৩য় পর্বের পর…
ছাতাটা বড় হলেও একটা ছাতা তিনজনের পক্ষে যথেষ্ট নয়। তাছাড়া অরূপ ওদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা। প্রায় পাঁচ ফুট দশ। ছাতাটা সংগ্রাম অনেক উঁচু করে ধরে ছিল। তাই অরূপ সেটা নিজে ধরতে চাইল। কিন্তু সংগ্রাম কিছুতেই ওর হাতে দিল না।
কটেজে পৌঁছে ওরা ভিজে জামাকাপড় পাল্টে ফেলল। সকালে বৃষ্টি থামলে হয়! এগুলো শুকোতে হবে। ভিজে জামাকাপড় লাগেজে নেওয়া যাবে না।
বিদিশা অরূপের ফোনটা নাড়াচাড়া করছিল।
‘মেমরি কার্ডটাতে কি থাকতে পারে?’
‘হয়ত গোপনীয় কিছু। তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হল, মেমরি কার্ডটা কার কাছ থেকে এল?’
‘কার কাছ থেকে বলে তোমার মনে হয়?’
অরূপ উত্তর না দিয়ে চুপ করে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল। খুব গভীর চিন্তা করার সময়ে সে এরকম দূরে তাকিয়ে থাকে।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পরে অরূপ হঠাৎ বলল, ‘আজ আমাদের ঘরে থাকা চলবে না।’
‘কেন?’
‘আমরা যে দেখে ফেলেছি এবং ছবি তুলেছি সেটা ওরা দেখেছে।’
‘তাহলে?’
‘দেখি কি করা যায়!’
ভালো করে বিছানা করল বিপাশা। অরূপ বালিশ দুটো লম্বা করে পাশাপাশি রেখে চাদর দিয়ে ঢাকা দিল। অন্ধকারে দেখে মনে হয় দুজন মানুষ বিছানায় শুয়ে আছে। তারপর বৃষ্টি থামতেই সুইস টেন্ট আর স্লিপিং ব্যাগ দুটো নিয়ে রিসর্টের পিছনের অন্ধকার শুঁড়ি পথ বেয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। বড় ট্যুরে গেলে ওদের সাথে একটা ছোট সুইস তাঁবু থাকে।
গোটা ট্যুরিষ্ট লজ তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। অন্ধকার হলেও কিছুক্ষণ বাদে চোখ সয়ে যায়। তারার আলোয় পথঘাটের আন্দাজ পাওয়া যায়। বড় ঝাঁকড়া গাছটার পাশ দিয়ে নদীর ধারে নেমে মোটামুটি সমতল একটা জায়গা বাছল ওরা। বিকেলে ঘুরতে এসে জায়গাটা দেখে রেখেছিল বিপাশা। পাথরগুলো ভিজে ভিজে। মোবাইল ফোনের টর্চ জ্বালানোর চেষ্টা করছিল অরূপ। হাত চেপে ধরে মানা করল বিদিশা। হাতড়ে হাতড়ে একটু শুকনো জায়গা দেখে তাঁবুটা খাটালো দুজনে মিলে। এই সুইস তাঁবু গুলো খাটানো বেশ সহজ।
রাতটা কোনোক্রমে কাটিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই ওরা কটেজে ফিরল। তখনো কারও সাড়াশব্দ নেই। ঘরে ঢুকে দেখল সব লন্ডভন্ড। কে বা কারা ঘরের প্রতিটা ব্যাগপত্তর ঘেঁটে, বিছানা-বালিশ ছিঁড়েখুঁড়ে রেখে গেছে। রাতে ঘরে না থাকার সিদ্ধান্তটা তার মানে ঠিকই ছিল।
একটু পরে ইলেকট্রিক কেটলিতে চায়ের জল বসালো বিদিশা। আর অরূপ জিনিসপত্র গোছগাছ শুরু করল। এমন সময় বাইরে থেকে একটু গুঞ্জন কানে এল। তারপর বাড়তে বাড়তে হইচই। অন্য কটেজে চা দিতে যাওয়া একজন কর্মচারীকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, ‘জানেন না, কাল রাতে সাহেব তো মারা গেছে।’
‘কোন সাহেব?’
‘ওই যে সাত নম্বর কটেজের জার্মান সাহেব। এক সপ্তাহ হল এসেছিল।’
‘সে কি? কিভাবে?’
‘সাপে কেটেছে। কটেজে ঢুকেছিল। বিরাট চন্দ্রবোড়া সাপ। আমাদের রাহুল সাপটাকে মেরেছে।’
চায়ের কেটলি বন্ধ করে ওরা ছুটল সাত নম্বর কটেজের দিকে। প্রচুর লোকজন জমায়েত হয়েছে সেখানে।
কটেজের বারান্দায় দেখা গেল একটা চন্দ্রবোড়া সাপের মৃতদেহ। পিটিয়ে মারা হয়েছে। ঘরের ভিতরে বিছানায় শায়িত জার্মান মায়ার সাহেবের দেহ। পরনে রাতের পোষাক। ঠোঁট নীল। লালচে মুখটা ধূসর হয়ে গেছে। ফুলেওছে। ঠোঁটের কোণায় গ্যাঁজলা।
পায়ের কাছে পোষাকের উপরে একটা আধূলির সাইজের গোল রক্তের দাগ। অরূপ প্যান্টটা একটু সরিয়ে ছোবলের দাগটা দেখে ভ্রু কোঁচকালো। সেখানে রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। তারপর সে চিন্তিত মুখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে মেঝেয় একটা ধাতব চাকতি দেখতে পেয়ে সেটা কুড়িয়ে নিল। চাকতিটা একটা এক টাকার কয়েনের মত। তবে তার মাঝখানে একটা চৌকো গর্ত করা। চাকতিটা সে টুক করে পকেটে পুরে ফেলল।
‘পুলিশে খবর দিতে হবে।’
‘খবর দেওয়া হয়েছে, এখনি এসে পড়বে।’ একজন বলল।
বিদিশা নাড়ির স্পন্দন ও চোখের পাতা সরিয়ে কর্ণিয়া রিফ্লেক্স দেখল।
‘নাঃ, অনেকক্ষণ মারা গেছে।’
রাহুল নামে এক কিচেনের ষ্টাফ সাপটাকে মেরেছে। সে বলল,
‘আপনি বুঝলেন কি করে?’
‘আমি হাসপাতালের নার্স। সুন্দরবনের হেল্থ সেন্টারে অনেক সাপে কাটা রোগী দেখেছি।’
‘ও’
বিদিশা ঘর থেকে বেরিয়ে ফাঁকায় এসে অরূপকে নীচুস্বরে বলল,
‘শ্বাসরোধে মৃত্যু। সুতরাং নিউরোটক্সিক পয়জন। চন্দ্রবোড়ার কামড়ে তো এরকম হয় না!’
‘কি রকম হয়?’
‘চন্দ্রবোড়ার বিষ হেমাটোটক্সিক। ওতে শরীরের রক্ত জমাট বেঁধে যায়। কিডনি নষ্ট হয়ে যায় তাতে। কিন্তু এরকম মুখচোখ নীলচে হয়ে যায় না।’
‘হুমম্।’ অরূপ এরপর আর কোনো কথা বলল না।
(চলবে)
ছবি: অন্তর্জাল