১.
ওয়ান-টু-থ্রি… পাম্প! ওয়ান-টু-থ্রি… পাম্প!
আঙুলের চাপে বারবার উঠছে-নামছে ছোট্ট বুক। বুকের মাঝের জায়গাটা লাল হয়ে উঠেছে। প্রতিবার চাপের সাথে সাথে নাক-মুখ দিয়ে উঠে আসছে তাজা রক্ত! সাদা চাদরে ঢাকা বেডে রক্ত ছিটকে পড়ছে! রক্ত ছিটকে এসে পড়ছে সবুজ গাউনে। স্যাচুরেশন মেশিনটা ট্যাং ট্যাং আওয়াজ তুলে জানিয়ে দিচ্ছে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা মাত্র বিয়াল্লিশ!
– ব্র্যাডি হচ্ছে ডক্টর। হার্ট রেট ফিফটি সিক্স!
– অ্যাড্রিনালিন… আর কিচ্ছু করার নেই
মিনিট দুয়েক বাদেই কয়েকটা ঝাঁকুনি দেওয়া শ্বাস নিয়ে নেতিয়ে পড়লো শরীরটা। চোখের মণি স্থির। সাংঘাতিক ইনফেকশন আর রক্তক্ষরণের রোগ। যার পোষাকি নাম ডিসেমিনেটেড ইন্ট্রাভাসকুলার কোয়াগুলেশন। শরীরে লড়াইয়ের অজস্র চিহ্ন নিয়ে থেমে গেল আড়াই কেজির ফ্যাকাসে চেহারাটা।
পাশের ঘরে হার্টের রোগ আর মস্তিষ্কে অক্সিজেন হ্রাসজনিত খিঁচুনি নিয়ে ভর্তি বাচ্চারও তখন প্রায় শেষ অবস্থা। চামড়াগুলো শক্ত হয়ে এসেছে। গোটা গায়ে সাদা-লাল ছোপ ছোপ। যা যা করার সব করে ফেলা হয়েছে। এরপর হাত গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কিচ্ছু করার নেই। যে কোনও সময়ই…
২.
মারীর দেশের কথা লিখতে বসলে বরাবরই শুধু বিয়োগের ছবিগুলো ভেসে ওঠে। এই যে প্রতিদিন এত শত বাচ্চা সুস্থ হয়ে বাড়ি যাচ্ছে, তাদের সবাইকে ছাপিয়ে জেগে থাকে হাঁ করা মুখ, ঠান্ডা-শক্ত হাত, স্যাচুরেশন মেশিনের লালরঙা শূন্য। চিকিৎসক হওয়ার একটা বড় যন্ত্রণা- বেশিরভাগ মৃত্যুই অনেক আগে থেকে দেখতে পাওয়া। যেখানে কোনও আবেগ নেই, কোনও অলৌকিকের প্রত্যাশা নেই। হারার দিনে মৃত্যুর সাথে মই-সাপের খেলায় ‘সাত’ পড়ে না কোনোদিন।
নিশ্চিত ভবিতব্য বুঝে যাওয়ার পরেও ধুঁকতে থাকা শরীরগুলোর সামনে স্রেফ হাল ছেড়ে বসে থাকা অভ্যেস করতে করতে আমার বসন্ত কেটে যায়।
৩.
ব্যস্ত সরকারি হাসপাতালে বেড খালি থাকে না বেশিক্ষণ। যে বেড কিছুক্ষণ আগেই রক্তে মাখামাখি হয়ে ছিল সেটা এখন ধুয়েমুছে সাফ। নতুন সবুজ চাদর। নতুন শিশু এসে গেছে। নতুন যন্ত্রণা। নতুন যুদ্ধ। আগের ঘন্টার হেরে যাওয়ার রেশ থাকতে দিলে চলে না। আগের বাচ্চার ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ লেখা কলমেই লেখা হয় নতুন বাচ্চার ‘রিসিভিং নোট’!
যে বেডে ক’দিন আগেই রক্তমাখা নিস্পন্দ দেহ শুয়ে ছিল সেই একই বেড থেকেই সুস্থ হয়ে মায়ের কোলে ফিরে যাবে অন্য কেউ।
৪.
দ্বিতীয় হুগলি সেতুতে ওপর অসংখ্য গাড়িতে আলোর মেলা। আমি ক্রমশ ক্ষুদ্র-নগণ্য হয়ে জনসমুদ্রে মিশে যাচ্ছি। হয়তো আমার পাশের মানুষটিই কোনও মৃত শিশুর আত্মীয়। পাশের কিশোর ছেলেটিই হয়তো হাসপাতালে মৃতপ্রায় অবস্থা থেকে সুস্থ হয়ে ফিরেছিল। খুব সম্ভবত তাদের কাউকেই কোনোদিন চিনবো না।
সেতু শেষের মুখে চাপ চাপ ধোঁয়াশা। বেশিদূরে দৃষ্টি যায় না। ধোঁয়া ধোঁয়া অন্ধকার ছাপিয়ে ফুটে আছে টকটকে লাল শিমুল। ধূসর শহরে বসন্তের সোহাগ। মারীর দেশে স্বজন হারানোর কান্না ছাপিয়ে উঠছে সদ্যোজাতর কান্না। একই তো কান্না! কোথাও মৃত্যুর শীতলতা, কোথাও জীবনের উষ্ণতা হয়ে ফুটে ওঠে। শিমুলে-পলাশে রঙ লাগার দিনে সেসব ধূসর ভুলি কী করে?