এপ্রিলের সেই সকালটার কথা মনে পড়ল অতনুর। কাচের জানলার বাইরে যদ্দূর চোখ যায় ধপধপে সাদা। বরফ আর বরফ। আগের দুদিন একনাগাড়ে বৃষ্টি পড়ে গোটা দার্জিলিং ঢেকে গেছিল বরফে। এইরকম খামখেয়ালিপনা প্রকৃতি কমই করে। দার্জিলিংয়ে গ্রীষ্মকালে তুষারপাত এক বিরল ঘটনা। অথচ সেই দুর্দান্ত সময়ে কোনও টুরিস্ট ছিল না তালাবন্ধ দেশে।
বাস্তবিক, একশো বছর বাদে এসেছে এক অদ্ভুত সময়। মানুষ যখন প্রকৃতির সঙ্গে চু কিতকিত খেলতে খেলতে দুমদাম ঘুষি মারে, প্রকৃতিও বোধহয় এভাবেই প্রতিশোধ নেয়। কে বলবে এটা ট্যুরিস্ট সিজন। প্রতি বছর জুন মাসে ম্যালে থিকথিকে ভিড় থাকে। আশেপাশের লোহার চেয়ারে পর্যটকরা বসে আরাম করে মজলিসে ব্যস্ত থাকেন। কবি ভানুভক্তের মূর্তির পায়ের কাছে স্হানীয় খেটে খাওয়া লোকেদের ভিড় হয়। কেউ বা কেতলিতে চা বিক্রি করেন। কেউ ভুট্টা সেঁকেন উনুনে। রঙিন উলের পোষাকের পশরা সাজিয়ে বসা হরেক বিপণি। একজন লোকাল মেয়ে কী পরিশ্রমটাই না করে শীতের গরমজামা, মোজা দস্তানা বিক্রি করতে। সকাল থেকে রাত অবধি দোকান খুলে একাই সব টাঙায়। নামায়। ঘামে চকচক করে মেয়েটার লালচে গাল। ম্যাল থেকে যে রাস্তাটা বেঁকে রাজভবনের দিকে গিয়েছে সেখানটা ক্রেতা বিক্রেতার দরাদরিতে মুখর থাকে। মাঝে মাঝে অতনুর মনে হত সে কলকাতাতেই আছে। গড়িয়াহাট কিংবা হাতিবাগান। জাস্ট কাঞ্চনজঙ্ঘা উঠে এসেছে কলকাতায়।
কিন্তু এখন? এ যেন এক নিঃশব্দ ঘুমন্ত উপত্যকা। ভোরে পাখির ডাকে তবু কিছুটা প্রাণবন্ত লাগে। মৌটুসি, বসন্তবৌরি, কিচির মিচির করে। বেলা বাড়লে যে কে সেই। পাইন , মেপল, এপ্রিকট গাছের ফাঁক দিয়ে গোটা দার্জিলিং একাকিত্বের চাদর টেনে নেয় শরীরে। দূর নভোনীলে একাকী কাঞ্চনজঙ্ঘা সব কিছুর সাক্ষী হয়ে থাকে।
এই নিয়ে অতনুর সাত বছর হল দার্জিলিংয়ে । একটা নামকরা রিসর্টের কর্মচারী। এ বছর মহামারীর জন্য কোটি কোটি টাকার ব্যবসা বন্ধ । পুরো আর্থিক ক্ষতি ট্যুরিজম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সমস্ত মানুষের। গরীব গুর্বো স্হানীয় লোকেদেরও। নব্বই শতাংশ হোটেল স্টাফ পাহাড় থেকে নিচে নেমে গেছে লকডাউন ঘোষণার পরে পরেই। অতনুর মতো কয়েকজন বাড়ি ফিরতে চায়নি। ওরা দার্জিলিংকে ভালবাসে। নিজের নিজের কাজটাকেও। না ই বা হল পর্যটক। হোটেলের ঘরদোর ঝাড়ামোছার তত্বাবধান, বাগান মেরামত, এসব দায়িত্ব থাকেই। সবথেকে বড় কথা হল, বাড়ি ফেরার দায়দায়িত্ব কে নেবে ? তাদের মতো কিরেমাকড়দের কথা কে আর ভাবে ?
সোনালি রোদ পড়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়োয়। গত বছরেও এসময় গ্লেনারিজ আর কেভেন্টার্স গমগম করছিল টুরিস্টে। কালোসাদা ফটোগ্রাফিতে সাজানো কেভেন্টার্স রেস্তরাঁর মধ্যে ফিল্মস্টার রণবীর কাপুরের ছবি টাঙানো আছে। এখানেই শুটিং হয়েছিল বরফি ছবির।
যাদের ফটো কোনওদিন থাকবে না সেই লাখ লাখ রঙিন ভ্রামণিকের ছবি কিন্তু অতনুর মনে গেঁথে আছে। মধুচন্দ্রিমায় আসা নবদম্পতি, ভ্যাকেশনে সপরিবারে আসা উজ্জ্বল মুখগুলো, সবুজ গোঁফ ওঠা চ্যাংড়া ছেলেদের অত্যুৎসাহী ট্রেকিং গ্রুপ। কলকল করা বাচ্চারা , যারা হিমালয়ান ভালুক দেখতে আসে পাহাড়ী চিড়িয়াখানায়। এরা ছাড়া দার্জিলিং মৃত।
অতনু চুপচাপ বসেছিল ম্যালে। ঘোড়াওয়ালাগুলো ঘোড়া চরাতে নিয়ে এসেছে। সওয়ার না হলেও ওদেরকে তো খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সাহেবুল, বীরেন তামাং, সবাইকেই চেনে অতনু। চোখে চোখে কথা হয়। মনমরা মানুষগুলো অপেক্ষা করে আছে কবে আবার মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে উঠবে দার্জিলিং।
সেই মেয়েটা আসছে হেঁটে। উলের টুপি, সোয়েটার নিয়ে যে রোজ বসত পশুপতিনাথ মন্দিরে। কতদিন দোকান বন্ধ। মেয়েটার গাল আপেলের মতো লালচে।
বৃদ্ধ নেপালি গাইড বলরাম ছেত্রী বিড়ি ধরিয়ে অতনুর দিকে তাকাল। -“হবেই হবে জানতাম।”
– “মানে?”
– “চিনে কী হচ্ছে জানো? এভারেস্ট কেটে রাস্তা হচ্ছে। ভাবো, কী বিজনেস। পাপের সাজা পেতে হবে না?”
– “কিন্তু কাকা, এখানে তো কেউ কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়োয় ওঠেনা। সবাই জানে যে এটা বৌদ্ধধর্মে মানা আছে।”
– “ব্যস ? তাতেই হয়ে গেল ? তুমি কী ভাবছ উনি কিছু দেখছেন না ?”
অতনু হেসে ফেলল। সে নিজেকেই বোঝেনা যে আস্তিক না নাস্তিক। খিদে ছাড়া জীবনের আর কোন ধর্মের প্রবল অস্তিত্ব আছে এখনও অজানা।
– “কে দেখছে কাকা ?”
বলরাম ছেত্রী হাত দিয়ে দেখান। ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা। যেন বুদ্ধদেব শুয়ে আছেন প্রগাঢ় ঘুমে।
-“একদিন দেখো সব ভেঙেচুরে নেমে আসবেন উনি। ওঁর শান্তির ঘুম যারা নষ্ট করছে তাদের জন্যই আজ দুনিয়াতে এই রোগ ব্যাধির রমরমা।”
অতনু কী বলবে ভেবে পেল না। মা বলত, মানুষের পাপের ভারে কল্কি অবতার আসবে। সত্যিই কী সেই সময় এগিয়ে এসেছে ?
লালচে গালের নেপালি মেয়েটা হেঁটে আসছে । ওকে আজ একটা গোলাপ দেবেই অতনু। আবার সব ঠিকঠাক করে নিতে হবে। গাছপালা লাগিয়ে, ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিতে হবে দার্জিলিং। খেটে খাওয়া লোকগুলো খেয়াল রাখতে হবে।
এযাত্রায় বাঁচতেই হবে আর বাঁচিয়ে রাখতে হবে ভালবাসার এই শৈলশহরটাকে।
সুন্দর