এ বছর ভাষা দিবসে ডক্টর্স ডায়ালগ-এর বার্ষিক অনুষ্ঠানে একগুচ্ছ বই প্রকাশিত হল, সে কথা আগেই বলেছি। লেখক-লেখিকারা পূর্বপরিচিত তো বটেই, সকলেই প্রায় আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধা/ভালোবাসা/স্নেহের পাত্র/পাত্রী। সুতরাং অনুষ্ঠানটি বেশ একটা ফ্যামিলি গেট-টুগেদারের চেহারা নিয়েছিল। আর গেট-টুগেদার যেহেতু, বেশ হইহইয়ের পরিবেশ। হইহই এতখানিই যে মঞ্চ থেকে সঞ্চালকরা রীতিমতো ধমকচমক দিয়ে শান্ত হতে ‘অনুরোধ’ করছিলেন, করতে বাধ্য হচ্ছিলেন।
এমন আড্ডার মধ্যেই এক মেয়ে খুব লাজুক মুখে আড্ডা থেকে আলাদা হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। মেয়েটি মুখচেনা, কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছিলাম না। আমাকে ডাকল। একখানা বই হাতে নিয়ে বলল, স্যার, আমাদের বইটা আপনি যদি পড়েন, আমার খুব ভালো লাগবে।
রাণিমা নাইটহুড না দিলেও স্যার সম্বোধন আমার আজকাল গা-সওয়া হয়ে গেছে। প্লাস, বাবা-মা কলেজে পড়াত বলে শব্দটা বংশানুক্রমে কান-সওয়াও বটে। কাজেই, সম্বোধনটা গায়ে মাখলাম না। বিভিন্ন জায়গায় এমন করে বেশ কিছু বই প্রাপ্তি হয়, সেও অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। সেসব বইয়ের অনেকগুলো পড়া হয় না, তেমন অভ্যেসও। না, ইচ্ছে করে পড়ি না এমন নয়। আসলে আজকাল পড়াটা নির্দিষ্ট পথ অনুসারে এগোয়। আচমকা নতুন বই পড়ে ওঠা মুশকিল। তবু একগাল হাসি নিয়ে বললাম, বাঃ, খুব ভালো, অবশ্যই পড়ব। তোমার নামটা যেন কী? রুমেলিকা। বইটির নাম – বিজ্ঞান বিশ্বে এদেশের মেয়েরা।
বিষয়ের কারণেই বাড়ি এসে বইটা ধরলাম। ক্যাজুয়ালি। খুব বেশি আশা না নিয়েই। কেননা, বিষয় ইন্টারেস্টিং হলেও লিখতে পারাটা সবসময় ভালো হয়ে ওঠে না। ইদানীং প্রকাশিত অধিকাংশ নন-ফিকশনই তেমন। এই বইটিকে ব্যতিক্রম ভাবার কোনও কারণ ছিল না।
এদেশের বিভিন্ন বিজ্ঞানী-নারী নিয়ে লিখেছেন বিভিন্ন লেখক। লেখক তালিকার অধিকাংশই নারী। তো সেই সব লেখাপত্র মিলিয়ে এই বই। প্রচ্ছদ কিংবা প্রথম পাতা, কোথাও সম্পাদকের নাম নেই। দ্বিতীয় পাতায়, প্রকাশক-প্রচ্ছদশিল্পী-মুদ্রক-এর নাম যেখানে, সেখানে রয়েছে সম্পাদক (শুভাশিস মুখোপাধ্যায়) ও সহসম্পাদকদের নাম (অরিজিৎ, অর্ক, ঈশিতা, শোভন)।
বইটির নির্মানগুণ তথা লিখনশৈলী বিষয়ে প্রত্যাশা খুব কম থাকার কারণেই কিনা জানি না, পড়তে বসে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এককথায় অনবদ্য। প্রসঙ্গক্রমে জানাই, বইয়ের ব্যাপারে আমি বেশ খুঁতখুঁতে। চট করে উচ্ছ্বসিত হতে পারি না। এই বই সত্যিই মুগ্ধ করেছে। বিষয়, তথ্য, সম্পাদনা ও লিখনের গুণ, সব দিক থেকেই।
মোট পঁয়ত্রিশজন ভারতীয় বিজ্ঞানী-নারীর সংক্ষিপ্ত জীবনী দিয়ে তৈরি এই বই। তাঁদের জীবনের সঙ্গে পরিচয় তো দূর, অকপটে বলি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের নাম অব্দি শুনিনি। কাদম্বিনী গাঙ্গুলি বা প্রথম ভারতীয় পাস-করা মহিলা ডাক্তার আনন্দীবাঈ যোশী (এ বইয়ে আনন্দীবাঈ-এর তথ্যসমৃদ্ধ এবং সুখপাঠ্য জীবনীটি রুমেলিকার লেখা) অথবা আন্টার্কটিকা-খ্যাত সুদীপ্তা সেনগুপ্ত বা কল্পনা চাওলার নাম অবশ্যই শুনেছিলাম। কিংবা, বছরকয়েক আগে আচমকা গুগল-ডুডলে এক অপরিচিতা বাঙালি বিজ্ঞানীর জন্মশতবর্ষ উদযাপনের সুবাদে অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের নামও, অ্যাক্সিডেন্টালি যদিও।
পুরুষ-নারী নির্বিশেষে, দেশের বিজ্ঞানীদের নাম আমরা তেমনভাবে জানি না, হাতে-গোনা চার-পাঁচজনের নাম বাদে। দেশ-বিদেশ নির্বিশেষেই বর্তমানে যাঁরা গবেষণা করছেন তাঁদের নামও বিশেষ জানি না। অতএব, বিজ্ঞানী-নারী, যাঁরা ইতিহাসে অবহেলিত, তাঁদের খোঁজ যে আমরা রাখব না, সে তো খুবই স্বাভাবিক। এই অপরিচিতি থেকে মুক্তি দিতে প্রকাশিত হয়েছিল লীলাবতী’জ ডটার্স। ইন্ডিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্স থেকে। দুই সম্পাদক রোহিনী গোডবোলে আর রামকৃষ্ণ রামস্বামী। বিজ্ঞানী-নারী বিষয়ে আমাদের অনাগ্রহের প্রমাণ, চমৎকার বইটি এখন দুষ্প্রাপ্য। আমাদের আলোচ্য বইটির ক্ষেত্রে এই লীলাবতী’জ ডটার্স আকরগ্রন্থ হিসেবে কাজ করেছে। সম্পাদকদ্বয় এই বইয়ের জন্য সংক্ষিপ্ত দু’খানি শুভেচ্ছাবার্তাও লিখে দিয়েছেন। নিছক শুভেচ্ছাবার্তা নয়, সেখানে উঠে এসেছে সেই ল্যান্ডমার্ক সঙ্কলনটি তৈরির সময় নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা। বর্তমান সঙ্কলনের সম্পাদক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক শুভাশিস মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকাটিও গুরুত্বপূর্ণ।
তবে এ বইয়ের বাকি লেখাপত্রকে প্রেক্ষিত দিতে পেরেছে শ্রীরূপা মান্নার নিবন্ধ – বিজ্ঞান গবেষণায় লিঙ্গবৈষম্য। বইয়ের মধ্যে কোনও একটি নিবন্ধকে অবশ্যপাঠ্য হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইলে, এটিই।
ভিন্ন প্রসঙ্গে গিয়ে বলি, সত্তরের দশকের একদম শুরুতে লিন্ডা লখলিন নারীবাদী শিল্প-আলোচনাকে গুরুত্বের জায়গায় স্থাপন করেন তাঁর হোয়াই হ্যাভ দেয়ার বিন নো গ্রেট উইমেন আর্টিস্টস নিবন্ধের মাধ্যমে। সেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন, মেয়েদের মধ্যে গ্রেট আর্টিস্টের সংখ্যা কম, বা প্রায় নেই, কেননা সামাজিক বিধিনিষেধ ও সমাজব্যবস্থা। শিল্পী হয়ে ওঠার জন্য জরুরি শিক্ষা বা পরিবেশ কোনোটিই মেয়েরা পাননি। কাজেই, প্রতিভাবান থেকে গ্রেট আর্টিস্টে পরিণত হয়ে ওঠার সুযোগই তাঁদের সামনে ছিল না।
সে কথা মাথায় রেখেও বলা যায়, সামাজিক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করেই আমরা পেয়েছি অনেক ‘গ্রেট উইমেন আর্টিস্ট’-কে। কিন্তু তাঁদের খবর আমরা কম পেয়েছি। তিনতোরেত্তোর কন্যার খ্যাতি চাপা পড়ে গিয়েছে বাবা-র নামের তলায়। জুডিথ লেস্টারের ছবিকে চিনেছি ফ্রানজ হালস-এর ছবি হিসেবে। মেরি কাসাত বাকি ইম্প্রেশনিস্টদের সমান স্বীকৃতি পাননি। বা জর্জিয়া ও’কীফ পাননি বাকি এক্সপ্রেশনিস্টদের মতো পরিচিতি।
বর্তমান আলোচ্য গ্রন্থের শেষে সংযোজিত হয়েছে অধ্যাপনা-গবেষণারত কিছু বিজ্ঞানী-নারীর অভিজ্ঞতা। এই অংশটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এবং চোখ খুলে দেওয়ার জন্য জরুরিও। প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপিকা সুচেতনা চ্যাটার্জি যেমন বলেন – “‘মহিলা বিজ্ঞানী’ কথাটির মধ্যেই কিন্তু বৈষম্যের বীজ লুকিয়ে আছে। আমরা কখনোই বলি না পুরুষ বিজ্ঞানী, সাধারণত বলি ‘বিজ্ঞানী’ আর ‘মহিলা বিজ্ঞানী'”।
খুবই ঠিক কথা। আবারও ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। চার দশক আগে গ্রিসেল্ডা পোলক এবং রোজিকা পার্কার খুঁজে দেখেছিলেন শিল্প-আলোচনার ভাষাচয়ন এমনই, যেখানে নারীদের প্রসঙ্গ উচ্চারণ দুরূহ। যেমন ধরুন, গ্রেট আর্টিস্টদের, বিশেষ করে পুরনো শিল্পীদের প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয় মাস্টার বা ওল্ড মাস্টার শব্দ। যা পুংলিঙ্গ-বাচক। নারীদের জন্য তাহলে কী ব্যবহৃত হবে? মাস্টারের লিঙ্গান্তর ঘটিয়ে মিসট্রেস? কিন্তু শুধু মিসট্রেস শব্দটির মধ্যে তো এক ভিন্ন দ্যোতনা রয়েছে, যা কিনা তেমন সম্মানজনক নয়। তাহলে? শিল্প-আলোচনায় পোলক-পার্কারের ‘ওল্ড মিসট্রেসেস – উইমেন, আর্ট অ্যান্ড আইডিওলজি” বইটি ল্যান্ডমার্ক। সেখানেই তাঁরা বলেছিলেন, নারী-শিল্পী শব্দটির মধ্যে শিল্পীদের লিঙ্গপরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। অতএব ব্যবহৃত হোক আর্টিস্ট-ওম্যান বা শিল্পী-নারী শব্দবন্ধ।
সেই উদাহরণ মেনে, বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হোক নারী বিজ্ঞানী নয়, বিজ্ঞানী-নারী শব্দ।
আমাদের ধারণা হতে পারে, শিল্প-চারুকলা ইত্যাদি চিরকালই রাজানুগ্রহের উপর নির্ভরশীল। কখনও সেই রাজা প্রকৃত অর্থেই রাজা, কখনও বা উচ্চবিত্ত ক্ষমতাসীন শ্রেণী, কখনও বা বাজার। এবং শিল্পের মান-যাচাইয়ের পদ্ধতিটিও তো নৈর্ব্যক্তিক নয়। অনেকাংশে বাজার ও শিল্প-সমালোচকদের বিচার নির্ভর। সেখানে বিজ্ঞানচর্চা ও তজ্জনিত সাফল্য-অসাফল্যের হিসেবনিকেশ একেবারেই নৈর্ব্যক্তিক।
বইটি পড়ুন। বিজ্ঞানের জগত, বিজ্ঞানচর্চা বা গবেষণার জগৎ কি ততই নৈর্ব্যক্তিক? ছিল কি? এখনও কি রয়েছে??
একটা বয়স পার করে ব্যক্তিগত ভাবনাচিন্তার বায়াস অগ্রাহ্য করতে পারা কঠিন। অসম্ভব হয়ত নয়, কিন্তু কঠিন। চেষ্টা করা যায় অবশ্যই৷ সুতরাং বইটা পড়ে দেখুন।
কিন্তু মনের ভাবনাচিন্তা তৈরি হওয়ার সময়, অর্থাৎ কিশোরবেলায়, এমন বই খুবই জরুরি। বয়ঃসন্ধির বয়সে বাড়ির বাচ্চাদের হাতে তুলে দিন এই বই।
বিজ্ঞান বিশ্বে এদেশের মেয়েরা
প্যারালাল
দুশো টাকা