শুরুর কথা
স্বাস্থ্য নিয়ে কুসংস্কার আমাদের সমাজে সর্বত্র। এ রাজ্যের বহু মানুষ শারীরিক কিছু সমস্যা হলে এখনও প্রথমে আধুনিক চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে ছুটে যায় ওঝা,গুনিন বা কোনও তান্ত্রিক – কবিরাজের কাছে। গ্রামের অনেকেই জন্ডিস হলে কিংবা বাতের ব্যথার সমস্যা, হাঁপানি, এলার্জি, দাঁতের ব্যথা, অর্শ, ইত্যাদি সমস্যার কারণে ভীড় জমায় প্রথমে ওঝা,গুনিন বা পীর – ফকিরের কাছেই। কাউকে দেওয়া হয় স্বপ্নে পাওয়া দৈব ওষুধ কাউকে তাবিজ-কবচ আবার কাউকে দেওয়া হয় ন্যাবার মালা কাউকে অর্শ ভালো করার জন্য তামার আড়াই প্যাচের আংটি, বা একটি তামার বালা। এক্ষেত্রে শুধু হতদরিদ্র খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষই নন বেশ কিছু তথাকথিত শিক্ষিত মানুষজনও দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করে তর্ক জুড়ে দেন দৈব গুনের ওষুধেরও নাকি ক্ষমতা আছে এবং আড়াই প্যাচের আংটি পড়ে নাকি অর্শ রোগ থেকে ভালোই আছেন।
অর্শ রোগ আসলে কি আদৌও তামার আংটি বা বালা পড়ে শেষমেশ কি ভালো থাকা যায় ? এই বিষয় নিয়ে চিকিৎসক বন্ধুরা নিশ্চই মতামত দেবেন। আমি এখানে বলবো স্বাস্থ্য নিয়ে সাধারণ মানুষ এখনো যে কুসংস্কার গুলো প্রতিনিয়ত লালন -পালন করে যাচ্ছেন তার কিছু ঘটনার কথা। আসুন আজকে এমনই একটি ঘটনার কথা আলোচনা করি।
এক রোগীর কেস হিস্ট্রি
এ ঘটনা গত ১২ মার্চ বারাসাত সিটিজেনস ফোরামে সাপ্তাহিক চিকিৎসা পরিষেবা নিতে আসা একটি ১৫ বছরের মেয়ের। শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের পরিচালনায় এবং ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সহযোগিতায় বারাসাত কালিকাপুরে যে চিকিৎসা শিবির চলে তার কথা জানেন অনেক বন্ধুরাই। আমাদের এই চিকিৎসা শিবিরে যাঁরা আসেন তাঁরা জানেন প্রত্যেক রোগীদের শুরুতেই নেওয়া হয় কেস হিস্ট্রি। যা প্রকৃত রোগ নির্ণয়ে একটু গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। রোগীর ইতিহাস জানার সময়ে বেশ কিছু রোগীর বিপি মাপতে গিয়ে দেখা যায় কারও দুই হাতের বাহুতে, গলায় তাবিজ-কবচ বা মাদুলি। জিজ্ঞাসা করলে কেউ বলেন বাতের ব্যথার জন্য পড়েছেন কেউ দাঁতের ব্যথা, আবার কেউ হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। শুধু বিনীতভাবে বলি এত কিছু পরার পর শেষমেশ ডাক্তার দেখাতেই এসছেন। আসলে এঁদের কাছে আমরাও এই বার্তা পোঁছে দিতে পারিনি ‘স্বাস্থ্য আমাদের ভিক্ষা নয় স্বাস্থ্য আমাদের অধিকার’। যাঁরা এই অধিকারের দায়িত্ব পালন করার জন্য শপথ করেছিলেন তাঁরা এখন কে নাগরিক-বেনাগরিক খেলায় মেতে উঠেছেন। সবার জন্য স্বাস্থ্য বিষয় নিয়েই দিল্লীর সব রাজারাই চুপ। যাইহোক প্রসঙ্গে ফিরি। মেয়েটির নাম ঝ__ স__র থাকে বসিরহাট। বসিরহাটের একটু স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে। বোনকে সঙ্গে নিয়ে বাবার সাথে এসছে ডাক্তার দেখাতে।
মেয়েটির কি সমস্যা?
গত দেড় বছর ধরে মাথায় যন্ত্রণা, দু’বছর ধরে মাসিকের সমস্যা অর্থাৎ অনিয়মিত। মাসিকের সময় পেটে ব্যথা, সাথে ডান কানে কম শোনা এবং দু’ কানে ব্যথা। প্রথমে শারীরিক সমস্যা ভেবেই আমাদের এক স্বাস্থ্য কর্মী চিকিৎসার জন্য ডা. পুণ্যব্রত গুণের কাছে পাঠালেও ডা. গুণের পরামর্শে পুনরায় পরবর্তীতে মেয়েটির সাথে কথা বলে এবং মেয়েটির গলায় এবং কোমড়ে গাদাগুচ্ছের মাদুলি দেখে যে তথ্য উঠে আসে আসুন এবার একটু সেই বিষয় নিয়ে আলোকপাত করি।
নিশ্চয়ই এই বিষয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বন্ধুরা বলবেন আমি শুধু মেয়েটির সাথে বন্ধুর মতো মিশে যে তথ্যগুলো পেয়েছি সেই গুলোই আপনাদের মাঝে শেয়ার করছি।
পারিবারিক ইতিহাস
মেয়েটির বাবার দুই বিয়ে। প্রথম পক্ষের স্ত্রী মারা গেছেন, দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান ওরা দুই বোন ঝ__ এবং ঝু__। আগের পক্ষের দুই দাদা আছেন তাঁরা বিবাহিত তবে আলাদা অনত্র থাকেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত ওদের পরিবার। ঝ__ বেশ কিছুদিন আগে ছোট বোন ঝু__র সাথে একজায়গায় ঘুরতে যায়। সেখানে গিয়ে ভয় পান। কোনো এক মহিলা নাকি স্বপ্নে ঝ__কে বলেছেন ‘তুই আত্মহত্যা কর নাহলে তোর বাবা মা, আত্মীয় পরিজন সবাইকে মেরে ফেলবো’। এমনকি ঝ__র দাবি সে নিজের চোখে দেখেছেন সেই মহিলাকে। যিনি সাদা শাড়ি পড়ে নাকি ঘোমটা দিয়ে থাকে। তবে সেই মহিলার মুখ দেখতে পায়নি। ঝ__র বাবার চপের দোকান এবং মা অনত্র কাজ করেন সকালে বেড়িয়ে যান ফেরেন সন্ধ্যে বেলায়।
ঝাড়ফুঁক তুকতাক
ঝ__র মুখে পরিবারের লোকজন এই সব শুনে প্রথমে নিয়ে যায় বসিরহাট এক হুজুরের কাছে তিনিই ঝাড়ফুঁক তুকতাক করে গাদা গুচ্ছের তাবিজ মাদুলি ঝ__র গলায় ও কোমড়ে পড়িয়ে দেন। পরবর্তী সময়ে এই তাগা-তাবিজ পড়ে ভয় কিছুটা কমলেও শারীরিক সমস্যাগুলো ঝ__র থেকেই যায়। শেষমেশ কারও মারফত খবর পেয়ে বাবার সাথে এসছেন আমাদের এখানে সুচিকিৎসার জন্য।
শেষের কিছু কথা
বারাসাত সিটিজেন ফোরামে ডাক্তার দেখানোর আগে এবং পরে প্রথমে মেয়েটি চুপচাপ আনমনা হয়ে বসেই ছিলো। বেশ কিছু সময় মেয়েটির সাথে গল্প এবং সেই মুহুর্তে আমার কাছে প্রস্তুত থাকা দুই একটি বিজ্ঞানের কৌশল দেখাতেই ওর মুখে হাসি ফুটলো। ও দেখলো হাত ছুঁলেই সব জিনিস মিষ্টি হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও দেখলো ওর চোখের সামনেই ওর বাবার গলায় ছুরি ঢুকিয়ে আবার গলা জুড়ে দেওয়া হলো। সমস্তটাই যে কৌশল ওকে বোঝানো হলো। নানান গল্পের ছলে বেরিয়ে এলো চরম সত্যটা–‘মা আমাকে সব সময় বকাবকি করে এবং আমার থেকে বোনকেই বেশি ভালো বাসে।’ ফোনে কথা হলো ওর মার সাথেও শুধু বলা হলো পরের তারিখে আপনিও আসবেন মেয়ের সাথে।
Eagerly waiting for your next writing Sir…