-দাদু, আজ আবার ‘পারমিতার একদিন’।
অনিমেষের চেম্বারে কিছুদিন হলো নয়না আসতে শুরু করেছে। কোথা থেকে একটা নার্সিং ট্রেনিং নিয়ে এসে বলেছিল, দাদু আপনার কাছে একটু থাকব আর কাজ শিখব। কাজ কি শিখবে কে জানে কিন্তু ঐ দাদু সম্বোধনে চাকরি পাকা হয়ে গেল। ‘দাদু’ শুনে প্রথমে চমকালেও, ভেবে দেখেছিল দাদু তো হয়েই গেছে, একটু বড় নাতনির সঙ্গ খারাপ কি!
সেই থেকে নাতনির নার্সিং ট্রেনিং এর সাথে মজার মজার কথা উপরি লাভ।
সেদিন এক পেসেন্ট এসেছিল কপার টি খুলতে। তিন বছর হয়ে গেছে, এখন বাচ্চা চায়। নয়না টেবিলে পেসেন্ট তুলে ডাকতে শুরু করেছে, কই গো দাদু এসে কপাট-টা খুলে দাও।
— হ্যাঁ রে, এটা কি হচ্ছে? আমি বারবার শিখিয়েছি, এটা কে বলে কপার টি। এক রকমের আই ইউ সি ডি।
— আরে জানি জানি। কিন্তু আসলে বলো, তোমরা এটা দিয়ে বাচ্ছা আসা বন্ধ করো। ও সব আই ইউ সি ডি কি সাধারণ মানুষ বুঝবে? কিন্তু আমি যদি বলি ‘কপাট’ তো কি মহাভারত অশুদ্ধি হলো? বরং ও বুঝবে এটা একটা কপাট, বাচ্ছা আসার রাস্তা বন্ধ, আবার তোমার যখন মনে হবে কপাট খুলে দাও। আসলে কি জানো তো দাদু, এদের কথা ভেবে এদের মতো করে কেউ বলে না বলেই এতো সমস্যা, — বিজ্ঞের মতো নিদান দিলেন আমারই ট্রেনি। কে যে ট্রেনি বোঝা দায়।
তবে নয়নার কথায় অনিমেষের আর জি কর হাসপাতালে পি এস এম ক্লাসে এক ম্যাডামের কথা মনে পড়ে গেল।
তখন ফ্যামিলি প্ল্যানিং কথাটা খুব চালু হয়েছে ।প্রত্যন্ত গ্রামে মহিলাদের হাতে কলমে জন্মনিয়ন্ত্রণের পাঠ নিতে যেতে হতো। মজাচ্ছলে দুটি নির্মম ঘটনা বলেছিলেন।
গ্রামের মেয়েদের মধ্যে ওরাল কন্ট্রাসেপটিভ পিল খাবার নিয়ম নিয়ে ম্যাডাম এক নাতিদীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন। মাসিক শুরুর পাঁচ দিনের দিন পিল খাওয়া শুরু করতে হবে বারবার বললেন। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন বেশ কিছু মহিলা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। অভিজ্ঞ চোখ বুঝেছেন, এরা কিছুই বোঝে নি।
— কি ব্যাপার তোমরা বুঝেছ? একটু যেন ধমকের সুর ।
হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছে মেয়েগুলো, বাচ্চা হবার পর আমাদের তো আর মাসিক হয় না দিদিমণি। বাচ্চা বুকের দুধ খেতে খেতেই তো আবার পেটে বাচ্চা এসে যায়। মাসিকের পাঁচ দিন জানব কেমনে।
দ্বিতীয় ঘটনা সত্যিই মজার। কন্ডোমের ব্যবহার।একদল পুরুষ মানুষকে কন্ডোম কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তার ক্লাস।
ঘুরে ফিরে মাস তিনেক বাদে সেই গ্রামে আবার মিটিং। তিন চারজন লোক চড়াও হয়েছে আগের দিনের ডিমন্স্ট্রেটরের ওপর। ম্যাডাম কাছে গিয়ে শুনলেন ওদের বক্তব্য, দিদিমণি, উনি যেমন দেখিয়েছেন আমরা তেমনই করেছি, তবু বাচ্চা এলো কি করে!
জানা গেল ডিমন্স্ট্রেটর ছেলেটি হাতের বুড়ো আঙুলে কন্ডোম পরিয়ে দেখিয়েছিল আর ছাত্ররা অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করেছিল।
কি হলো দাদু, চোখ বন্ধ করে মিটি মিটি হাসছ কেন?
আসলে বুঝলি, তুইই বোধহয় ঠিক। ওদের মতো করে আমরা ভাবি না। আমাদের মতো করে ওদের চলতে বলি, তাই বোধহয় পদে পদে এই হোঁচট।
ঠিক আছে, অনেক হলো, ওদিকে দুয়ারে ‘পারমিতার একদিন’।
এও আর এক গল্প। বছর দশেক আগে নবনীতা হাজির হয়েছিল তার শাশুড়ি মাকে নিয়ে।
— ডাক্তারবাবু মা কে একটু ঠিক করে দিন। প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই শাশুড়ি মা বহুদিনের অসুখ -বাচ্ছা হবার নাড়ি নেমে এসেছে (ডাক্তারি পরিভাষায়, দু-ডিগ্রী জেনিটাল প্রোল্যাপ্স)।
— এর তো অপারেশন করা দরকার, কিন্তু এতো বয়সে আর এই অবস্থায় অপারেশন করাবে?
— কিছু একটা করুন ডাক্তারবাবু, উনি ছাড়া আমার আর কেউ নেই।
— কেন তোমার ছেলে মেয়ে?
— তারা তো সব বড় হয়ে নিজেদের মতো আছে। এখন উনিই আমার সঙ্গী।
শাশুড়ি মা অপারেশনে কিছুতেই রাজি নয়। অগত্যা অধুনা অপ্রচলিত রিং পেসারি পরিয়ে সে যাত্রা অনিমেষের মুক্তি।
— শোন মা, নিয়মিত এসে ওটা পাল্টে যেতে হবে।
সেই শুরু। প্রতি দু-মাস ছাড়া শাশুড়ি-বৌমার অনিমেষ দর্শনে কোনো ছেদ পড়ে নি। এবং অবাক কাণ্ড অদ্ভুত এক জীবনীশক্তি নিয়ে ওরা দিব্যি চলেছে। চেম্বারে ঢুকে দুজনেরই দাবি অপরজনকে যেন ভালো করে দেখি। যাবার সময় অনিমেষের টেবিলে একশ টাকার একটা নোট রেখে যায় (বেশ জোর করেই)। উপরি হিসেবে মাথায় নবতিপর বৃদ্ধার কাঁপা হাতের ছোঁয়া। মন্দ লাগে না অনিমেষের।
কিন্তু আজ কেন? এই তো গত মাসেই দেখিয়ে গেল।
ওদের জুড়ি-কে দেখলেই নয়না বলে, দাদু এ একদম– ‘পারমিতার একদিন’ কেস।
ঐ নামে নাকি একটা সিনেমা হয়েছিল।
ওর দিকে তাকাতে বেশ মজা করেই বলল, আজ একটু কেসটা অন্যরকম মনে হচ্ছে। সঙ্গে এক সাথী আছে।
বলতে বলতেই নয়নাকে প্রায় ঠেলেই বৃদ্ধার প্রবেশ।
উজ্জ্বল খুশি খুশি মুখ। — নাও ডাক্তার , তুমি আমার অপারেশনটা করেই ফেলো।
বৌমা কেমন অপরাধী অপরাধী ভাব করে দাঁড়িয়ে,– দেখুন না ক’দিন ধরে সমানে বলছে, আমায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে চল, আমার জরুরী দরকার আছে।
শোনো ডাক্তার– বৃদ্ধার গলায় যথেষ্ট জোর, ছোট একটা ব্যাগ থেকে একটা কাগজে মোড়া একটা কার্ড বার করে টেবিলে রাখল, এই কার্ডে পাঁচ লাখ টাকা আছে। এ নাকি ডাক্তারখানাতেই ভাঙানো যায়। তুমি একটা কিছু ব্যবস্থা করে আমার ঐ বৌমার হাতে লাখ চারেক তুলে দাও। আমি তো আজ আছি কাল নেই। ওর জন্যে এটা খুব দরকার।
নয়না ফুট কাটলো, আরে না, এ তো ‘পারমিতার একদিন’ নয় বহুদিন হয়ে গেল।
নয়না থামার পাত্রী নয়, –আর এই যে ঠানদি, আমার দাদু যে তোমায় এতোদিন ‘বালা’ পরিয়ে এলো তার কি হবে?
— হ্যাঁ রে মা, ভেবেছি, একলাখ টাকা তোর দাদুর। সত্যিই তো এতো বছর ধরে আমায় বালা পরাচ্ছে।
আমি আর নয়নাকে শেখাতে গেলাম না যে, ওটা বালা নয়, ‘রিং-পেসারি’। এক্ষুনি বলবে ঐ জন্যেই তোমরা এদের কাছে পৌঁছাতে পারো না।