- সময়টা খৃষ্টপূর্ব হাজার সাল। স্থান বর্তমান পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের একদা নাতিশীতোষ্ণ শ্যামল অঞ্চল। হ্যাঁ, এখানে একদা কথাটাই প্রযোজ্য কেন না গত চারশো বছর ধরে মৌসুমি বায়ু আর এদেশে আসছে না, বরং তীব্র ঠান্ডা আর শুকনো আবহাওয়া দেশটাকে শুষ্ক মরুভূমিময় এক রুক্ষ প্রান্তরে বদলে দিয়েছে। তার ওপরে সিন্ধু নদী তার পথ বদলে অন্য খাতে বইছে।
হরপ্পা মহাঞ্জোদারো সভ্যতা মৃত্যুর পদধ্বনি শুনেছে। এই সভ্যতার একটা লিপি ছিলো (pictography)–ছবি দিয়ে তৈরি লিপি, পরিকল্পিত শহর ছিলো, ব্রোঞ্জ মাটি আর পাথরের নানা জিনিস ছিলো। তবে অস্ত্র ছিলো না। এদের প্রধান দেবতা ছিলো পুরুষ লিঙ্গ। এদের ব্যবসা ছিলো মেসোপটেমিয়া থেকে পলিনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত।
এরা জলের সন্ধানে ছোটো ছোটো দল বেঁধে পশ্চিম আর পূবের দিকে চলে যেতে শুরু করেছে। পূর্ব দিকে এক শস্য শ্যামল ভূমি আছে। আর পশ্চিমে দেশ বহুদূর। (সাল জানা যায় না, তবে বহুদিন আগে।)
একই সময়ে একদল যুদ্ধবাজ মানুষ ইরান দেশ থেকে হরপ্পা মহাঞ্জোদারো হয়ে চলেছে পূব দিকে। আরেক দল চলেছে ইয়োরোপের উত্তর দিকে। এরা পৌঁছে গেল জার্মানি পর্যন্ত। এরা সবাই আর্য। যে আর্যরক্তের গর্বে অন্ধ হয়ে হিটলার শুধু আশী লক্ষ ইহুদীকেই হত্যা করেছিলেন তা নয় – গোটা বিশ্বকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছিলেন। এদের ভাষা ছিলো আদি সংস্কৃত। সংস্কৃতের জন্মস্থান পারস্য বা মতান্তরে সিরিয়া।
এই সমস্ত লোকজন চললো শস্যশ্যামল ভারতবর্ষের উদ্দেশে।
ভারতবর্ষে তখন রয়েছে ভারতের আদি বাসিন্দারা। কেউ দ্রাবিড়িয়ান, কেউ মঙ্গোলয়েড, কেউ আফ্রোএশিয়ান। এদের মূল ভাষা দ্রাবিড়িয়ান। সংস্কৃত নয়, তামিল আসলে পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষা (পাঁচ হাজার বছরের পুরনো)। এদের পূজ্য দেবতা ছিলেন বনবৃক্ষ, পশুপাখি, আকাশ আর প্রকৃতির অমোঘ সব শক্তি, এর সঙ্গে শিব ঠাকুর। এরা ছিলো অনার্য। তাই এদের দেবতারাও ছিলেন অনার্য। তাই শিব ঠাকুর অনার্য, শ্মশানে মশানে যাঁর বিচরণ। এনার প্রথমা স্ত্রী দাক্ষায়ণী।
ভারতের কিছু আদিবাসী তাদের অপরাজেয় দেবতা রাবণের পুজো করে। রাবণ হলেন ইস্পাতের দেবতা, যিনি প্রাচীন কালে ইস্পাত তৈরির নিয়ম জানতেন। দেবতারা তাই ওনার সঙ্গে লড়াইয়ে বারম্বার পরাস্ত হয়েছিলেন। তারপর ছলনাময়ী এক নারীর সাহায্যে দেবতারা রাবণকে পরাস্ত করেন। ঐ আদিবাসীরা দুর্গা পুজোর কটি দিন অরন্ধন পালন করে। (কৃতজ্ঞতাঃ শ্রীমতি শর্মিষ্ঠা দাস, সমাজকর্মী ও চিকিৎসক।) মহারাষ্ট্র এবং পশ্চিমবঙ্গের গোন্দ উপজাতিরা এখনও রাবণের পুজো করে। টাটার ইস্পাত কারখানা আসার আগে এদের তৈরি ইস্পাতের খুবই কদর ছিলো।
ইন্দো ইরানিয়ানরা সিন্ধু শব্দটা উচ্চারণ করতে পারতো না। তাই তারা সিন্ধুনদের দেশ বলতে হিন্দুস্তান বলতে আরম্ভ করলো। এবং নিজেদের হিন্দু এবং আর্য বলতে আরম্ভ করলো (দ্রষ্টব্য রামায়ণ মহাভারতের আর্যপুত্র সম্বোধন)। তবে রামায়ণ যে সংস্কৃত ভাষায় লেখা সেটা সর্বোত্তম বা উচ্চাঙ্গ বা ক্লাসিক সংস্কৃত। এই সর্বোত্তম সংস্কৃতের উদ্ভব খৃষ্টপূর্ব পাঁচশো শতকের মাঝামাঝি। এবং এটা বৈদিক সংস্কৃত নয়। এই বহিরাগত আর্যরা গ্রীক এবং রোমান দেবদেবীর আরাধনা করতেন। এলেন দেবতাদের রাজা, প্রেমের দেবতারা, শক্তির দেবতা এবং সঙ্গে এলো জাতিভেদ প্রথা। যে জাতিভেদ আমাদের বর্তমান ভারতবর্ষকে বিদ্বেষবিষ আর ঘৃণায় ভরে দিয়েছে।
এই প্রাচীন প্রকৃতি পূজারী ভারতীয় উপজাতিরা যুদ্ধবাজ ইন্দো ইরানিয়ানদের সঙ্গে যুদ্ধে পারলো না। গিয়ে আশ্রয় নিলো মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ের মালভূমির অনুর্বর পাথুরে দেশে। তাদের অর্থাৎ ভারতের আদি বাসিন্দাদের বর্তমান যুগে শিডিউল কাস্ট এবং দলিত আখ্যা দিয়ে প্রায় সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বিচ্যুত রাখার এক অদ্ভুত মানসিকতা তৈরি হয়েছে। এরপর শুরু হলো আর্য সভ্যতার গল্প। এই ইরাণবাসীদের পূজ্য দেবতা ছিলো ইন্দ্র ইত্যাদি আর্য দেবতারা। এদের রক্তে ছিলো যুদ্ধ আর অস্ত্রের ঝনঝনানি। বাড়তে লাগলো সাম্রাজ্য।
আমাদের মনে রাখতে হবে এই ইন্দো ইরানিয়ানদের সঙ্গে এসেছিলো হরপ্পা বাসীরা। তাদের পূজ্য ছিলো সূর্য আর পুরুষ লিঙ্গ – পৌরুষের প্রতীক। সেই সব ধর্মবিশ্বাস মিশে গেল ইরানের বহিরাগতদের বিশ্বাসে। তৈরি হলো লিঙ্গ পুজো।
হরপ্পার বাসিন্দাদের আমরা হরপ্পান বলবো। হরপ্পানরা ছিলো ব্রোঞ্জ যুগের ঝঞ্ঝাটহীন ব্যবসায়ী। ঝঞ্ঝাট মানে যুদ্ধ বিগ্রহে বিশেষ উৎসাহ ছিলো না। চাষবাষ করে ব্যবসা করে নিরামিষ খেয়ে মহানন্দে থাকতো। এদের বলা হতো অ্যান্ড্রোনোভো সংস্কৃতির মানুষ। এরা নর্দমা পুকুর বাড়ি তৈরিতে উৎসাহী ছিলো। হরপ্পা মহেঞ্জদাড়োতে কোনও বড়ো মন্দির পাওয়া যায় না। কিছু মুদ্রা পাওয়া গেছে। সব থেকে বড়ো কথা এদের তৈরি কোনও শূকরের মুর্তি নেই। সম্ভবতঃ এরা শূকর পছন্দ করতো না।
আর ইরানবাসীদের প্রিয় খাদ্য ছিলো মাংস। এরাও ইরানে গিয়ে স্থিতিশীল হয় । হয়তো মুসলমানরা এদের থেকেই শূকর বিরোধী হয়ে ওঠে । ঐতিহাসিকরা এদের নূরিস্তানি বলতেন। এদের ধর্ম ছিলো শিন্টো – যেটা আপাততঃ জাপানে পাওয়া যায়। এরা এক ঈশ্বর বা এক পরম শক্তিকে (hrta) বিশ্বাস করতো। বিশ্বাস করতো এক ঐশ্বরিক উদ্ভিদে swahma (সংস্কৃত সোমরস ওরা উচ্চারণ করতো hoama কেননা ওদের লিপিতে “স” বর্ণটি অনুপস্থিত। পূজা করতো haraxvaiti নামক দেবীকে। মনে রাখবেন ওদের বর্ণমালায় ‘স’ অনুপস্থিত। ‘স’ এর বদলে ওরা ‘হ’ ব্যবহার করতো। তাহলে ঐ দেবী হয়ে উঠলেন সরস্বতী। এদের ছিলো দৈব (daiva) আর অসুর ( asura) সঙ্গে ছিলেন প্রভাতের দেবী (ame no uzume) আর সর্পঘাতী দেবতা (yamata no archi) এদের এই ধর্মভাব থেকেই পরবর্তীতে তৈরি হয় হিন্দু ধর্ম।
এছাড়া ভারতে বারবার এসেছে হুন মুসলমান। এসেছে আক্রমণ করতে। কেউ এসেছে সুদূর মঙ্গোলিয়া থেকে– কেউ গ্রীস থেকে– কেউ বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে। সবাই ধীরে ধীরে ভারতবাসী হয়ে গেছে। সব ধর্ম মিলেমিশে এক প্রেমের ধর্ম তৈরি হয়। আসেন চৈতন্যদেব, লালন ফকির, তুকারাম, সন্ত কবীর, গুরু নানক, গৌতম বুদ্ধ। হয়তো বা অনেকেই বাদ চলে যাচ্ছেন। সুফি সাধকরা আসেন। যত মত তত পথের রামকৃষ্ণ দেব আসেন। ভারতের ধর্ম বিবর্তন একটা অজানা অধ্যায়। হয়তো বখতিয়ার খিলজির হাতে নালন্দা ধ্বংস না হলে আরও বিশদ কিছু তথ্য জানা যেতো তাই হিউয়েন সাং, আল বিরুণীর কিছু লেখা আমাদের বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন।
ধর্ম মিশ্রণ ও রূপান্তর ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন
এটাই এই অসম্পূর্ণ প্রবন্ধটির শেষতম অংশ। ক্রমশঃ সব ধর্ম মিলেমিশে এক দেহে হলো লীন। এ ধর্মের আচার অন্য ধর্মে মিলে গেল। কোথায় ধর্ম আরম্ভ আর কোথায় বিভেদ আরম্ভ যেমন বোঝা যায় না ঠিক তেমনই মিলের শুরু আর বিদ্বেষের শুরুটাও রহস্যাবৃত। ভারতবর্ষের আদি ধর্ম ছিলো আদিবাসীদের ধর্ম আর দ্রাবিড়িয়ান ধর্ম। দ্রাবিড়িয়ানরা করতো শিবের পুজো। হরপ্পাবাসীরা পুরুষ লিঙ্গ পুজো। সম্ভবতঃ এই দুইয়ের মিশ্রণে হলো শিবলিঙ্গ অর্চনা।
ইরানের লোক জন নিয়ে এলো ঊচ্চ নীচ জাতিভেদ। মুসলিম ধর্মের আদিতে জাতিভেদ ছিলো না। কিছুটা শাসকদের চাপে আর কিছুটা জাতিভেদ বা বর্ণাশ্রম থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টায় বহু নিম্নবর্গীয় মানুষ মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করলো। তাদের ভেতরে হিন্দু দেবদেবীদের একটা প্রভাব রয়ে গেলই– ফলতঃ নতুন নতুন দেবতা পীরবাবাদের আবির্ভাব হতে থাকলো। রামায়ণের রচনা কাল খৃষ্টপূর্ব তিনশো সাল নাগাদ তার বহু আগে আর্যরা ভারতের মাটিতে পা রেখেছে। সুতরাং এক্ষেত্রে রামায়ণ একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ হতে পারে না। কেননা প্রাচীন সংস্কৃত অর্থাৎ আদি সংস্কৃত এবং রামায়ণের উচ্চাঙ্গ সংস্কৃত সম্পূর্ণ আলাদা। ঊচ্চাঙ্গ সংস্কৃতের উদ্ভব হয় মাত্র খৃষ্টপূর্ব পাঁচশো সাল নাগাদ।
বেদ মূর্তি পুজোর তীব্র বিরোধিতা করে (ঋকবেদ ও যজুর্বেদ) এবং ইরানের লোকেদের পরম শক্তি বা ইউনিভার্সাল ফোর্সের প্রচলন করে। আবার আদিবাসী দ্রাবিড়িয়ান এদের মূর্তি পুজোয় আকৃষ্ট হয়ে তৈরি হয় বিভিন্ন দেব দেবীর মূর্তি।
বেদে স্বর্গ নরক কিছুই ছিলো না বরং এক মহাশক্তিতে অথবা প্রকৃতির পাথর পাহাড় আর মাটিতে মিশে যাওয়ার কথা বলা ছিলো। ক্রমশঃ অন্য ধর্মগুলোর প্রভাবে স্বর্গ নরক প্রভৃতি লোভ এবং ভয় দেখানো শুরু হলো।
বেদে পুজো এবং অতিথি সৎকারে পশু বলি– বিশেষ করে গো বলির কথা বলা আছে। এতে জানোয়ারটি সরাসরি মুক্তি পায় এবং এই জানোয়ারটিকে উৎসর্গ করে বলিদান করলে উৎসর্গকারির পুণ্য হয়। ঋগবেদ (১০/৮৫/১৩) কন্যার বিবাহে গরু এবং ষন্ড বলিদান বিধেয়।
ঋগবেদ (৬/১৭/১) ইন্দ্র নিয়মিত গরু, অশ্ব এবং ষন্ড মাংস ভোজন করতেন। উদাহরণ বাড়িয়ে কাজ নেই। স্বামী বিবেকানন্দ ও মাংস এবং গো মাংস ভোজনের নিদান দিয়েছিলেন। কিন্তু মুসলমানরা এসে যখন প্রবল আগ্রাসন এবং ধর্মান্তকরণ শুরু করলো তখন হিন্দু ধর্মে গোমাংস খাওয়া নিষিদ্ধ হলো। কেননা মুসলমানরা গোমাংস গ্রহণ করে। এটা একটা বৈরিতা।
বৈদিক সাহিত্যে উপবাস বলতে মূলতঃ আত্মিক উপবাস বলা হয়েছে। অন্ধকার ঘরে থেকে– মৌনি পালন করে মনকে চিন্তামুক্ত রাখাটাই মূল বক্তব্য ছিলো। মুসলমানদের রোজা রাখা দেখে হিন্দুদের উপবাস প্রভৃতি ক্রমশঃ জাঁকিয়ে বসে।
মুসলিম ধর্ম, খৃষ্ট ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম সবাইকারই একজন করে প্রবক্তা বা মহাপুরুষ আছেন– হিন্দু ধর্মের সেরূপ কিছু ছিলো না। না ছিলো কোনও নির্দিষ্ট আচার বিধি বা কোনও অবতার লিখিত বাণী। সুতরাং উপস্থিত হলো বিভিন্ন উগ্র ধ্বজাধারী ধর্মগুরুর দল– নিত্য নতুন নিয়ম আর পশ্চাৎগামী মতবাদ নিয়ে। তাই হিন্দু ধর্ম ক্রমশঃ গোঁড়ামি আর অন্ধত্বের দিকে এগিয়ে চলেছে। আর্যভট্ট এবং বিভিন্ন মণীষীদের বাদ দিয়ে নিয়ে আসছে শিক্ষায় ধর্মীয় নিগড়।
আপাততঃ হিন্দুদের এই অসহায় অভাববোধ থেকে মুক্তি দিতে মুহুর্মুহু বহু মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটেই চলছে। দিকদিগন্ত মহাপুরুষে সমাচ্ছন্ন। প্রত্যেকেই এক একজন অবতার। ভক্ত এবং সম্পদ তাঁদের উপচীয়মান।
মানুষেরই বা দোষ কোথায়? যখন রাজা অর্থ বিত্ত আর ক্ষমতার লোভে অন্ধ। গরীব মানুষ গরীবতর হচ্ছে। সংসার ছোটো হতে হতে পরমাণু সদৃশ। আইন যখন ক্রয়যোগ্য তখন গরীব নিরন্ন মানুষকে দিশা দেখানোর কেউ কোত্থাও নেই। সুতরাং নেতৃত্বহীন সাধারণ মানুষেরা শনি বৃহস্পতি শুক্রবার ওমুক বাবা তমুক মা আর গুরুদের পদতলই ভরসা করছে। মুসলমানরা শিক্ষা খাদ্য আর কাজের নিরাপত্তাহীনতায় ধর্ম আঁকড়ে বেহস্তে বা জন্নতে যাওয়ার রাস্তা তৈরি করছে।
দোষ কোথায় এটাই এখন আমাদের বিবেচ্য বিষয়।
১৪/৩/২১