আমি পেশায় একজন স্কুলশিক্ষক। শালবনী এলাকাতেই বাড়ি। আজ আমি আপনাদের শালবনী সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালের অভিশাপ মুক্তির বিষয়ে বলবো..
শালবনী সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল গড়ে ওঠার পর সেটি ধীরে ধীরে আমাদের ভরসা আর গর্বের জায়গা হয়ে উঠেছিল। ২৪ ঘন্টা ইমার্জেন্সি পরিষেবা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ, এক্স-রে, ইউএসজি, ল্যাব সার্ভিস.. ইত্যাদি প্রায় সবকিছুই আমরা হাতের কাছেই পাচ্ছিলাম। বহুবার উল্লেখযোগ্য চিকিৎসা দিয়ে হাসপাতালের নাম খবরের কাগজে উঠে এসেছিল। অথচ, রমরমিয়ে চলা হাসপাতালটিকে ঠিক বছর দুয়েক আগে সবার চোখের আড়ালে জিন্দালদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। মূলত রাজনৈতিক চোখরাঙানির ভয়ে আমরা কেউই মুখ খুলতে পারিনি। আপনারা আমাদের ভীতু বা ভেতো যাই বলুন, জলে থেকে কুমীরের সাথে বিবাদের সাহস আমাদের ছিল না।
অপ্রশিক্ষিত বা অর্ধ-প্রশিক্ষিত নার্সিং স্টাফ, অদক্ষ চিকিৎসক আর ‘প্রভুসুলভ’ প্রশাসক দিয়ে কাজ শুরু করে জিন্দাল গোষ্ঠী। আমার পাড়ার দু’ভাই হাসপাতালে ওয়ার্ড-বয় হিসেবে কাজ করে। তাদের সূত্রেই হাসপাতালে নিয়মিত যাওয়া-আসা কিংবা খবরাখবর আদান-প্রদান হ’ত। জিন্দালদের হাতে আসার পর হাসপাতালে কাজের পরিবেশটাই নষ্ট হয়ে যায়। হাসপাতালের স্টাফেদের সাথে অনুগত ভৃত্যের মতো আচরণ করা হ’ত। ডাক্তার হিসেবে যাঁদের আনা হয়েছিল তাঁদের ডিগ্রির সত্যতা নিয়ে আমরা অনেকেই সন্দিহান ছিলাম। শোনা যায়, হাসপাতালের সুপার অনেকবার তাঁদের ডিগ্রির নথি জমা করতে বলার পরেও তাঁরা সেগুলো দেন নি। কারণ সহজেই অনুমেয়। ফলস্বরূপ রমরমিয়ে চলা হাসপাতালের ওপর থেকে জনগণের বিশ্বাস টলতে থাকে। যে ওয়ার্ডগুলোতে রোগীর ভিড় উপচে পড়তো সেগুলো জনমানবহীন হয়ে যায়। বিশেষ ওয়ার্ডে রোগীসংখ্যা ‘শূন্য’ এমন বহুদিন হয়েছে। আউটডোরেও রোগীর আকাল শুরু হয়। আগে যেখানে দিনে ১০০০-১২০০ রোগী হ’ত সেখানে রোগীর সংখ্যা এক-চতুর্থাংশেরও কম হয়ে যায়।
এ তো গেল বাইরের কথা। এবার ওয়ার্ডের ভেতরের কথা বলা যাক। সরকারি হাসপাতালে যেখানে বিনে পয়সায় পরিষেবা পাওয়ার কথা সেখানে বেড প্রতি ৭৫০ টাকা ভাড়া ধার্য করা হয়। স্বাস্থ্যসাথী কার্ড ছাড়া ভর্তি নেওয়া হ’ত না। উদ্দেশ্য একটাই, যেনতেনপ্রকারেণ স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের টাকাগুলো আত্মসাৎ করা। সাধারণ মানুষকে যেহেতু সরাসরি পকেট থেকে টাকা দিতে হচ্ছিল না, তাই প্রথম প্রথম এই নোংরা খেলাটা ধরতে অসুবিধে হচ্ছিল। পরে অবশ্য সব দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। যাদের সত্যিকারের ভর্তি করা দরকার সেরকম রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার মতো পরিকাঠামো ছিল না। ভর্তি করা হ’ত সাধারণ জ্বর-জ্বালা বা সামান্য রোগগুলিতে। যাদের আউটডোর থেকেই ওষুধ লিখে ছেড়ে দেওয়া যায় তাদেরই সাত-দশদিন ভর্তি রেখে হাজার হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দেওয়া হ’ত। এক একটা প্রেসক্রিপশনে খান কুড়ি করে ওষুধ। আমার পরিচিত ডাক্তার বন্ধুদের কাছে প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে বুঝেছি তার মধ্যে দু-তিনটে করে ভিটামিন আর যাবতীয় হাবিজাবি ওষুধ লিখে বিল বাড়ানোর খেলাটা ভালোই জমে উঠেছিল।
এর প্রতিবাদে অধিগ্রহণের পরপরই ডা. পুণ্যব্রত গুণ ও ডা. রেজাউল করিমের নেতৃত্বে ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস’ ফোরাম শালবনীতে এসে প্রতিবাদ জানিয়ে যান। তার পরেও এই ফোরাম নিয়মিত সরকারি হাসপাতালের বেসরকারিকরণের প্রতিবাদ করে এসেছে। যদিও সেসব খবর মূলধারার সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে নি স্বাভাবিকভাবেই। এমনিতেই শহরের বড় খবরের আড়ালে আদিবাসীপ্রধান এলাকার মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকার হরণের খবর পাত্তা পাবে না এটা আমাদের গা-সওয়া। সব মিলিয়ে আমরা রাগে আর ক্ষোভে ফুঁসছিলাম কিন্তু সত্যি বলতে আমাদের সেই অক্ষম রাগ কোনও সলতে পাচ্ছিল না। এলাকার লোকাল নিউজ চ্যানেল বা অন্যান্য সংবাদমাধ্যমগুলিও রাজনৈতিক নেতার অনুগত সেনানী হয়ে যাবতীয় খবর চেপে রেখে ঢাক গুড়গুড় বজায় রেখেছিল। কখনো আবার হাসপাতালের নতুন পর্দা, তিনবেলা ভরপেট খাবার, স্টাফেদের ড্রেসকোড ইত্যাদি অপ্রয়োজনীয় খবর ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলে বেড়াচ্ছিল। এগুলো সবই যে স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের টাকা কেটে তার সামান্য অংশে ‘গরু মেরে জুতোদান’ সেই ব্যাপারটা একবারও খোলসা করে বলে নি তারা। তাছাড়া, হাসপাতালে আসল ব্যাপার ‘চিকিৎসা’টাই। মাথায় শেফের টুপি আর হাতে কনুই অব্দি দস্তানা দিয়ে চিকিৎসার বেহাল অবস্থাকে ঢাকা দেওয়া যায় না।
এরই মধ্যে কর্মীদের দু’মাসের বেতন না দেওয়ায় তাঁরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারপরই আসে সেই সুসংবাদ! জিন্দালরা হাসপাতাল ছাড়ছে। ফের সরকারি হচ্ছে হাসপাতাল! আপাতত কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের কাজ শুরু হবে। পাশের রুরাল হাসপাতালের পুরোনো বিল্ডিংয়ে অন্যান্য রোগীর চিকিৎসা হবে। সব মিলিয়ে এটা আমাদের জন্য দারুণ খবর। হাসপাতালের স্টাফেরা তাঁদের বহুদিনের গুমরে ওঠা রাগ সরিয়ে আজ শান্তিতে শ্বাস নিতে পারছেন। আমাদের বহুদিনের অভিশাপ মুক্তি হ’ল!!
এই দু’বছরে জিন্দালদের হাতে না তুলে দিলে আমাদের হাসপাতালের আরও অনেক উন্নতি হ’ত। এখন আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। আজ আবার গলা উঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, সরকার এভাবে জনগণের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে হাত ঝেড়ে ফেলতে পারে না। জনগণের স্বাস্থ্যের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই। সবার জন্য বিনামূল্যে সমমানের বিজ্ঞানসম্মত, আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সরকারেরই দায়িত্ব।
লিখেছেন শালবনীর জনৈক স্কুলশিক্ষক। বোধগম্য কারণেই তাঁর নাম প্রকাশ করা গেল না।
শয়তানের দল।
শিক্ষক মহাশয় খুব ভাল লিখেছেন। বড় মর্মস্পর্শী। লেখাটি পড়লেই বোঝা যাই যে ওই হাসপাতালে মানুষ ঢুকলে আর জ্যান্ত বেরত না। একদিকে এই ভয়াভহ কাণ্ড ঘটে চলছে, আর শিক্ষক মহাসয় মরমে মরে যেতেন নিজের পাড়ার লোকেরচ কাছ থেকে খবর নিয়ে। কিন্তু এক্টু ভ্রান্তি থেকে গেল যে। পুরো লেখাটিতে কোন পরিসংখ্যান নাই। আসুন আমরা বরং কিছু পরিসংখ্যান ছরছা করিঃ
১. নভেম্বর ২০১৯ থেকে মে ২০২০ অব্দি অস্ত্রপ্রচার হয়েছে মোট ৫২৩টি।
২. এর মধ্যে সিজার হয়েছে ২১৭ টি।
৩. লাইগেসন হয়েছে ১৩৪ টি।
৪. সিজার এবং লাইগেসন এর জন্য স্বাস্থ্যসাথি লাগে না।
৫. ল্যাপারস্কপিক অস্ত্রপ্রচার এর ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসাথি ব্যাবহার করা হয়েছে।
আসুন নিচে দেখে নি মাস অনুযায়ী কি কি অপারেশান কিভাবে হয়েছেঃ
OBS & GYNAE GEN. SURGERY
Months LSCS PERINEAL TEAR REPAIR TUBAL LIGATION TLH D&E I&D LAP CHOLE OPEN CHOLE SCROTECTOMY HERNIA & HYDROCEL APPENDECTOMY OTHERS Total
NOV ’19 37 1 5 1 7 1 2 2 2 3 0 1 62
DEC ’19 28 2 10 3 2 0 1 0 0 2 1 3 52
JAN ’20 24 0 26 2 12 0 0 0 0 1 0 12 77
FEB ’20 15 1 58 1 7 0 4 0 0 0 1 14 101
MAR ’20 12 1 21 0 1 0 1 0 0 0 0 60 96
APR ’20 50 3 5 1 4 0 0 0 0 0 1 2 66
MAY ’20 51 3 9 1 1 0 1 0 0 0 0 5 71
Total 217 11 134 9 34 1 7 2 2 6 3 97 523
ওপরের পরিসংখ্যান টি বলে দিছে বাস্তবিক চিত্র কি ছিল। আমি যতটা জানি তাতে করে সরকারী আমলে মাস প্রতি ১০ টি অপারেশান হত গড়ে। বাদবাকি পরিষেবার কথা আর নাই বা বললাম। আপনি শিক্ষক মানুষ আশা করব যে ছাত্রছাত্রীদের ভাল মন্দ চেনার শিক্ষা অবশ্যই দেবেন, এবং নিজেও পালন করবেন।
পরেরবার যখন লিখবেন এক্টু জেনে নিয়ে লিখবেন। পরের মুখে ঝাল খাওয়া একজন শিক্ষককে শোভা দেয়না। কাকের পেছনে না দৌড়ে কানে হাত দিলেই বোঝা যায়, আর নাম লুকিয়ে লিখতেও হয়না।