ভারতের দক্ষিণের একটি ছোট্ট রাজ্য কেরল। কোভিড-১৯ এর এই ভয়ঙ্কর অতিমারীকে যে কয়েকটি দেশ বাগে আনতে পেরেছে- যেমন তাইওয়ান, হংকং, ভিয়েতনাম- ভারতের এই ছোট রাজ্য কেরলকে এখন তাদের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো তুলে ধরেছে কেরলের এই সাফল্যের কাহিনী। অনেক দেশ এবং দেশের অন্য কয়েকটি রাজ্য কেরল মডেল কে অনুসরণ করতে চাইছে। দেখা যাক কি সেই মডেল যা কেরল-কে এই করোনা যুদ্ধে বিরল সাফল্য এনে দিয়েছে-
১. কেরল ভারতের যেকোনো রাজ্যের তুলনায় মানব উন্নয়ন সূচকে এগিয়ে আছে। এই রাজ্যের আর্থসামাজিক পরিকাঠামো দেশের মধ্যে প্রথম সারিতে।
২. সাক্ষরতা, জনস্বাস্থ্যে কেরল সারা দেশে প্রথম স্থানে। বুনিয়াদী স্তরে প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্বাস্থ্যকর্মী, পর্যবেক্ষক, অসংখ্য প্রশিক্ষিত আশাকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী কেরলের সম্পদ। কেরালায় জনঘনত্ব অনুযায়ী স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা দেশের মধ্যে প্রথম সারিতে।
৩. কেরলের রাস্তা ও গণপরিবহণ ব্যবস্থা বেশ ভালো। প্রায় সমস্ত ছোটখাটো গ্রামও পাকা রাস্তা দিয়ে সংযুক্ত। এ রাজ্যে দুর্গম জায়গা প্রায় নেই বললেই চলে।
৪. সাক্ষরতার হার যেহেতু খুব বেশী, সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতাও অনেক বেশী।
৫. স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর যেকোনো আক্রমণকে কেরল প্রশাসন অত্যন্ত্য কড়া হাতে মোকাবিলা করছে।
এ তো গেল পরিকাঠামোর কথা। এবারে আসি কোভিড-১৯ অতিমারীকে কেরল কিভাবে মোকাবিলা করল সেই কথায়।
১. ২০১৮ সালে ভয়ংকর নীপা ভাইরাস কে মহামারী হওয়া থেকে আটকে দিয়েছিল কেরল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আগে থাকতেই তারা হয়েছিল সতর্ক। কেরলের একটা সমস্যা হচ্ছে, রাজ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য বিদেশে, বিশেষতঃ উপসাগরীয় দেশগুলোতে কাজ করে। এদের পাঠানো বিদেশী মুদ্রা রাজ্যের কোষাগার বৃদ্ধি করলেও এরাই আবার বিদেশ থেকে সংক্রামক ব্যাধি নিয়ে আসে।
২. উহানে নভেল করোনা ভাইরাস সংক্রমণের খবর আসতেই কেরল সতর্ক হয়ে যায় এবং প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
৩. কেরল সরকার জানতো যে কোভিড-১৯ প্রথমে তাদের রাজ্যেই ছড়াবে। হলও তাই। ভারতের প্রথম তিনজন করোনা রোগীই কেরলের। কিন্তু তারা সবাই দ্রুত সুস্থও হয়ে উঠল।
৪. পর্যটনে কেরল দেশের মধ্যে অগ্রণী। কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে, বিদেশী পর্যটকরা সংক্রমণ বয়ে নিয়ে আসতে পারে। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ শুরু হল ব্রিটিশ এবং ইতালীয় পর্যটকদের থেকে।
৫. জানুয়ারী মাসেই কেরল সরকার পুরোনো বন্ধ হয়ে যাওয়া হাসপাতাল গুলোকে সারিয়ে সেখানে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করে কোভিড হাসপাতালে পরিণত করে।
৬. ইন্টার্ন দের মেয়াদ তিনমাস বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ফাইনাল ইয়ার এম বি বি এস পরীক্ষা যারা দিয়েছে, তাদের দ্রুত রেজাল্ট বের করে ইন্টার্ন হিসেব নিয়োগ করা হয়।
৭. চব্বিশ ঘন্টার নোটিশে ৩০০ ডাক্তার এবং ৪০০ স্বাস্থ্য পরিদর্শক নিয়োগ করা হয়। এভাবে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা রাতারাতি অনেক বাড়িয়ে নেওয়া হয়।
৮. কেরল সরকার ২০,০০০ কোটি কোভিড প্যাকেজ ঘোষণা করেন। গোটা দেশের কাছে যা মডেল।
৯. রাজ্যের প্রত্যেক পরিবারের জন্য এক মাসের রেশন বিনামূল্যে দিয়েছে রাজ্য সরকার। তাতে রয়েছে ভাল, তেল, নুন, ছোলা, ময়দা, সাবান প্রভৃতি ১৬টি নিত্যপ্রজোনীয় সামগ্রী। ৮৭ লক্ষ পরিবার তাতে উপকৃত হয়েছে। এছাড়া সবাইকে ১৫ কিলো করে চাল বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে।
১০. রাজ্যর কোনো বাসিন্দা যাতে অনাহারে না থাকে সেজন্য দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক (১৪০০-র বেশী) ‘সার্বজনীন রান্নাঘর’ চালু করেছে।
১১. অন্য রাজ্য থেকে আগত পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক ক্যাম্প (৫,৫০০-র বেশী) তৈরী করেছে কেরল।
১২. কেরল হচ্ছে প্রথম রাজ্য, যেখানে প্রতি জেলায় দুটো করে কোভিড হাসপাতাল তৈরী হয়েছে।
১৩. কেরল সরকার দেশের মধ্যে প্রথম মহামারী আইন চালু করে এবং তার প্রয়োগের ব্যবস্থা করে।
১৪. ডাক্তার এবং স্বাস্থ্য কর্মীদের নিরাপত্তা অত্যন্ত কড়া হাতে সুনিশ্চিত করেছে রাজ্য সরকার।
১৫. বিদেশ থেকে আগত পর্যটক, ছাত্র-ছাত্রী এবং বিদেশে কর্মরত মানুষদের সঠিকভাবে সরকারের কোয়ারান্টাইন সেন্টারে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এয়ারপোর্ট এবং অন্যান্য চেকপয়েন্টে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়েছিল, তাদের প্রত্যেককে খুঁজে বের করে কোয়ারান্টাইন করা হয়েছে। তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের হোম কোয়ারান্টাইনে নজরে রাখা হয়েছে।
১৬. বিভিন্ন বড় জমায়েতে অংশগ্রহণ করা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন মত কোয়ারান্টাইন করা হয়েছে।
১৭. সাধারণ মানুষের সচেতনতা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেরলবাসীরা সন্দেহজনক ব্যক্তিদের বিষয়ে দ্রুত পুলিশ-প্রশাসন কে খবর দিয়ে সাহায্য করছে।
১৮. কেরলের পুলিশ বিভাগ অত্যন্ত প্রশংসনীয় কাজ করছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা, তাদের বাসস্থান থেকে হাসপাতালে আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা করা, পরিযায়ী শ্রমিকদের খুঁজে বের করে কোয়ারান্টাইন করা, ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়া, লক-ডাউন কড়া হাতে বলবৎ করা- প্রত্যেকটা কাজ পুলিশ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করে চলেছে।
১৯. এই অতিমারীর সময়ে সারাদেশে ২২,৫৬৭ টি ত্রাণ ও আশ্রয়কেন্দ্র তৈরী করা হয়েছে। তার মধ্যে ১৫,৫৪১ টি-ই কেরলে।
২০. অঙনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকায় শিশুদের ঘরে ঘরে খাদ্য পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ইন্টারনেটের সুবিধা, স্পীড বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে- যাতে ছাত্র-ছাত্রীরা বাড়িতে বসেই অনলাইনে পড়াশোনা করতে পারে।
২১. কেরাল ‘ব্রেক দ্য চেইন’ অর্থ্যাৎ ‘সংক্রমনের শৃঙ্খল ভাঙো’ -এই স্লোগান সারা রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে।
২২. কয়েকদিন আগে পর্যন্তও ৩.৫ কোটি জনসংখ্যার কেরলে কোভিড টেষ্টের সংখ্যা ছিল ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বেশী। এখনও ওই সংখ্যার নিরিখে কেরল প্রথম দিকের রাজ্যগুলোর মধ্যেই আছে।
২৩. ভারতের মধ্যে কেরল প্রথম দক্ষিণ কোরিয়ার মডেলে ‘কোভিড টেষ্টিং কিয়স্ক’ চালু করেছে। এতে টেষ্টের সংখ্যা তেমনি বাড়ানো গেছে, তেমনি রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার ব্যবস্থাও করা গেছে।
২৪. কোভিড রোগীর চিকিৎসার জন্য কেরল ১৮টি পয়েন্টের একটা ‘ষ্ট্যান্ডার্ড ট্রিটমেন্ট প্রোটোকল’ তৈরী করেছে- অন্যান্য রাজ্যও যেটা অনুসরণ করছে।
২৫. কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার জন্য কেরল প্রথম ত্রিস্তরীয় হাসপাতালের ব্যবস্থা করেছে।
২৬. সমস্ত সরকারী ও বেসরকারী চিকিৎসকদের আগে থেকেই ট্রেনিং দিয়ে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
২৭. কেরলেই প্রথম সরকারী ব্যপক হারে টেলিমেডিসিন ব্যবস্থা চালু করে এমার্জেন্সি নয় এরকম রোগের রোগীদের দূর-চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে।
২৮. কেরলেই প্রথম কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার জন্য সুস্থ হয়ে যাওয়া রোগীর রক্তের প্লাজমা নিয়ে ‘কনভালেসেন্স প্লাজমা থেরাপি’ শুরু করেছে। আই সি এম আর সেটা অনুমোদন দিয়েছে।
২৯. প্রতিদিন সন্ধ্যায় কেরলের মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সন্মেলন করে স্বচ্ছভাবে তাঁর রাজ্যের কোভিড রোগ সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্য জানিয়ে চলেছেন। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশাসনের প্রতি আস্থা বাড়ছে। ভীতি কমছে। গুজব ছড়ানো বন্ধ হচ্ছে।
এতকিছু ব্যবস্থা করার পরে কেরলের সাফল্যের পরিমাণ কি? সেটাও দেখা যাক।
১. এই লেখার সময় পর্যন্ত (২৩ এপ্রিল ২০২০, সকাল) কেরলের মোট কোভিড রোগীর ৪৩৭, সেরে ওঠা রোগী ৩০৮, সক্রিয় রোগী ১২৭, মৃত্যু মাত্র ২।
২. একসময় মোট রোগীর সংখ্যায় একনম্বরে থাকা কেরল এখন দেশের মধ্যে বারো নম্বরে আছে।
৩. কোভিড সংক্রমণের ‘কার্ভ’ কেরল প্রায় সমতল করে দিয়েছে।
৪. কেরলের সুস্থ হওয়া রোগীর সংখ্যা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশী। মৃত্যুহার দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম। যেখানে সারা পৃথিবীতে গড় মৃত্যুহার ৫.৭৫%, সারা ভারতে ৩%, সেখানে কেরলে মৃত্যুহার মাত্র ০.৫৮%।
৫. ৮৮ এবং ৯৩ বছর বয়স্ক দুজন রোগী সরকারী কোভিড হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি গেছেন।
৬. কেন্দ্রীয় সরকার কেরল মডেলের প্রশংসা করেছেন। দেশে-বিদেশে কেরল মডল নিয়ে চর্চা হয়েছে। অন্যান্য রাজ্য এবং অনেক দেশ কেরল মডেলকে অনুসরণ করতে চাইছে। তথাকথিত উন্নত দেশগুলোর মিডিয়াতে কেরলের করোনা যুদ্ধ প্রশংসিত হয়েছে।
৭. সবশেষে, কেরলের সরকারি হাসপাতালে সুস্থ হয়ে ওঠা এক ব্রিটিশ পর্যটক বলেছেন, তাঁর নিজের দেশে নয়, কেরলে চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছেন বলে তিনি এ যাত্রা প্রাণে বেঁচে গেছেন।
(তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন তিরুঅনন্তপুরমের সার্জেন ডাঃ বিজু মুরলী নায়ার)