সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রসঙ্গে জিজেক বলেছিলেন, ট্রুথফুলনেস এবং ফ্যাকচুয়াল ট্রুথ সবসময় একই হয় না। মানে সত্য বললেও তা সবক্ষেত্রে প্রমাণযোগ্য সত্যের সঙ্গে মেলে না। হলোকস্ট থেকে, কনসেনট্রেশান ক্যাম্প থেকে বেঁচে ফিরে তার স্মৃতিচারণ যাঁরা করেছেন, দেখা গিয়েছে তার সবকিছু হুবহু বাস্তব হয়তো নয়। কিন্তু তাঁদের সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলোর স্মৃতিটুকু তো ভুল নয়।
সেই কথাটিকে অপ্রাসঙ্গিক প্রয়োগ করে বলি, অসুখের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমন।
একজন মানুষ অসুস্থ বোধ করতে পারেন, করেন। বিস্তর পরীক্ষানিরীক্ষার শেষে দেখা গেল, না, তেমন কিছুই শারীরিক অসুস্থতা তাঁর নেই। নেই এমনকি তেমন মানসিক অসুখও। তাহলে কি তাঁর সেই অসুস্থতার বোধটুকুকে আমরা মিথ্যে বলে দাগিয়ে দেব?
এই কথাটুকু বুঝতে পারলেই আমরা বুঝতে পারব, এদেশে এত বিভিন্ন চিকিৎসা-পদ্ধতির এমন রমরমা কেন? বিশেষত, এমন অনেক চিকিৎসা-পদ্ধতি, যার মধ্যে বিজ্ঞান বিশেষ নেই? বিজ্ঞান থাকুক বা না থাকুক, সেই পদ্ধতির চিকিৎসায় যদি ‘অসুস্থ’ মানুষ নিজের ‘অসুখ’-এর সুরাহা না পান, তাহলে সে ব্যবস্থা কি টিকে থাকতে পারত?
এই প্রেক্ষিতটা মাথায় রেখেই আমাদের পড়তে হবে এই বই। বইয়ের নাম, চার ডাক্তার। লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তী।
চারখানা পৃথক আখ্যানের সমষ্টি এই বই। আখ্যানগুলি বিভিন্ন সময়ে লিখিত ও প্রকাশিত, সম্পূর্ণ আখ্যান হিসেবেই। তাসত্ত্বেও চারখানি মিলেমিশে বইটিকে একটিই কাহিনীতে পরিণত করেছে, করতে পেরেছে।
তিনটি আখ্যানের কেন্দ্রে তিনজন মানুষ। প্রথমজন হাতুড়ে। দ্বিতীয় আখ্যানের কেন্দ্রীয় চরিত্র এক হোমিওপ্যাথ। তৃতীয় আখ্যানের উপজীব্য আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান তথা মডার্ন মেডিসিনের ডাক্তার, লেখক যাঁকে অ্যালোপ্যাথ বলেছেন। বলা বাহুল্য, এই অ্যালোপ্যাথ শব্দটি মডার্ন মেডিসিনের ডাক্তারদের মনঃপূত নয়, কেননা ঠিক এমন শব্দ আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে নেই। শব্দটি হোমিওপ্যাথির বিপরীত হিসেবে হোমিওপ্যাথির আদিপুরুষরা ব্যবহার করেছিলেন, খুব সম্মানজনক অর্থে এমন নয়। সে যা-ই হোক, শব্দটি বাজারে চালু – এবং লেখকের এই শব্দের ব্যবহারে কোনও রকম অসম্মানের উদ্দেশ্য নেই। সুতরাং…
চতুর্থ তথা শেষ আখ্যানের নাম – ডাক্তার, বিশেষণহীন। কলকাতার অনতিদূরে এক গ্রাম্য এলাকায় জনৈক গৃহবধূকে সাপে কাটে। বধূ তখন গর্ভবতীও বটেন। শুরুতে মসজিদে ইমামের দোয়া পড়া, তারপর স্থানীয় হাসপাতাল – সেখান থেকে সরকারি মেডিকেল কলেজ। আখ্যানের পরতে পরতে মিশে আছে সমকালীন বাস্তবতা। রাজনৈতিক দাদাদের নাম করে চোখরাঙানি। পাড়ার ওস্তাদদের পরিজন হয়ে এসে তড়পানি। ধর্মীয় সংস্কার। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার অপ্রতুলতা। যাবতীয় তড়পানি-হুমকি অগ্রাহ্য করে প্রায় নির্বিকল্প দশা প্রাপ্ত হয়ে চিকিৎসকদের নিরলস প্রয়াস। হিপোক্রেটিক ওথ-এর প্রসঙ্গ।
প্রথম আখ্যানের মুখ্য চরিত্র ভজন মৃধা বাবার কাছ থেকে “ডাক্তারি” শেখে। বাবা ছিলেন সরকারি মর্গে স্টোরকিপার। “ডাক্তারি”-র সঙ্গে পরিচয় সেই সুবাদেই। ভজন অবশ্য এমডি। এমডি (এ.এম), অর্থাৎ অল্টারনেটিভ মেডিসিন। ভজনের শখ, ছেলে যেন পাস করা ডাক্তার হয়। জয়েন্ট এন্ট্রান্সের ছেলে অসফল হলে অন্য পথের খোঁজ শুরু হয়। যোগাযোগ হয় ‘ফিউচার বিল্ডার্স’-এর সঙ্গে – নামেই মালুম, যাদের লক্ষ্য ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ তৈরি। যোগাযোগ হয় নিত্যানন্দ পাড়ুইয়ের সঙ্গেও। নিত্যানন্দ অর্ডার সাপ্লায়ার্স। কিডনির অর্ডার। হিপোক্রেটিস কিংবা চরক, কারও নামাঙ্কিত শপথ পাঠের সুযোগ না হলেও, ভজন ‘ডাক্তার’। বইয়ের চার ডাক্তারের অন্যতম। কিছু দায়বদ্ধতা তো তারও থাকে। সেই নীতিবোধ থেকে বিচ্যুত হওয়া তো সহজ নয়।
তৃতীয় আখ্যানের ব্যস্ত প্র্যাক্টিশনার ডাঃ মৃত্যুঞ্জয় মাসচটক, শহরে যাঁর রমরমা প্র্যাক্টিস, শহরের উপকণ্ঠে বনেদি পারিবারিক ভিটেয় এসে তিনিও মুখোমুখি হন চিকিৎসকের দায়বদ্ধতার। যে দায় বা দায়িত্বর কথা, সম্ভবত, ভুলেই ছিলেন তিনি। বয়সে অনেক ছোট সরকারি হেলথ সেন্টারের ডাক্তার ডা ইন্দ্রাণী রায়। এমনকি রিকশাচালক, যে কিনা বাপ-ঠাকুরদার কাছে শিখে আয়ুর্বেদিক টোটকা চিকিৎসার অল্পবিস্তর খবর রাখে, তার কাছেও শেখেন, চিকিৎসকের দায়িত্ব।
দ্বিতীয় আখ্যানের নায়ক কমল। হোমিওপ্যাথ। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করে বটে, কিন্তু সে চিকিৎসার বিজ্ঞান বিষয়ে কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারে না। কলেজে পড়ার সময়ও প্রশ্ন করত স্যারেদের – কেন ওষুধের শিশিটা দশবার ঝাঁকালে ওষুধের শক্তি বেড়ে যাবে? উত্তর পায়নি। যত ডাইলিউশন, তত নাকি আয়নিফিকেশন। কিন্তু সব যৌগ তো জলে আয়ন হয় না, সব মৌলও না। যাদের হয়, তাদেরও তো আয়নিফিকেশনের সীমা আছে। তাহলে? উত্তর পায়নি। তবু কমল চিকিৎসা করে। সন্দিহান হয়েও করে। চিকিৎসায় ফল পেলে বিস্মিত হয়। রোগীর গলায় মাছের কাঁটা বিঁধলে সাইলেসিয়া প্রয়োগ করে। রোগীর বাড়ির লোক খবর দেয়, হ্যাঁ, কাঁটা গলে বেরিয়ে গিয়েছে। কমল বাড়িতে মাছের কাঁটা ওষুধের মধ্যে ভিজিয়ে পরীক্ষা করে। কোনও পরিবর্তন দেখতে পায় না। নিজের চিকিৎসায় স্ত্রীয়ের অসুখ কমে না – অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খাওয়াতে হয়। ওষুধের দোকানদারের শ্লেষের উত্তরে জবাব দেয়, অনেক অ্যালোপ্যাথও তো হোমিওপ্যাথি ওষুধ খায়, তাহলে? আর খুঁজতে থাকে, নামী-অনামী পত্রিকায়, হোমিওপ্যাথির পক্ষে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ। একা হয়ে। আশেপাশের বস্তির মানুষের কাছে ভগবানতুল্য হয়েও।
এ এক আশ্চর্য বই। স্বপ্নময় চক্রবর্তী অসাধারণ লেখক। এ বই তাঁর সেরা বইগুলোর অন্যতম হয়ত নয়, তবুও বলি এ বই আশ্চর্য। টুকরো টুকরো দৃশ্যকল্পের মিশ্রণে তিনি এঁকেছেন আমার আপনার দেশের ছবি, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ছবি। এবং সেই দেখার চোখ আশ্চর্য প্রসন্নতা আর মায়ায় মাখা।
স্বপ্নময় চক্রবর্তীর লেখালিখির সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁদেরকে তাঁর লেখার প্রসাদগুণ ও আমাদের আশেপাশের দেখা-নাদেখা বাস্তবজগতের সঙ্গে তাঁর লেখনীর যোগাযোগের নিবিষ্টতা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তাই বলছিও না।
শুধু বলি, বইটা পড়ুন। পড়ে দেখুন।
চার ডাক্তার
স্বপ্নময় চক্রবর্তী
পত্র ভারতী
দুশো টাকা