ফেব্রুয়ারিতে ছিল মাতৃভাষা দিবস। এই মাসটা এলেই যেন মনে পড়ে আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি। কথাটা কি ঠিক বললাম? আসলে আমরা নব্বই ভাগ হলেই ধরে নিই প্রায় পুরোটা হল। আর নিরানব্বই হলে তো কথাই নেই, হয়েই গেল।
আমরা নিরানব্বই ভাগ কথা আর কাজ বাংলা ভাষায় করি, তাই বলি, আমরা বাঙালি বা বাংলা ভাষার লোক। আমাদের মধ্যে যারা বাংলা ভাষা ছাড়াও ইংরেজি ভাষায় লিখতে পড়তে পারি, তারা নিজেদের বেশ শিক্ষিত মানুষ ভাবতে চাই। এছাড়া আর এক দুটি ভাষা বলতে পারলে তো কথাই নেই। ভাবতে থাকি, আমি কে হনু রে!
ভাষা কথাটার একটা ব্যাপক অর্থ আছে। শুধু লেখা যায় আর মুখে যায় তাকেই কি ভাষা বলে? তার বাইরে কি ভাষা নেই? শুধু আমাদের দেশেই অনেক ভাষা আছে যায় কোন লেখার অক্ষর নেই। শুধু মানুষেরই ভাষা আছে আর কোন প্রাণীর ভাষা নেই? এটা কি ঠিক? আমার মনে হয় ঠিক না।
মানুষই কি সব সময়ই মুখে বলে বা লিখে ভাষাকে প্রকাশ করে? তাও তো না। একেবারে যারা কোন কথাই বলতে পারে না, অর্থাৎ বোবা আর কালা তারাও তো তাদের মনের ভাব প্রকাশ করে, কি চায় বা কি বলতে চায় নানান ভাবে ভঙ্গিতে তা প্রকাশ করে। এর বোধহয় একটা পোশাকি নাম হয়েছে, সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ। নির্দিষ্ট করে সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ না জেনে বা শিখেও আমরা অনেক এমন ভাব ভঙ্গি দিয়ে আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি, অন্যদের বোঝাতেও পারি। আমরা যখন ঠোঁটে তর্জনী দিয়ে চুপ করতে বলি, একটা শিশুও বুঝতে পারে। কিংবা কাউকে হাতছানি দিয়ে ডাকি বা হাত নেড়ে চলে যেতে বলি, সেটাও তো একরকম সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ।
একটা অবলা শিশু যখন আঙ্গুল দিয়ে সুন্দর ফুল বা পাখি মাকে দেখায়, তার মা তো ঠিকই বুঝতে পারে। এমনি করে কতো শত ভাষাই তো আমরা ব্যবহার করি। যখন দুই বিদেশী মানুষের মধ্যে মত বিনিময় হয়, নিজের নিজের বক্তব্য আমরা কি ভাষায় বোঝাই? সেই যে বেনারসের হোটেলে চিনা ভদ্রলোকের কথা বলেছিলাম, মনে পড়ছে?
হোটেলের ছেলেটি বাইরের গেটে তালা দিয়ে বেরিয়েছিল। এদিকে ঐ চিনা ভদ্রলোকের ফ্লাইট ধরার তাড়া। ছেলেটি ফিরতেই চিনা ভদ্রলোক পাখির মত দুই হাত নেড়ে ওড়ার ভঙ্গি করে বুঝিয়ে দিলেন , এরোপ্লেন ধরতে ছুটছেন। ঘুঁষি বাগিয়ে ছেলেটিকে মারার ভঙ্গি করে বুঝিয়ে দিলেন , খুব রেগে গেছেন। এই ঘুঁষি মারার ভঙ্গি দিয়ে কতো ভাবে মনের ভাব প্রকাশ করা যায়। একই ভাবে যদি কোন ষন্ডা-গুন্ডা লোক আমাকে ঘুঁষি বাগিয়ে তেড়ে আসে, আমি কি মার খাওয়ার জন্যে দাড়িয়ে থাকব? আমি তো দৌড়ে পালাবো। আবার দুটি রগচটা লোক তর্ক বিতর্ক করার সময় একজন যদি ঘুঁষি বাগিয়ে আসে আর একজন তাকে ঘুঁষি চালিয়েই দেবে। এই যে আমাদের মনের ভাব শরীরে ফুটে ওঠে, একেই ইংরেজীতে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বলে।
সামনে থেকে তো বটেই, অনেকটা দূর থেকে দেখেও আমরা অনেক রকম বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বুঝতে পারি। খেলা, বিশেষ করে ক্রিকেট খেলা আমরা ব্যাপক ভাবে টিভিতে দেখি। খেলোয়াড় , এমনকি আম্পায়ারদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আমরা বুঝে যাই। আমরা যারা দিন রাত সাধারণ মানুষের সাথে মিশছি, কথা বলছি, আমাদের কিন্তু মানুষের এই শরীরের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কোন লোকটা কি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে, খুব সহজেই বুঝে যাই। বিশেষ করে বদ মতলবে আসা লোকেদের বুঝতে আমাদের ভুল হয় না।
এতো সব গেল মানুষের ভাষা বা মানুষের শরীরের ভাষার কথা। না-মানুষদের ভাষা আছে কি? তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলে কি? আমরা কি তাদের ভাষা বুঝতে পারি? কিংবা তারা বোঝে আমাদের ভাষা? আমি যেটুকু দেখেছি, ওদেরও নিজের নিজের ভাষা আছে। কুকুরের মত, মানুষের কাছে কাছে থাকা প্রাণীদের তো অবশ্যই ভাষা আছে। ওরা নানান রকম শব্দ করে নিজেদের ভেতর ভাব বিনিময় করে। শুধু তাই নয়, আমরা কি বলতে চাই, অনেক সময়ই বেশ বুঝতে পারে। আবার ওদের কিছু বলার থাকলে আমাদের বলারও চেষ্টা করে। আমরা বুঝতে পারি না, সেটা আমাদের অক্ষমতা। সে তো আমরা চিনা কিংবা জাপানী ভাষাও বুঝি না। শুধু কথ্য ভাষাই নয়, কুকুর বা গোরুর মত মানুষের কাছে থাকা প্রাণীদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ যারা বোঝার, বেশ বুঝতে পারে।
কুকুরদের ভাষা, যা দিয়ে ওরা মানুষের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে সেটা যারা কুকুরদের কাছে রাখে তারা বেশ বুঝতে পারে।
শুধু পোষা কুকুরই নয়, একেবারে রাস্তার কুকুরদের অনেক বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আমি বেশ বুঝতে পারি। কুকুরকে তো বেশ বুদ্ধিমান প্রাণী বলা হয়। প্রশিক্ষণ দিয়ে ওদের বোম খোঁজা, খুনী খুঁজে বের করার কাজে ও লাগানো হয়।
গরুদের তো বেশ বোকা প্রাণী বলেই জানি আমরা। আমি অন্তত দু’ টি ক্ষেত্রে দেখেছি, গরুরা মানুষকে কিছু বলতে চাইছে। একবার আমাদের গোয়ালের একটা গরুর রাত্রে বেলা বাচ্চা হয়। বাচ্চাটা গড়িয়ে গোয়ালের পিছনের বাগানে চলে যায়। গোটা চারেক গরু এক সাথে ডাকাডাকি শুরু করে। ওদের ডাক শুনে দাদা বুঝতে পারে যে ওরা কিছু বলতে চাইছে। আলো নিয়ে গিয়ে দেখা যায় বাচ্চাটা নিচের বাগান থেকে উঠে আসার চেষ্টা করেছে। দাদা ঘরের ভিতর থেকে “ফুলটুশি” বলে ডাক দিলেই, একটা গরু যেখানেই থাক, “হাম্বা” ডেকে সাড়া দেয়।
টিয়া, ময়না, কাকাতুয়ার মত নামকরা পাখিরা তো মানুষের শেখানো অনেক বুলি বলতে পারে। আমি লক্ষ্য করেছি, শালিক আর কাকও আমাকে ডেকে খাওয়ার চাইছে। শুধু মানুষের সাথে যোগাযোগ করতেই নয়, ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে। নিজের নিজের সঙ্গীকে ডাকা তো আছেই, বিপদের সময় অন্যদের জানিয়ে দিতে ওরা পটু।
ডাঙ্গার আর আকাশের প্রাণীদের নানান রকম ডাক তো আমরা শুনতেই পাই। জলের অনেক প্রাণীও নিজেদের মধ্যে শব্দ করে ভাব আদান প্রদান করে। ডলফিন আর তিমিদের এরকম বেশ কিছু কথা সম্ভবত যন্ত্রে রেকর্ডও করা হয়েছে।
আমি যদি বলি শুধু প্রাণীরাই নয় , উদ্ভিদেরও নিজের মত ভাষা আছে! একই প্রজাতির উদ্ভিদ নানা সময়ে নানান রূপ নেয় কেন? গাছে ফুল ফোটা কি ওদের কোন বক্তব্য বোঝানোর জন্য নয়? আমরা বুঝি না, সেটা আমাদের অক্ষমতা, ওদের নয়।
আবার চলে আসি মানুষের ভাষায়। শুধু মনুষ্য প্রজাতিই যতো ভাষায় কথা বলে, আমরা তার হাজার ভাগের এক ভাগও কি জানি? অন্য ভাষা ছেড়েই দিলাম, আমাদের সাধের বাংলা ভাষাও কি সব সময় আমরা বুঝতে পারি? আমাদের সব থেকে পরিচিত কবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সব কবিতা বা গান কি আমরা সবাই বুঝি? একটি মূল ভাষার ভেতরই কতো রকম শ্রেণী বিভাগ। সোজা সুজি কথ্য ভাষার সাথে কাব্য বা সাহিত্যের ভাষার কতো পার্থক্য।
বাউল ফকিরদের এমন অনেক গান আছে যার মানে সোজা ভাবলে একরকম আর ভেতরের মানে আর এক রকম। প্রয়াত আচার্য সুধীর চক্রবর্তী মহাশয়ের কথায়, এগুলি সান্ধ (য ফলা নেই) ভাষা। যেমন “কেন ডুব দিলি তুই বাবার পুকুরে”, কিংবা “ভগে লিঙ্গে হলে যোগ, তাকেই বলি মহা সংযোগ”। না বুঝলে বা ওপর ওপর দেখলে একেবারে অন্য মানে বোঝায়।
এছাড়া অঞ্চল ভেদে বাংলা ভাষায় এমন কিছু কথা বা শব্দ আছে, অন্য অঞ্চলের লোকের কাছে একেবারেই অবোধ্য। “পুদ্রা” মানে কি? “জাঁকে টালাই দিব” কোন অঞ্চলের ভাষা?
ভাষা নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন, ডাক্তার পাত্র। উনি মাঝে মাঝেই শ্রদ্ধেয় রবি চক্রবর্তি আর কলিম খান মহাশয়ের কাজের উল্লেখ করে বলেন , প্রতিটি বাংলা শব্দের ভেতরে একটি গূঢ় অর্থ আছে। আমাদের মত সাধারণ মানুষের কথা নাই বললাম; একজন বিদুষীকে দেখেছি, “যোনি মধ্যে প্রোথিত শিব লিঙ্গ” ব্যাপারটিকে অশ্লীলতার চুড়ান্ত বলে ব্যাখ্যা করেছেন। যে কোন ভাষাকেই গভীর ভাবে না বুঝলে কদর্থ বোঝাই স্বাভাবিক।
কোন ভাষা কতোটা সমৃদ্ধ কি দিয়ে বোঝা যায়? সংস্কৃত ভাষা এক সময় ছিল, গোটা পৃথিবীতে না হলেও, এ দেশের শ্রেষ্ঠতম ভাষা। আজ আর্থ সামাজিক বিবর্তন সেই ভাষাকে সব থেকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। এদেশে একই ভাবে ইংরেজী ভাষার চাপে বাংলা ভাষা পিছিয়ে পড়ছে। আমাদের আবেগ কি পারবে এই আর্থ সামাজিক চাপের মধ্যে বাংলা ভাষাকে প্রথম দিকে জায়গা করে দিতে?