁদের চোখে ঘৃণা ফুটে ওঠেনি।
খামোখা একজন মানুষকে ঘৃণা করব কেন। তোর মতো মিষ্টি মেয়েকে তো প্রশ্নই ওঠে না… তুই ভুল ভাবছিস… তোর জন্য আমি যা করেছি… সেটা চিকিৎসক হিসাবেই করেছি। এখানে ব্যক্তি মানুষের কোনো ভূমিকা নেই। বস্তুত তোর জন্য চিকিৎসক হিসাবেও খুব বেশি কিছু করতে পারিনি। এমন রোগ ধরা পড়ল।
এক সময় মনে হয়েছিল মরে যাওয়াই ভালো। গায়ে আগুন দেওয়ার পর মনে হল… একটা অসভ্য ইতরের জন্য কেন মরবো। আমার ফুলের মতো মেয়েটার কী হবে। কিন্তু ততোক্ষণে দেরি করে ফেলেছি। আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। এখনও সেই মুহূর্ত গুলো মনে পড়ে। চুলে আগুন ধরে গেছে। মুখের চামড়া ঝলসে যাচ্ছে। আর আমি প্রাণপণে বাঁচার চেষ্টা করছি। অতো তীব্র বাঁচার আকাঙ্ক্ষা আগে কখনও হয়নি। বাঁচার চেষ্টায় যন্ত্রণা টের পাইনি… জানো?
একি রে? এতো রাধা কৃষ্ণ। তুই ঠাকুর দেবতার ছবি নিয়ে এসেছিস- তাও আমার জন্য।
ঠাকুর দেবতা না ভাবলেই হলো। তুমি ভালো করে দেখো- কোথায় দেবতা… দুজন মানুষ, আর বাকিটা শুধু ভালোবাসা। যে ভালোবাসা পেতে হলে অনেক ভাগ্য করে জন্মাতে হয়। সে ভাগ্য আমার ছিল না।
ছবিটা সত্যিই সুন্দর…
ইদানীং আমার পৃথিবীর সব কিছুই সুন্দর লাগে। রোজ ভোর হওয়া- সকালের ফাঁকা রাস্তা, আমার মেয়ের তুলতুলে গাল, ছোটো দুটো হাত, চির রুগ্ন মায়ের বদহজমের ঢেকুর। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে বেশি দিন আমি আর এসব উপভোগ করতে পারব না। সব ছেড়ে চলে যেতে হবে।
এই নিয়ে মাথা খারাপ করিস না। যেতে তো সকলকেই হবে। আমিও মরে যাব। মানুষের জীবনটা খুব বড়ো নয়- যে কদিন বাঁচব- সত্যিকারের বাঁচব। মৃত্যু চিন্তা নিয়ে বাঁচার কোনো মানে হয় না।
যার সারা শরীরে মৃত্যুর কোষ ছড়িয়ে গেছে সে কী করে মৃত্যুকে উপেক্ষা করে বাঁচবে। তবে একটা আশ্চর্য বিষয়- এই ক্যানসার কোষগুলিই কিন্তু আমাকে একটা অদ্ভুত নিশ্চয়তা দেয়। যে নিশ্চয়তা আমি কোনোদিন আগে পাইনি- না আমার মায়ের কাছে, না আমার স্বামীর কাছে। অনিশ্চিত জীবনে প্রথম নিশ্চয়তা…
তুই থামবি- না হলে এবার সত্যি সত্যি হাত চালিয়ে দেব…
যা ইচ্ছে করো। শুধু এটাকে টানিয়ে রেখো। যেখানে খুশি। আর সারাদিনে একবার দেখো।