যেদিকে তাকাচ্ছি জ্বর-সর্দিকাশি, শ্বাসকষ্টের রোগী। এই পরিস্থিতিতে ইনহেলার চিকিৎসা নিয়ে কিছু প্রাথমিক ধারণা দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলুন, জেনে নেওয়া যাক…
১.
শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় সব বয়সের জন্যই ইনহেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা। ইনহেলারের মাধ্যমে খুব অল্পমাত্রায় কিছু ওষুধ সরাসরি শ্বাসযন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়।
২.
ইনহেলার মূলত দু’ধরনের। একটা শ্বাসনালী ফোলানোর আর একটা প্রদাহ কমানোর। শ্বাসনালী ফোলানোর ওষুধের আবার দুটো ভাগ হয়- একটা স্বল্পস্থায়ী অন্যটা দীর্ঘমেয়াদী। এই আলোচনায় আমরা অত জটিলতায় না গিয়ে তাদের শুধুমাত্র ‘শ্বাসনালী ফোলানোর ওষুধ’ হিসেবেই ধরবো। প্রদাহ কমানোর ওষুধ স্টেরয়েড।
৩.
প্রদাহ কমানোর ওষুধ সাধারণত একটানা দীর্ঘদিন ব্যবহার করে যেতে হয়। শ্বাসনালী ফোলানোর ওষুধ সাধারণত শুধুমাত্র শ্বাসকষ্টের সময়ই দেওয়া হয়। যদিও অবস্থাভেদে হঠাৎ শ্বাসকষ্টের জন্যও আপনার ডাক্তার প্রদাহ কমানোর ওষুধ দিতে পারেন। সে সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে আপনার ডাক্তারের ওপরে ছেড়ে দিন।
৪.
সরাসরি শ্বাসনালীতে গিয়ে কাজ করে এবং খুব কম ডোজে ব্যবহার হয় বলে ইনহেলার চিকিৎসায় মুখে খাওয়ার ওষুধের চেয়ে অনেক কম পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হয়। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা যাক ‘পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াহীন চিকিৎসা’ একটি বিশুদ্ধ সোনার পাথরবাটি। ওষুধের ক্রিয়া থাকলে তার অল্প হলেও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া থাকতে বাধ্য। বাজারে ‘পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াহীন’ চিকিৎসা বলে যা যা পরিচিত সেগুলো অবৈজ্ঞানিক।
৫.
কাশির সিরাপ বা বড়ির মাধ্যমে ওষুধ ব্যবহার করতে গেলে তা প্রথমে লিভারে যায় তারপর সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়। ফলে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি হয়। তাছাড়া শ্বাসনালী ফোলানোর ওষুধ মুখে খেলে লিভারে গিয়ে বেশিরভাগটাই নষ্ট হয়ে যায়। ফলে শ্বাসনালীতে আদৌ কতটা পৌঁছোয় সে নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
৬.
ইনহেলার নিলে ‘অভ্যেস হয়ে যায়’, ‘শরীরে প্রচুর ক্ষতি করে’, ‘আর কোনও ওষুধ কাজ করে না’, ‘কোনোদিন ছাড়া যায় না’ এসব কথার মধ্যে কানাকড়িও সত্যি নেই। আর নিজের শরীর ভালো রাখতে পাড়া-পড়শী বা গুগল নয়, আপনার ডাক্তারের ওপর ভরসা রাখুন।
৭.
শ্বাসনালী ফোলানোর ওষুধে হাত-পা কাঁপা, পেশী দৌর্বল্য, রক্তে পটাশিয়াম কমে যাওয়া এসব পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয়। তবে, অবশ্যই মুখে খাওয়ার চেয়ে অনেক কম পরিমাণে। আর স্টেরয়েড শুনে আঁতকে ওঠার কারণ নেই। মুখে খাওয়া বা ইঞ্জেকশন স্টেরয়েডের যেসব পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হয় তার প্রায় কিছুই স্টেরয়েড ইনহেলারে হয়না বললেই চলে। মূলত মুখে ছত্রাকঘটিত সংক্রমণ আর গলার ইনফেকশনই মূল সমস্যা।
৮.
বেশি করে ফল খান। ফলে প্রচুর পটাশিয়াম থাকে। তাতে শ্বাসনালী ফোলানোর ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কমে। স্টেরয়েড ইনহেলার নিলে প্রতিবার অবশ্যই মুখ ধোবেন। মুখে ছত্রাকঘটিত ইনফেকশন হলে আপনার ডাক্তার প্রয়োজনীয় ছত্রাকনাশক ওষুধ দেবেন।
৯.
বাচ্চাদের জন্য অবশ্যই স্পেসার (প্লাস্টিকের বোতলের মতো দেখতে) ব্যবহার করা দরকার। স্পেসারের মাউথপিসে মুখ দিয়ে বা মাস্কের মাধ্যমে ইনহেলার ব্যবহার করা যায়। স্পেসার ব্যবহার করলে ওষুধ মুখগহ্বরের মধ্যেই জমে গিয়ে নষ্ট হওয়া আটকানো যায়। তাই বড়োরাও স্পেসার ব্যবহার করলে বেশি ভালো ফল পাবেন।
১০.
আমরা মাস্ক দেওয়া স্পেসার সহ ইনহেলার দেওয়ার পদ্ধতি আলোচনা করবো। ইনহেলারের ডোজ নির্দেশক জায়গাটা দেখে নিতে হবে। এর দ্বারা আর কতটা ওষুধ বাকি আছে তার আন্দাজ পাওয়া যায়। ‘শূন্য’ হয়ে যাওয়ার পরেও ইনহেলারের প্রোপেল্যান্টের জন্য গ্যাসীয় কিছু বেরিয়ে আসতে পারে। সেটাকে ওষুধ বলে গণ্য করা যাবে না। ইনহেলার জলে ডুবিয়ে দেখুন। ওষুধ শেষ হয়ে গেলে ইনহেলার জলের ওপরে ভেসে যাবে।
১১.
ইনহেলার প্রথমে লম্বালম্বি ঝাঁকিয়ে নিতে হবে। তারপর মাউথ পিসের সামনের ক্যাপ খুলে স্পেসারের পেছনে লাগাতে হবে। মাস্ক লাগানোর সময় দেখে নিতে হবে নাক এবং মুখ দুটোই যাতে মাস্কের মধ্যে থাকে। বিশেষত নাক এবং চিবুকের জায়গায় কোনও ফাঁক থেকে যাচ্ছে কিনা দেখতে হবে। বাম হাত (বা নন-ডমিন্যান্ট হ্যান্ড) মাস্কের ওপর রাখতে পারলে ভালো। স্বাভাবিক শ্বাস নেওয়া আরম্ভ করুন এবং ইনহেলারের পেছনের দিক চেপে দিন। একবার চাপলে এক ‘পাফ’ ওষুধ বেরিয়ে আসে। পাঁচ থেকে দশবার স্বাভাবিক শ্বাস নিন। দ্বিতীয় পাফ নেওয়ার আগে অন্তত ৩০ সেকেন্ডের ব্যবধান রাখুন।
১২.
স্পেসার মাঝে মাঝে হাল্কা গরম জলে পরিষ্কার করতে হবে, অন্তত মাসে একবার। একবছর ব্যবহারের পর স্পেসার পাল্টে ফেলা উচিত।
১৩.
ইনহেলারের ডোজ এবং কতদিন দিতে হবে সেটা চিকিৎসক ঠিক করবেন। নিজেরা আপৎকালীন চিকিৎসা হিসেবে শ্বাসনালী ফোলানোর ওষুধ কয়েকবার দিতে পারেন। তারপর অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
এত কথা বলার মূল উদ্দেশ্য এটাই- নির্ভয়ে ইনহেলার নিন। বাজারে levolin, asthalin, salbair ইত্যাদি নামে শ্বাসনালী ফোলানোর ওষুধ এবং budecort, budate ইত্যাদি নামে প্রদাহ কমানোর ওষুধ পাওয়া যায়। zerostat-VT with infant mask, transpacer-VM, huf-puf kit ইত্যাদি স্পেসার পাওয়া যায়। কোন স্পেসার আপনার বাচ্চার উপযুক্ত হবে সেটা ভালো করে দেখে নেবেন। স্পেসার খুব ছোট বা বড় হ’লে ওষুধ নষ্ট হবে।
আর বারবার করে বলতে থাকুন-
মাস্ক পরবো, হাত ধোবো, অপ্রয়োজনীয় ভিড়ভাট্টা এড়াবো, ভয় পাবো না, আশেপাশের পাঁচজনকে সচেতন করবো।
(ছবি গুগল থেকে নেওয়া)