‘মগের মুলুক’ কথাটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। আরাকান রাজ্যের মগ ও পর্তুগিজ দস্যুরা মিলে মোগল আমলে এখানে ভয়ের রাজত্ব গড়ে তুলেছিল।
সুপ্রাচীন তাম্রলিপ্ত বন্দরের গরিমা হ্রাসের পর সমুদ্র থেকে জেগে ওঠা এই দ্বীপে ষোড়শ শতকে সমুদ্র বন্দর গড়ে ওঠে। কোলকাতা বন্দরের নাব্যতা হ্রাস পেতে শুরু করায় বিদেশের অনেক জাহাজই এখানে এসে ভিড়তো। রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের বিলেত যাত্রা এই বন্দর থেকেই।
১৭৭২ সালে এখানেই গড়ে ওঠে দেশের প্রথম ডাকঘর। ইংরেজ নাবিকদের বসতির স্মৃতি বুকে নিয়ে তাঁদের কবরস্থানগুলো সময়ের স্রোত বেয়ে টিকে আছে।
আঠারো শতকের মাঝামাঝি থেকে বন্দরের গুরুত্ব কমতে শুরু করে। ১৮৬৪ সালের বিধ্বংসী ঝড়ে এই বন্দর সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়।
****
না, আপনার জেনারেল নলেজের পরীক্ষা নিতে আসিনি। জায়গাটার নাম খেজুরি। পূর্ব মেদিনীপুরের সমুদ্রঘেঁষা সুপ্রাচীন জনপদ। সপ্তাহ দুয়েক আগের আম্ফান ঝড়ে বিপর্যস্ত এলাকা। ইতিহাস থেকে জেগে উঠেছে ঝড়ের কুখ্যাত সব স্মৃতি। এখানে বনবাসুড়িয়া গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস’ ফোরাম ও শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের তরফে আমাদের মেডিক্যাল ক্যাম্প ছিল আজ। ডাক্তার হিসেবে আমার সাথে মেডিক্যাল কলেজের দুই সিনিয়র ডা. বিতান দত্ত ও ডা. মানস কুমার মহাপাত্র।
আমরা যখন গিয়ে পৌঁছলাম তখন প্রায় দেড়টা। প্রাথমিক বিদ্যালয় চত্ত্বরে জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। রাস্তার দুদিকে ভেঙে পড়েছে অগুনতি গাছ। প্রায় সব বাড়িরই টিনের চাল উড়ে গেছে। কারেন্ট আসে নি এখনো। একে লকডাউন তার ওপর আম্ফান মিলে পুরো মড়ার ওপরে খাঁড়ার ঘা। ভরা কোটালে রাস্তা অব্দি সমুদ্রের জল উঠে আসে। সমুদ্রের পাশের ভেড়িগুলোতে মাছ চাষ হয়। আমরা পায়চারি করে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম।
ততক্ষণে আমাদের আসার খবর পেয়ে ধীরে ধীরে ভিড় জমতে শুরু করেছে। প্রচুর ওষুধ সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সাথে পানীয় জল শোধন করার স্টক সলিউশন। ঘাড়ে-কোমরে ব্যথা, উচ্চ-রক্তচাপ, গলা-বুক জ্বালা, রক্তাল্পতা, অপুষ্টি, বাড়ন্ত বাচ্চার হাঁটুর ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য, সর্দি-কাশি এসব সাধারণ রোগ তো ছিলই, তার সাথে অগুনতি চর্মরোগ। স্কেবিস, দাদ, ব্রণ, আমবাত ছাড়াও সমুদ্রের নোনা জলে মাছ ধরতে গিয়ে সারাদিন চামড়া ভিজে থেকে চর্মরোগ, না বুঝে স্টেরয়েড মলম লাগিয়ে চামড়ার বারোটা বাজানো ইত্যাদি হরেক কিসিমের রোগের অফুরন্ত ভান্ডার। লকডাউনে রোজগার হারিয়ে অবসাদে ভুগছেন অনেকে। দু’জন গর্ভবতী মা এসেছিলেন। কিছু সার্জিক্যাল সমস্যা, সম্ভাব্য হার্টের রোগ এবং এক্স-রে, ইসিজির প্রয়োজনে হাসপাতালে যোগাযোগের কথা বলা হয়েছে। অন্তত জনাপাঁচেক রোগী নিজেদের উচ্চ-রক্তচাপ আছে বলে জানেনই না। ওষুধও খান না স্বাভাবিক নিয়মেই। “কোনও ওষুধ চলতো না..তারপর দুম করে একদিন পড়ে গিয়ে অজ্ঞান..মুখের কোণ বেঁকে যাওয়া..বিপি ২৬০/১২০”.. এসব আমাদের বিশেষ পরিচিত ‘কেস’। প্রথমে এসে যখন দেখি জনমানবহীন এলাকা তখন ক্যাম্প আদৌ হবে কিনা এ ব্যাপারে সংশয়ে ছিলাম। ঘামতে ঘামতে বিকেল পাঁচটা নাগাদ যখন রোগী দেখা শেষ হ’ল তখন রোগীর সংখ্যা ১১০।
রোগের বিরুদ্ধে লড়াইটা খুব খুব কঠিন। তবু যুদ্ধক্ষেত্রে এসে দাঁড়িয়েছি যখন পেছনে তাকানোর প্রশ্নই ওঠে না। আমাদের ক্ষুদ্র সামর্থ্যে যতখানি পারা যায় করার চেষ্টা করলাম। দুপুরে খাওয়া হয় নি। গাড়িতে ওঠার আগে শেষবারের মতো চারদিকটা ঘুরে দেখে নিচ্ছি। কানে এলো..
– ও মা, শুনঅ না গ..
– হুঁ..
– অদের ওই চিয়ার-টেবিলগুলা সরিয়া গুছি দিল্যা মুড়ি-ছলা দিবে?
– চুপ কর.. চকার করিস নি!
মুড়ি-ছলা! মুড়ি-ছলা!! মুড়ি-ছলা!!! কিছু নিষ্পাপ উচ্চারণ আমাদের দায়িত্ব বাড়িয়ে দেয়। কিছু সরল অসহায় চোখ আর গামছা গলায় ঘেমো শরীর বলে যায় ছুঁয়ে দেখার আছে অনেক, অনেক কিছু। কিছু ফ্যাটফেটে সাদা চোখের তলায় শপিং মল-এসি গাড়ি শোভিত অত্যাধুনিক ভারতবর্ষ নগ্ন হয়ে যায়। সভ্যতার ঝাঁ-চকচকে ক্যানভাসে পিৎজা আর বিরিয়ানি ছাপিয়ে ফুটে ওঠে এক ঠোঙা মুড়ি, কয়েকটা ছোলাসেদ্ধ!
আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করেছে। পেছনে পড়ে থাকছে ‘ওদের ভারতবর্ষ’ আর দিগন্তজোড়া নগ্নতা।
ভালো