এপ্রিল, ১৯১৮
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখনও পুরোদমে চলছে। এর মধ্যেই (সম্ভবত আমেরিকার কানসাস প্রদেশ থেকে) সর্দিকাশি-জ্বর থেকে শ্বাসকষ্ট হয়ে একসাথে অনেক সংখ্যক রোগীর মৃত্যু সংবাদ আসতে শুরু করলো। খুব দ্রুত ছড়াতে লাগলো সে রোগ। যদিও যুদ্ধ-ব্যবসায়ীরা সে খবর বেমালুম চেপে গেলেন। যুদ্ধের মাঝে ‘বোড়ে’দের মনোবল ভেঙে গেলে রাজারাণীদের সিংহাসন টলমল হয়ে যায় যে! অবশ্য, ঘরে আগুন লাগলে ক’দিনই বা খবর চাপা থাকে? যুদ্ধে স্পেন তুলনায় নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছিল। তাই তাদের সত্যি কথা চেপে রাখার কোনও দায় ছিল না। স্পেনের খবরের কাগজগুলি নতুন অতিমারীর খবর প্রকাশ করতেই সবার টনক নড়লো। বিশেষত রাজা ত্রয়োদশ অ্যালফান্সোর গুরুতর অসুস্থতার খবর সারা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিলো। সেটাই স্বাভাবিক। উচ্চিংড়ের মতো কিছু সাধারণ মানুষের জীবনের কীই বা দাম? রাজাউজির অসুস্থ হ’লে তবেই না রোগের কৌলিন্যলাভ!
এদিকে, রোগ প্রকাশ তো পেল কিন্তু শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো লাগাতার প্রচার চালালো এ রোগ শুধু স্পেনেই হচ্ছে। এই ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারীর নামও ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ দিয়ে দেওয়া হ’ল। যাতে আপাতদৃষ্টিতে স্পেনকেই রোগের উৎসস্থল বলে দাগিয়ে দেওয়া যায়। পরবর্তী বছর দুয়েক সময়ে বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ ইনফ্লুয়েঞ্জা আক্রান্ত হ’ন। মারা যান প্রায় পঞ্চাশ মিলিয়ন মানুষ। কোনও কোনও সূত্রের মতে সংখ্যাটা আসলে একশো মিলিয়নের কাছাকাছি। রোগ আর মৃত্যুর সংখ্যা লুকিয়ে রাখতে শাসক বরাবরই সিদ্ধহস্ত।
ভারতের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ব্রিটিশ প্রভু আর ‘কালা আদমি’দের মধ্যে মৃত্যুর হারে বিস্তর ফারাক। যেখানে ইউরোপীয় দেশগুলোতে মৃত্যুহার ১-১.৫% সেখানে ভারতে মৃত্যুহার ৫-৭%। কারণ বোঝার জন্য ঐতিহাসিক বা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কোনোটাই হওয়ার দরকার নেই। বস্তির মতো এলাকায় স্যাঁতসেঁতে ঘরে গাদাগাদি করে থাকা মানুষেরা ইনফ্লুয়েঞ্জার সহজ শিকার হয়েছিলেন। অথচ এদেশেই উচ্চবিত্তদের বাগানঘেরা বড় বড় প্রাসাদে সেভাবে মারীর প্রকোপ পড়ে নি। ফলত, নেটিভ মানুষদের মৃত্যু নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের সেরকম মাথাব্যথা ছিল না। তখন শ্মশান, কবরস্থান ছাপিয়ে রাস্তাঘাটেও ইতিউতি পড়ে থাকছে মৃতদেহ। শেষকৃত্য করার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। শেয়াল, শকুনের ভুরিভোজের আয়োজন সম্পূর্ণ। তবে ব্রিটিশ সরকার কি একদম কিছুই করে নি? করেছিল তো… ১৩ ই এপ্রিল, ১৯১৯। জালিয়ানওয়ালাবাগ। শাসকের তরফে প্রীতি উপহার।
এপ্রিল, ২০২১
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ। জোরকদমে চলছে ভোটযুদ্ধ। জমায়েত, মিটিং-মিছিল জুড়ে স্বাস্থ্য-সচেতনতার নামগন্ধ নেই। সরকার বা বিরোধী; কারো মুখেই মাস্ক নেই। জনতার মধ্যেও ভয়ডর উবে গেছে। এদিকে দেশের দৈনিক সংক্রমণ দু’লক্ষ ছুঁল। সারা বিশ্বে মারা গিয়েছেন প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষ। এই পরিস্থিতিতেও কুম্ভমেলায় হাজার হাজার মানুষের ভিড়। কেউই বুঝতে পারছেন না, এ জাতীয় যাবতীয় জমায়েত ঠিক আগ্নেয়গিরির মাথায় হচ্ছে। বরং, যে বা যাঁরা সচেতনতার বার্তা দিচ্ছেন তাঁদেরই ‘ভ্যাক্সিনের দালাল’ কিংবা ‘ভয় বিক্রি করে খাওয়া লোক’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ঠিক যেভাবে একশো বছর আগে স্পেনের গায়ে মারীর কলঙ্ক লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছিল।
ভোটের বলিও শুরু হয়ে গিয়েছে। মানুষের লাশ ঘিরে শুরু হয়েছে বিকৃত রাজনৈতিক তরজা। মাঝখান থেকে একটা সহজ সত্যি কথা আড়ালে চলে যাচ্ছে- আসলে কিছু মানুষ মারা গেলেন! হ্যাঁ, কিছু জলজ্যান্ত মানুষ। যদিও ভোটবাজারে একজন সাধারণ মানুষ মানে শুধুই একটি সংখ্যা। এত হাজারো তথ্যের মাঝে ছোট্ট একটুকরো সংখ্যার হারিয়ে যাওয়াই ভবিতব্য।
*****
প্রায় একশো বছরের ব্যবধানে ঘটা দুটো ঘটনার মধ্যে কোনও মিল পাচ্ছেন? ইতিহাস কেমন ভাবে নিজেরই পুনরাবৃত্তি করে চলে বারবার…
আশঙ্কা আর আশার দুটো কথা বলে আজকের লেখা শেষ করবো। আগে ভয়ের কথাটাই বলি-
স্প্যানিশ ফ্লুয়ের প্রথম ঢেউ বিশ্বকে কাঁপিয়ে গেছিল ঠিক কিন্তু সত্যিকারের আঘাত এসেছিল দ্বিতীয় ঢেউ থেকে। যখন ভাইরাস নিজেকে বদলে নিয়ে নতুন করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বিশ্বযুদ্ধের ফলে যত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তার চেয়ে ঢের বেশি হয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লু’তে। এবারের দ্বিতীয় ঢেউ এখনই প্রথম ঢেউকে অনেকটা পেছনে ফেলে দিয়েছে।
আশার কথা হ’ল, শেষ এক শতকে আধুনিক চিকিৎসা-বিজ্ঞানের রকেট গতিতে উত্থান। স্প্যানিশ ফ্লুয়ের সময় রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো যথাযথ অস্ত্র বা চিকিৎসা-জ্ঞান ছিল না। ইনফ্লুয়েঞ্জা পরবর্তী ব্যাক্টিরিয়া সংক্রমণে অগুনতি মানুষ মারা যান। অ্যান্টিবায়োটিক তখন ভবিষ্যতের গর্ভে। বিভিন্ন অপ্রমাণিত দেশীয় চিকিৎসা কিংবা হোমিওপ্যাথির মতো ছদ্ম-বিজ্ঞান দিয়ে রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব ছিল না। জানি, অনেকেই বলবেন- করোনারই বা সত্যিকারের অ্যান্টি-ভাইরাল কিছু আছে নাকি? উত্তর- নেই। কিন্তু, কথাটা এখানেই শেষ নয়। অধিকাংশ ভাইরাল রোগের চিকিৎসা অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ দিয়ে হয় না। রোগের সৃষ্টির পদ্ধতি আর রোগের জটিলতাগুলো সঠিকভাবে জেনে সেগুলো আটকানোই চিকিৎসা। একটা সহজ উদাহরণ দিই, বুঝতে সুবিধে হবে। ডেঙ্গির কথা ভাবুন। ডেঙ্গি ভাইরাস মারার কোনও ওষুধ হয় না। রোগের জটিলতা আটকাতে পারলেই বাকিটা শরীর নিজেই বুঝে নেবে। এবং, এখন করোনার রোগসৃষ্টির পদ্ধতির অনেকটাই আমাদের জানা। সেইমতো চিকিৎসা করেই বহু মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। যদিও বন্যার মতো রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে হাসপাতালগুলো উপচে পড়বে। তখন কী হবে সেটা সহজেই অনুমেয়। আমার হাসপাতালেই শেষ পাঁচ-ছ’দিনে চারজন সহকর্মী চিকিৎসক করোনা-আক্রান্ত হয়েছেন।
ম্যারাথন ডিউটি চলছে। সেভাবে ফেসবুক খুলে দেখার সময় হচ্ছে না। টিভিতে দেখছি, আজ নববর্ষ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জমজমাট প্রচার চলছে। বহুদিনই মানুষের ব্যক্তিগত সচেতনতার ওপর আস্থা হারিয়েছি। যেভাবে রোগী আর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে তাতে ১লা বৈশাখ আক্ষরিক অর্থেই ‘একলা’ হয়ে উঠবে কিনা সেটা সময়ই বলবে।
(স্প্যানিশ ফ্লুয়ের সময়কালের ছবি গুগল থেকে সংগৃহীত)
চিত্র পরিচিতিঃ
ফিচার চিত্রঃ গঙ্গার ঘাটে সারি সারি মৃতদেহ। তখনও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে।
দ্বিতীয় চিত্রঃ মহামারী প্রতিরোধে মাস্কের ব্যবহার ছিল তখনও।
তৃতীয় চিত্রঃ মহামারীর সময়েও সান ফ্রানসিস্কোর সেন্ট মেরি গির্জায় মানুষের ভিড়। সাগর বা কুম্ভ মেলার সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছেন?