সালটা ছিল ১৯৬৫, খড়গপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম। মাঝরাতে আমরা সবাই বসে আছি, রাঁচি এক্সপ্রেস ধরে রাঁচী যাবো। হঠাৎই দেখি আমার বড়দিকে মা শাড়ি পরিয়ে আনলো। তারপরেই কিছু লোকজনের আগমন হলো। জানতে পারলাম বড়দিকে দেখতে এসেছে পাত্রপক্ষ। পাত্রের বাবা খড়গপুরের রেলের অফিসার। আদিবাড়ি বারুইপুর। আর পাত্র ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টের চাকুরে। ঐ আধো অন্ধকারে তারা পাত্রী দেখে চলে গেল। সেই স্বল্পালোকে দিদির রূপের ছটায় ভদ্রলোক ঝলসে গেলেন, সেটা টের পেলাম আমাকে সঙ্গে নিয়ে স্টেশনের স্টলে গিয়ে চকোলেট কিনে দেওয়ার মাধ্যমে তাঁর স্বীকৃতিতে, ‘আমরা শিগগিরই আসছি, আবার দেখা হবে।’ আমরা রাঁচী চলে এলাম। সেই থেকেই রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে মাঝরাতে একাকী জ্বলতে থাকা টিউবলাইটের আধো অন্ধকার আলোকে আমার কনে দেখা আলো বলে মনে হয়।
কিছুদিন পরেই সেই মাঝরাতে খড়গপুর স্টেশনে দেখতে আসা লোকজন হঠাৎই আমাদের দুকামরার রেলের কোয়ার্টারে সদলবলে এসে হাজির।
পাত্র ব্যস্ত মানুষ, বেশি সময় নেই, সে দিদিকে বিয়ে করে নিয়ে যেতে এসেছে।
একটা রুমে মেয়ের গায়ে হলুদ, অন্য রুমে ছেলের গায়ে হলুদ পড়লো। রেল কলোনীর লোকজন হৈহৈ করে উঠলো, আমাদের নতুন দুলাভাই জুটলো। সে মোটেই গম্ভীর স্বভাবের নয়। বেজায় রসিক।
সেই দুলাভাই ভিলাইতেই ঘরবাড়ি বানিয়েছে। গতবছর তার মেজছেলে MD skin, দিল্লিতে থাকে, দ্বারকায়, তার কাছেই কাটিয়েছে। গতমাসে ভিলাইতে নিজের বাড়িতে এসেছিল। সপ্তাহখানেক আগে করোনায় ভুগে আমাদের ছেড়ে বরাবরের জন্য চলে গেল হঠাৎ। তার দুই ডাক্তারপুত্র, বড় ছেলে নেভির ডাক্তার, বাবার পাশে ছিল। তাদের কাছেই শুনেছি, ছত্তিশগড়ে ব্যাপক করোনায় ছেয়ে গেছে। হাসপাতালে বেড নেই। দুলাভাই যে বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, কোভিড ডেডিকেটেড, কিন্তু রোগির পাশে বাড়ির লোক থাকছিল। সিম্পল, শুধু মাস্ক সম্বল। নো পিপিই, নো রেসট্রিকশন।
আমার ডাক্তার ভাগ্নে আবিষ্কার করেছিল তার বাবার ভেন্টিলেটরে অক্সিজেন আসছেনা। সেটা খারাপ। সারানোর লোক নেই। দুলাভাইএর অক্সিজেন যখন 40% এ নেমে এসেছে, তখন ওরা ওর মাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে শেষ মুহূর্তে দেখানোর জন্য। আমার এতদিনের পুরোনো সেই দুলাভাই চলল অন্তিম যাত্রায়। নিজের বাবাকে ওরা দুই ছেলে হাসপাতালেই কাফন পরিয়ে দিয়েছে। তারপর সরকারীভাবে দাফন হয়েছে ওদের উপস্থিতিতে।
বর্তমান করোনার এই হল হালহকিকৎ।
কান্নাটা আজকাল সহজেই আসে। কেন, জানিনা। ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছি। অল্পেই চোখে জল, দৃষ্টি ঝাপসা।
এই সেদিন। আজকাল রোগী দেখি। জানুয়ারী থেকে লাগাতার দেখছি। কতদিনের অভ্যাস। গোটা ২০২০টা জ্বলে পুড়ে গেছে। করোনা, লকডাউন, তারপর নিজে করোনাতে মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া, করোনা পরবর্তী প্যাঙ্ক্রিয়াটাইটিসে ভুগে সেরে ওঠা, সব পর্যায় কাটিয়ে আমার বিশেবিশ পার হল যে।
সেদিন এক পেসেন্ট হঠাৎই বলে উঠলো, ‘ডাক্তারবাবু এবছর আপনাকে প্রয়োজনের সময় পাবোতো? আমি গত বছর থেকে চেষ্টা করছি আপনার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য, পেরে উঠিনি।’
তাকে বললাম, আমি কি আর আগের মতো সমর্থ আছি, বল?
তার চোখ ছলছল, দেখাদেখি আমারও চোখ ভিজে ভিজে হয়ে গেল।
দিন কয়েক আগে, একটি বাচ্চা মেয়ে, অসম্ভব বাল্কি, পাঁচফুটের নীচে তার হাইট, সতেরো বছর বয়সেই একশ কেজি। তার অ্যাকিউট অ্যাবডোমেন। শীগগির সার্জারি চাই। বললাম এত ভারী চেহারায় পারবো না। মেয়ের মা নাছোড়বান্দা। সে আমাকে বিগত তিরিশ বছর ধরে চেনে। যখন ফ্রক পরতো, সেই থেকে চেনে। কোনমতেই নড়বে না। অগত্যা।
ল্যাপারোস্কোপ ঢোকালাম। পেট ফুটো করে যে লম্বা পাইপগুলো ঢোকাতে হয়, সেগুলোকে পোর্ট বলে। মোটামুটি একটা পেন, অর্থাৎ কলমের সাইজ। গোটা পোর্টটাই অ্যাবডোমিনাল ওয়ালের থিকনেসের সমান। বহু কষ্টে সার্জারিটা কমপ্লিট হয়। সন্ধ্যার পরে ঘরে এসে আচ্ছন্ন হয়ে বসে আছি। তখনো ঐ কেসটার ঘোর কাটেনি। মোবাইলে একটা মেসেজ ভেসে উঠলো, My father-in-law is in life support. Please pray for him. অত খেয়াল করিনি মেসেজ প্রেরক কে!
পরদিন, মানে গতকাল সন্ধ্যায় যখন অদ্রিজা জানালো যে আশেকুরদা আর আমার পোস্টে কোনো কমেন্ট করতে আসবে না, সে চলে গেছে না ফেরার দেশে, তখন সে কথা শুনে কেমন যেন ব্ল্যাঙ্ক হয়ে গেলাম। সে ছিল প্রায় আমার নিজের দাদা, এত স্নেহ, এত ভালোবাসা! ফেসবুকে আমার যে ক’জন সিনিয়র দাদা আছেন, তাঁদের মধ্যে আশেকুরদা অন্যতম। তখন বিদ্যুচ্চমকের মতো খেয়াল হল যে লাইফ সাপোর্ট মেসেজদাতা ছিল আশেকুরদার জামাই। আমাকে জানিয়েছিল। নেহাত অন্যমনে ডুবে থাকার কারণে বুঝে উঠিনি। এতটাই গাধা আমি।
গতবছর রোগে ভুগেও ডিপ্রেশনের শিকার হইনি। এবছর বোধহয় সেটা আর আটকানো যাবে না। ভেবেছিলাম, আচ্ছে দিন ফিরছে। আবার আগের মতো আগামী সাতদিন ওটি বুকড। কাজেই আনন্দ। ইনকামটা বড় কথা নয়। কত অগুন্তি মানুষ ভালোবাসে আমায়। আমার একটু অসুস্থতার খবর পেলেই তারা কেউ পূজো দেয়, কেউ দোয়া মাঙে। কী করে এসব অস্বীকার করি!
আশেকুরদা আর আমার দুলাভাই এই দুজন এমনভাবে এক্সপ্রেস গতিতে তিরোধান করলো, আমি সত্যিই ভীষণ ব্যথিত, ভীষণ বিভ্রান্ত। আমি কাঁদছি। বোকার মতো কান্নাকে লুকোতে পারলাম না।
‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’ কেউ মারা গেলে মুসলিমরা এই দোয়া পড়েন। এটা মৃত ব্যক্তির জন্য নয়, বরং নিজের ভবিষ্যৎ স্মরণ করা বোঝায়।
এর অর্থ, আমরা সেই সর্বশক্তিমানের অধীন, এবং আমরাও একদিন তাঁর কাছে ফিরে যাবো। অর্থাৎ, যিনি চলে গেলেন, তিনি আগেই যাচ্ছেন, আমরাও আসছি ঐ পথে।