ক্লিনিকের দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই শ্রীকান্ত হাজির–তুমি কি আজও চেম্বার খুলবে।
অনিমেষ ডাক্তার নিয়মমতো রোজই ডাক্তারখানা খুলে বসে।ওর অল টাইম অ্যাসিস্টান্ট শ্রীকান্ত যথারীতি করোনাসন্ত্রস্ত। তবু হাজির হতে হয় ক্লিনিক খোলা থাকলে।–তোমার তো ঐ ক’টা মাত্র পেশেন্ট।ও তুমি না বসলেও ক্ষতি নেই।
এটা অবশ্য সত্যি কথা। অনিমেষের রুগীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। শ্রীকান্তর এ নিয়ে দুঃখ তো আছেই। ওর বন্ধুরা দিনে দিনে চকচকে হয়ে উঠেছে। ওরা নাকি এখন কম্পিউটারে রুগীর নাম লেখে কাঁচের ঘরে বসে। আর বেচারি শ্রীকান্ত ডায়েরির পাতায়। তাও অনেক সময় একটা পাতাও ভরে না।
—নাঃ, এবার রুগী বসার ঘরে ওকে আলাদা চেয়ার টেবিল দিয়ে কাঁচের ঘেরাটোপ করে দেওয়ার প্রয়োজন আছে
–বলি আমার কথা নয়। বলি তোমারও তো নয় নয় করে পঁয়ষট্টি হলো। তুমি তো এখন বুড়োদের দলে-হাই রিস্ক।
এই একটা ব্যাপার কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না অনিমেষ। আজকাল ষাট-পঁয়ষট্টি বছরের কেউ মারা গেলেই কাগজে লিখে দিচ্ছে উনি ষাট বছরের বৃদ্ধ ছিলেন। যেন বাঁচার কথা ছিল না।
—তা হলে তুমি আজকেও চেম্বার খুলবে?
—আরে শোন না দুজন ফোন করেছিল, কি অসুবিধে হচ্ছে। তা একটু দেখে দিলে ক্ষতি কী! একজন হোক, দু-জন হোক, ওরা তো আমার ভরসাতেই থাকে। তা ছাড়া পাড়ার ছেলেরা, ওদের মধ্যে তোদের সব ছোট খাটো নেতারা ছিল, ওরা তো এসেছিল, বলল, ডাক্তার দা আপনি বসছেন এই সময়ে খুব ভালো। অনেকেই তো এখন রুগী দেখছে না। এইজন্য স্যার আপনাকে আমরা খুব ভালবাসি।
ঠোঁট ওল্টালো শ্রীকান্ত।–সে তো ওরা তোমার মাথা ভাঙবে বলে!
–মানে?
–কেন, ওরা তোমার থেকে চাঁদা নেয় নি?
—সে তো ওরা সব এলাকায় গরিব মানুষের জন্য কি সব ভালো কিছু করবে।
শ্রীকান্তর মুখ বাঁকানো হাসিটা অনিমেষ ডাক্তারের চোখের আড়ালেই রয়ে গেল।
দুজন পেসেন্ট দেখা হয়ে গেছে। অনিমেষ বসে দু-একটা লিটারেচারের পাতা ওল্টাচ্ছে, এমন সময় পুলিশের জিপটা গেটের সামনে এসে থামল।
স্মার্ট চেহারার অফিসার ছেলেটি চেম্বারের দরজায় এসে দাঁড়াল,– স্যার আসতে পারি?
–হ্যাঁ হ্যাঁ, আসুন ।
–দেখুন তো স্যার, এই প্রেসক্রিপসনটা আপনার কি না?
অনিমেষ কাগজটা হাতে নিয়ে দেখল, হ্যাঁ ঠিক দিন পাঁচেক আগে চেক আপ করিয়ে গেছে। সন্তান সম্ভবা।পাঁচ মাস চলছে।
–হ্যাঁ, মেয়েটির ভাসুর কোভিড পসিটিভ। পুলিশ অফিসার বলে চলেছেন, –একই বাড়িতে থাকে, মেয়েটিকেও আমরা সাসপেক্ট হিসেবে ক্লোজ মনিটরিং-এ রেখেছি। আপনি স্যার এই সময়টা বাড়িতেই থাকুন আর চেম্বারটা বন্ধ রাখুন। ঐ হোম কোয়ারান্টাইন আর কি! টাইম টু টাইম আমরা খবর নিয়ে যাব।
জানলা দিয়ে অনিমেষ লক্ষ্য করছিল, পুলিশের জিপটা ঘিরে ছোট জটলা। পুলিশের জিপ চলে যাবার পরেও জটলা সরল না বরং বাড়তে লাগল।
এর মধ্যেই শ্রীকান্ত এসে জানাল, ওরা কথা বলতে চায়।
–কারা?
–ঐ লোকাল ক্লাবের ছেলেরা।
–আসতে বল।
ওরা কয়েকজন দরজার বাইরে দাঁড়াল।
— কাম ইন, ভেতরে এসো।
–না স্যার ঠিক আছে ।
অনিমেষ লক্ষ্য করল, দুদিন আগে যারা প্রায় গা ঘেঁষে কথা বলে গেছে আজ তারা সোস্যাল ডিসট্যান্সিং নিয়ে ভীষণ সচেতন। — আপনি স্যার কোভিড পেসেন্ট, এখানে থাকাটা কি ঠিক হচ্ছে।
— তোমাদের কে বলল আমি কোভিড পেসেন্ট?
— আমরা জেনে গেছি স্যার, লুকিয়ে লাভ নেই ।
নীচে কিছু লোকের চিৎকার শোনা যাচ্ছে,–অত ধানাইপানাই এর কি আছে, সোজা গিয়ে কোভিড হাসপাতালে ভর্তি হোক।
–‘কিন্তু আমায় তো হোম কোয়ারান্টাইনে থাকতে বলেছে’–অনিমেষ ডাক্তারের ভয়ার্ত গলা।
–ওসব ছাড়ুন। পাড়ার মধ্যে জ্যান্ত কোভিড পুষে রাখতে পারব না।
–এই বয়সেও শালা পয়সার লোভ গেল না। গত পরশুই আমার বোনকে দেখালাম, একবারও বলেনি ও কোভিড।
ছেলেটিকে আড়চোখে দেখল অনিমেষ, দুদিন আগে কোনো ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছে না বলে বোনকে দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। একদম পাশেই থাকে বলে অবিনাশ আর ভিজিটটাও নেয় নি।
ইতিমধ্যে জনসমাগম আরো বেড়েছে। মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান সাহেবও হাজির। সেই পুলিশ অফিসার ভীড় ঠেলে চেয়ারম্যান সাহেবকে নিয়ে ঢুকলেন।– স্যার, আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।
–কোথায়?
–হাসপাতালে।
–কিন্তু আপনিই তো বললেন বাড়িতে থাকতে।
–এখন স্যার, আমাদের ওপর প্রবল চাপ। আপনার হাসপাতালে থাকাই ভালো।
–কিন্তু আমার টেস্ট তো হোক।
এবার একজন খিঁচিয়ে উঠলেন,–টেস্ট, টেস্ট। আরে বাবা টেস্ট কি এমনি হবে? কিট লাগে, কিট। কিট কোথায়?
আপনার অতো পজিটিভ নেগেটিভ জানার দরকার কী?–আবার সেই রোগিণীর দাদার কর্কশ কন্ঠ, –রোগ হয়েছে হাসপাতালে যাবেন চিকিৎসা হবে, ব্যাস।
সুতরাং সবাই মিলে অ্যামবুলেন্সে তুলে দিল অনিমেষকে। আশ্রয়চ্যুত হবার আগে বাড়ির দিকে তাকাল অনিমেষ ডাক্তার, সাধ করে বাড়ির নাম রেখেছিল ‘আশ্রয়’। গাড়ি সামান্য এগোতেই…