পূর্বপ্রকাশিতের পর
চাওয়া পাওয়া
মানুষ যা করতে চায়, সেটার চেষ্টা করা যায়, সফল হওয়া বা না হওয়া তার হাতে থাকে না। কিন্তু সফল হওয়ার জন্য চেষ্টাটা চালিয়ে যাওয়া দরকার। এই ইনস্টিটিউট যেরকম তৈরি করতে চেয়েছিলাম হয়ত তেমনটা তৈরি হয়নি। কারণ খুব পরিষ্কার, এটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকারি নিয়ম একটা অচলায়তন। তবে যদি কেউ নিতান্তই লেগে পড়ে থাকে, কিছু করবো বলে স্বপ্ন দেখে, এবং কিছুতেই ওই স্বপ্ন থেকে বিচ্যুত না হয়, যদি সত্যিই সে নিজের স্বপ্নকে বিশ্বাস করে তাহলে সে এই লড়াইয়ে সফল হবেই। নিজের স্বপ্নের প্রতি এই বিশ্বাস থাকাটা দরকার। কাজ করতে গিয়ে আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটাই আমাদের এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
এখনকার সময়ে সত্যিই একটা ভালো কাজ করতে চায় এমন মানুষ খুব কম খুঁজে পাওয়া যায়, কেউ কোনো কাজ শুরু করলেই তার পেছনে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য খুঁজে বার করার চেষ্টা করে অনেকে। এইরকম নানান কারণে অনেক কাজই শুরু করে আবার বন্ধ করে দিতে হয়। যদিও এগুলো ব্যক্তিবিশেষের উপরে নির্ভর করে। কোনো মানুষ যদি একটা কাজ শুরু করে মাঝপথে ছেড়ে দেন তাহলে তো সেই কাজটা সম্পূর্ণ হবে না। এইসব কারণে নতুন কিছু সৃষ্টি করা খুব কঠিন। এর পিছনে যে পরিশ্রম লাগে সেটা আরো কঠিন।
এত কিছুর পরেও যতটা ইচ্ছে সেই সাধ্যের সঙ্গে স্বাদ মিলল না। ২০১৩-তে পেইন ইনস্টিটিউটের পথচলা শুরু। শুরুটা ভালোই হয়েছিল। যেরকম ভাবা হয়েছিল তার থেকেও ভালো করে শুরু করতে পেরেছিলাম আমরা। ওই সময় বহু মানুষের সাহায্য কাজটিকে আরো ত্বরান্বিত করে। ২০১৩-এর ৫ই সেপ্টেম্বর পেইন ইনস্টিটিউটের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছিল। ঐদিন অনুষ্ঠানে কে আসেনি? অনেক মন্ত্রী, স্বাস্থ্য-প্রশাসনিক অধিকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তখন এরাজ্যের শ্রমমন্ত্রী ছিলেন পূর্ণেন্দু বসু, স্বাস্থ্যমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। এছাড়াও ডিরেক্টর অফ মেডিকেল এডুকেশন সুশান্ত বন্দোপাধ্যায়, স্বাস্থ্য দপ্তরের দেখাশোনার জন্য একজন স্পেশাল অফিসার, শ্রম দপ্তরের সচিব, ইএসআই-এর ডিরেক্টর, ইএসআই কর্পোরেশনের সিনিয়র স্টেট মেডিকেল কাউন্সিলার ডা. চৌধুরী, শ্রম দপ্তরের স্ট্যান্ডিং কমিটি সদস্য দোলা সেন সহ আরো অনেকে। শুধু অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে নয় উৎসাহী হিসেবেও বহু কৃতী মানুষ সেদিনের অনুষ্ঠানটিকে অলংকৃত করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে প্রথম ব্যথা নিয়ে একটা ইনস্টিটিউট হচ্ছে, সেটা দেখার আগ্রহে অনেকেই স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রতিষ্ঠান শুরুর প্রথম দিন থেকেই পাশে ছিলেন এমন অনেকে যেমন ডাক্তার এস. এম. বাসু, যাদবপুর ইউনিভার্সিটি প্রফেসর মনোজ কুমার মিত্র সহ অন্যান্য ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকরাও উপস্থিত ছিলেন। স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রেজিস্ট্রার ও ইন্সপেক্টর অফ কলেজ এসেছিলেন। বহু সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন ইভেন্টটাকে কভার করার জন্য। বাংলার প্রথম সারির দৈনিক গুলিতে যেমন টাইমস অফ ইন্ডিয়া, বর্তমান, প্রতিদিনের কভার পেজে “প্রথম পেইন ইনস্টিটিউট চালু হল কলকাতায়”, এই শিরোনামে খবর বেরিয়েছিল। সবার জন্যই এটি একটি বিরাট পাওনা ছিল যে রাজ্যে প্রথম এমন একটা পেইন ইনস্টিটিউট খুলল। সরকারি তরফে তাই এর সূচনাও হয়েছিল মহাসমারহে।
প্রতিষ্ঠানে পেইন ম্যানেজমেন্টের চিকিৎসা পদ্ধতি
ব্যথা সাধারণত দু’রকমের হয়, সাময়িক ব্যথা ও দীর্ঘকালীন ব্যথা। সাধারণত দীর্ঘকালীন ব্যথা হয় নার্ভের কোন সমস্যার জন্য। ওষুধ খেয়ে কমাতে হয়। পেইন ম্যানেজমেন্ট দু ধরনের হয়, একটা তাৎক্ষণিক ব্যথা কমানোর, অন্যটা দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার চিকিৎসা। তাৎক্ষণিক ব্যথার পেইন ম্যানেজমেন্ট একরকম। যেসব ব্যথায় অপারেশন করতে হয় বা হাত কেটে গেছে বা কেউ চোট পেয়েছে এগুলোতে ব্যথার একটা কারণ আছে, সেই কারণটা খুঁজে বের করে সেটার আলাদা করে চিকিৎসা করতে হয়। যার যেমন সমস্যা তার চিকিৎসা পদ্ধতিও সেইরকম। ব্যথার চিকিৎসার পাশাপাশি তাৎক্ষণিক ব্যথা কমানোর ওষুধ দেওয়া যেতে পারে, তবে মনে রাখতে হবে ব্যথার এই ওষুধগুলি খুব কম দিনের জন্যই রোগীকে প্রেসক্রাইব করা যায়। সাধারণ ব্যথার ওষুধে দু-তিন সপ্তাহ বা খুব বেশি হলে এক মাসের মধ্যেই ব্যথা সেরে যায়।
কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ব্যথার কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না -তাই সারানো যায় না। কারো যদি মাসের পর মাস স্নায়ুঘটিত ব্যথার সমস্যা হয় তাহলে সেগুলো সাধারণ ব্যথার ওষুধে সারে না। বর্তমানে পেইন ইনস্টিটিউটের আউটডোরে মঙ্গলবার সব ধরনের রোগী দেখা হয়। প্রথমে রোগীকে বিভিন্ন ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন ডাক্তাররা। অনেকের তাতেই সারে যাঁদের সারে না বা যাঁদের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে দেখা যায়- এতটাই খারাপ যে তাঁরা যাতায়াত পর্যন্ত করতে পারেন না, তাঁদেরকে ভর্তি নেওয়ার ব্যবস্থা আছে এখানে। যেসব পেশেন্টের আরো বেশি চিকিৎসার দরকার তাঁদের প্রয়োজন মত নানা রকম থেরাপি প্রয়োগে চিকিৎসা শুরু করা হয়। যেমন কারো শিরদাঁড়ার হাড় ভেঙে গেছে সেটা বোন সিমেন্ট দিয়ে মেরামত করতে হয়, এই পদ্ধতিতে রোগীকে অজ্ঞান করতে হয় না।
পেইন ইনস্টিটিউটে একটি অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার আছে। যেখানে সি-আর্ম, ফ্লুরোস্কোপ, আল্ট্রাসনোগ্রাফি যন্ত্র ব্যবহার করে চিকিৎসা হয়। রোগীর প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে কখনো আউটডোর বা ইনডোর, প্রয়োজনে অপারেশন থিয়েটারে চিকিৎসা চলে। এরপর যদি রোগীর অন্য কোনো বিশেষজ্ঞের পরামর্শের প্রয়োজন হয় তখন চিকিৎসকরা তাঁদের মত নেন। কারণ সবটা জানা বা বোঝা একজন ডাক্তারের পক্ষে সম্ভব নয়, যে বিষয়টি যে ডাক্তার ভালো বোঝেন তাঁর কাছেই রোগীকে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে রোগীর চিকিৎসা সঠিক হয়।
সবদিক থেকে দেখলে মনে হয় যে উদ্দেশ্যে পেইন ক্লিনিক শুরু করা হয়েছিল তা অনেকটাই সফল হয়েছে। আমরা আমাদের জার্নির মাধ্যমে ক্রনিক পেইনের চিকিৎসা করার প্রয়োজন আছে সেটা প্রমাণ করতে পেরেছি। বিষয়টি শুধু আমাদের রাজ্যে সীমাবদ্ধ নেই সারা দেশই এর সুফল পাচ্ছে। এ রাজ্যের পেইন ইনস্টিটিউটের সিলেবাস নিয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কোর্স তৈরি হচ্ছে। সেই কোর্সগুলি পড়ানোর জন্য নানান পোস্টও তৈরি হয়েছে।
শিয়ালদা ইএসআই-এর পর আর জি কর-এও পেইন ক্লিনিক চালু হয়েছে, আগেই বলেছি। গত দশ বছর ধরে পেইন ক্লিনিক থেকে বহু মানুষ পরিষেবা পেয়েছেন। সম্প্রতি আর জি কর-এ পেইনের উপর ফেলোশিপও চালু হয়েছে। শুধু আর জি কর কেন এবছর এসএসকেএম হাসপাতালেও পেইন ইনস্টিটিউটের সিলেবাস নিয়ে পোস্ট ডক্টরেট কোর্স চালু হয়েছে। যে শিক্ষণ পদ্ধতিতে পেইন ইনস্টিটিউট চলতো সম্পূর্ণ সেই সিলেবাসেই এবার থেকে এসএসকেএম-এও ছাত্র পড়ানো হবে। হৃষীকেশ এইম্সও পেইন ম্যানেজমেন্ট নিয়ে ডি এম চালু করেছে। একসময় শিয়ালদা ইএসআইস-তে যেসব ডাক্তার পেইনের ট্রেনিং নিয়েছিলেন তাঁরাই এখন সারাদেশে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এই সমস্ত ইনস্টিটিউশনে পেইন ম্যানেজমেন্টের শিক্ষকের দায়িত্বে তাঁরা আছেন। এগুলোতো সাফল্যেরই মাইলফলক।
সময়ের দাবিতে এখন এই কোর্সের গুরুত্ব সবাই বুঝতে পারছে। তবে প্রথম থেকেই এ বিষয়ে আমাদের দৃঢ় প্রত্যয় ছিল যে আমরা যেভাবে শুরু করেছি, তার একটা সুদূরপ্রসারী ফল থাকবে। ব্যথা বেদনায় মানুষ যেরকম ভাবে জর্জরিত, অদূর ভবিষ্যতে এই কোর্সের চাহিদা কি হতে চলেছে তা আন্দাজ করেই বেশ কিছু বেসরকারি ইনস্টিটিউটও তাদের সিলেবাসে পেইন ম্যানেজমেন্ট চিকিৎসা রাখার পরিকল্পনা করছে। ইতিমধ্যে অনেকেই আবেদনপত্রও জমা দিয়েছে। কোলাঘাটের কাছে একটি বেসরকারি হাসপাতাল গত দু’বছর ধরে প্লেইন ক্লিনিক চালু করেছে।
বর্তমানে আমাদের গবেষণা নিয়ে অনেকগুলি জার্নাল উৎসাহ দেখিয়েছে। সব মিলিয়ে বলা যায় বেশ কম সময়ে এদেশের চিকিৎসা সংক্রান্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মানচিত্রে পেইন মানেজমেন্ট নিজের জায়গা তৈরি করতে পেরেছে। সম্প্রতি আই.এ.এস.বি. ও ডব্লিউ.এইচ.ও.-এর তরফ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছি আমরা। সমগ্র দেশে হায়দ্রাবাদের একটি ইনস্টিটিউটের সঙ্গে আমাদেরকেও নির্বাচন করা হয়েছে ব্যথার রোগগুলোকে শ্রেণীবিভাগ ও নামকরণের জন্য। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। কারণ এত দিন আমরা জানতাম যে মানুষ অনেক ধরনের ব্যথায় ভোগে কিন্তু নির্দিষ্ট করে কত ধরনের পেইন হয় তা আমাদের অজানা ছিল, সারা পৃথিবী জুড়ে কোন ধরনের ব্যথায় সবচেয়ে বেশি মানুষ ভোগেন আমরা জানতাম না। এইসব প্রশ্নের উত্তর পেতে প্রথমে আমাদের জানতে হয় ক্রনিক পেইন কত ধরনের? বিভিন্ন দেশে পেইনকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। অর্থাৎ একই রোগের বিভিন্ন নাম। এবার যদি আমরা জিজ্ঞেস করি পৃথিবীতে কোন রকম ব্যথা বেশি? এর উত্তর ঠিক করে দেওয়াই যেত না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই সমস্যা কাটাতেই একটা ক্লাসিফিকেশন অফ ডিজিস করে প্রত্যেকটা রোগের চিহ্নিতকরণের জন্য একটি সংখ্যা দিয়েছে। এর ফলে রোগের চিহ্নিতকরণ এবং গবেষণার কাজ অনেক সোজা হয়ে গেছে।
সবদিক থেকে মনের মতন না হলেও ইএসআই-এর এই পেইন ইনস্টিটিউটটি বর্তমানে নিজের লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে চলেছে। রোগীদের চিকিৎসাটা তো বটেই এর পাশাপাশি দেশের যেকোনো উন্নত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো গবেষণার পরিবেশও তৈরি করতে পেরেছি আমরা। শিক্ষাক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের একটি গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। এখন বহু ডাক্তার ছাত্রই এখানে পড়তে আসতে আগ্রহী, এমনকি ইউরোপ থেকেও ছাত্ররা পড়তে আসতে চাইছেন। আসলে পেইন নিয়ে আমাদের গবেষণা অনেকটাই শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। আগামী দিনেও অনেকগুলি গবেষণার ফল আমরা পেতে চলেছি। আমার অভিজ্ঞতা হল যেকোনো বিষয়ে কাজের ক্ষেত্রে গবেষণা খুবই সাহায্যকারী একটা বিষয়। কাজের পাশাপাশি গবেষণার কাজটা চালিয়ে গেলে আগামী দিনে সেই প্রতিষ্ঠান সমৃদ্ধ হবেই। এই ভাবে কাজ করতে এগিয়েই আমরা বড় একটা কাজ করে ফেলি, লো ব্যাক পেইন ম্যানেজমেন্টের গাইডলাইন।
চলবে…
অনুলিখন: শুক্লা সরকার ও পিয়ালী দে বিশ্বাস