লখনৌয়ের কনকনে ঠাণ্ডা, দুদিন সূর্যের দেখা নেই, প্রবল শৈত্য প্রবাহ চলছে উত্তর ভারত জুড়ে। এক কাপ গরম চা আর বান মাখন খেয়ে সবে বসেছি ও পি ডি-তে। আমাদের ও পি ডি কর্মচারী খেমরাজজি ফাইলটা এনে সামনে রাখলো। রামখিলাবন রাজভর, জিলা লখিমপুর খেরি, মনে মনে প্রস্তুত হলাম এক দফা বকাঝকা করার জন্য। গত ছয় মাস ধরে এই পেশেন্ট নিজের ইচ্ছেমত আসে, কিছুদিন চিকিৎসা করায় আর চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখে না বলে চলে যায়। প্রতিবারই এক অজুহাত “কি করব ডাক্তার বাবু পয়সা শেষ হয়ে গেছে। আমি গরীব আদমি। মাফ কর্ দিজিয়ে গরিব আদমি হুঁ।”
প্রতিবারই তাকে বলি “অসুখটা তো আর গরীব আদমি মানবে না, সব কিছুর একটা নিয়ম থাকে, বারবার অর্ধেক চিকিৎসা করলে তুমি কোন দিন ঠিক হবে না।“
সে প্রতিবারই বলে “এবার ঠিক মতো চিকিৎসা করাব।“
ময়লা ধুতি আর চাদর গায় ঢুকলো রাম খিলাবন, পিছন পিছন ১০-১১ বছরের লবকুশ, রামখিলাবন -এর বড় ছেলে (রামের ছেলের নাম তো লব কুশই হবে)। এই ছেলেটি প্রত্যেকবার বাবার সাথে আসে। বাবার চিকিৎসা করায় আর সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যায়।
এবার দেখলাম রামখিলাবনের স্বাস্থ্য আরো ভেঙেছে, প্রায় কঙ্কালসার চেহারা। বললাম “মুখ দিয়ে কিছু খেতে পারছো?”
রামখিলাবন খাদ্যনালীর ক্যান্সারে আক্রান্ত।
বলল “শুধু জল আর লিকুইড।”
বললাম “এবারও বড় কেউ সাথে আসেনি? এই ছোট বাচ্চাটাকে এনেছো!”
রামখিলাবন বলল “আর তো কেউ নেই, ডাক্তার বাবু, এই বড় ছেলে।”
রামখিলাবনের একটা সিটি স্ক্যান করতে দিলাম, মাঝে অনেক দিনের ট্রিটমেন্ট গ্যাপ, খুব সম্ভাবনা অসুখটা খাদ্যনালী থেকে শরীরের অন্য জায়গায় ছড়িয়ে গেছে।
দুদিন পর রামখিলাবন আর লবকুশ এলো সিটি স্ক্যান রিপোর্ট নিয়ে। যা সন্দেহ করেছিলাম তাই অসুখটা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গেছে।লাস্ট স্টেজ।
খানিকক্ষণ আলোচনা করলাম রামখিলাবন আর ওর ছেলের সাথে, বোঝালাম চিকিৎসার ফলাফল খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়, আর এই শারীরিক অবস্থায় কেমোথেরাপি চিকিৎসা নেওয়ার মতো শরীরে শক্তিও নেই, পুষ্টির অভাব অনেকদিন ঠিকমত না খেতে পাওয়ার জন্য।
রামখিলাবন বলল ”ডক্টর সাব, কিছু একটা চিকিৎসা করুন আমি মরে গেলে সংসারটা পথে বসবে। এই ছেলেটাকে মোটামুটি শিখিয়েছি টেলারিং এর কাজ, কিন্তু এখনো ছোট, ও সংসার চালাতে পারবে না।
শেষ অব্দি ঠিক হলো সামান্য রেডিয়েশনের চিকিৎসা করা হবে, খাদ্যনালীটা যদি একটু খুলে যায় আর রামখিলাবন মুখ দিয়ে কিছু সেমি সলিড খাবার খেতে পায়। এই চিকিৎসায় কাজ হলে, রামখিলাবন একটু শক্তিশালী হলে কেমোথেরাপি চিকিৎসা শুরু হবে ।
যথারীতি রামখিলাবনের রেডিওথেরাপি শুরু হল। বাপ বেটা দুজনে হাসপাতালের করিডোরে থাকে, আরো অন্যান্য অনেক পেশেন্টরা হাসপাতালে করিডোরে রাতে ঘুমোয়। সামনের লনে লবকুশ একটা ছোট গ্যাস স্টোভে রান্না করে ডাল, ভাত রুটি, তারপর ডালের জল ভাতের জল, কখনো বা ডালে জলে ভাত চটকে একটা সিরিঞ্জ দিয়ে বাবার নাকের লাগানো নল দিয়ে বাবাকে খাইয়ে দেয়।তারপর রাতের বেলা কম্বল মুড়ি দিয়ে বাবাকে নিয়ে হাসপাতালের করিডোরে ঘুমায়।
এক রবিবার ডিউটি রুমে বসে কম্পিউটারে ডাটা এন্ট্রি করছি আমার থিসিসের, হঠাৎ দেখি দরজায় লবকুশ। আমি বললাম “কিরে খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?”
সে বললে “হ্যাঁ, ডাক্তার বাবু, আপনার?”
ছেলের ভদ্রতাবোধে ভালো লাগলো, বললাম “হ্যাঁ, কি রান্না করলি আজকে?”
“ডাল আর ভাত, আপনি ক্রিকেট খেলেন?”
আমি বললাম “হঠাৎ?”
“না, ওই যে ব্যাট বল রাখা!”
বললাম “নারে, সে গত মাসে একটা ম্যাচ হয়েছিল, তখন সবাই মিলে কেনা হয়েছিল, সময় কোথায় ক্রিকেট খেলার?”
দেখলাম ব্যাট বলটার দিকে সে আগ্রহ ভরে তাকিয়ে আছে। বললাম “তুই নিবি ব্যাট বলটা?”
সে বলল “না না, আপনার জিনিস আমি কেন নেব?”
আমি জোর করেই তার হাতে ধরিয়ে দিলাম ব্যাট আর টেনিস বলটা।
ব্যাট বল হাতে নিয়ে তার মুখ উদ্ভাসিত, ধন্যবাদ জানিয়ে নাচতে নাচতে চলে গেল তাদের অস্থায়ী আস্তানা হাসপাতালের করিডোরে প্রান্তে, যেখানে তাদের গৃহস্থালির সরঞ্জাম রাখা। একটা ছোট উনুন দুটো কম্বল, দু’চারটে জামাকাপড় আর তার পাশে ঠাঁই পেল একটা ক্রিকেট ব্যাট আর টেনিস বল।
এরপর যখনই দেখেছি লবকুশ রান্নাবান্নার ফাঁকে, বাবাকে দেখা শোনার ফাঁকে সেই ব্যাট বল নিয়ে নিজের মনে খেলছে, আর কখনো সেটাকে হাত ছাড়া করছে না, পাছে চুরি হয়ে যায়।,
দিন যায়, লখনৌয়ে ঠান্ডা আরো কামড়ে ধরে, লাস্ট স্টেজ ক্যান্সারের পেশেন্ট রামখিলাবন নিউমোনিয়ায় পড়ে। বহুদিনের অপুষ্টিতে ভোগা শীর্ণ শরীর বেশিদিন টানতে পারে না। দিন পাঁচেকের হালকা লড়াই শেষে রামখিলাবন তার ১১ বছরের ছেলের কাঁধে সংসারের দায়িত্ব দিয়ে এই বিশাল পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়।
আমাদের বয়স্ক ওয়ার্ড বয় পন্ডিতজির সাহায্যে শীতের রাতে ১১ বছরের লবকুশ রাজভর তার বাবার পার্থিব শরীর নিয়ে রওনা দেয় তার গ্রামের দিকে একটা শববাহী গাড়ি করে।
ওদের গাড়িতে তুলে দিয়ে এসে দেখি হাসপাতালের করিডোরে ওদের অস্থায়ী গেরস্থালি গুছিয়ে দিয়েছে পণ্ডিতজি শববাহী গাড়ির ছাদে, একটা উনুন, দুটো কম্বল, দু’চারটে জামাকাপড়, ভুলে গেছে ব্যাট আর বলটা যেটা ছিল লবকুশের সর্বক্ষণের সঙ্গী।
ব্যাট বলটা হাতে নিয়ে ভাবলাম ছুটে যাই গাড়িটা হয়তো এখনো হাসপাতালের গেট পেরোয়নি।
পরমুহূর্তে সংযত করলাম নিজেকে, লবকুশের কাঁধে এখন বাবার শবদেহ, কাল থেকে হাতে তুলে নিতে হবে টেলারিং মেশিন, ব্যাট-বলের প্রয়োজন তার ফুরিয়েছে।