সকালটা মেঘলা মেঘলা ছিলো। বাতাস বৃষ্টি বৃষ্টি। আমাদের বুড়ো হাতুড়ে ওনার স্কুটারটা হবু রোদের আয়ত্ত্বের বাইরে একটু তাক মতো দন্ডায়মান করলেন। ছায়া মাড়িয়ে মাড়িয়ে আমাদের সকলের পরিচিত হাবুদার দোকানে গিয়ে দাঁড়ালেন। সরকার সাতটা থেকে দশটা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখার হুকুমজারি করেছে। করোনা মহামারীর উৎপাতের ঠেলায়। হাবুদারও সময় হয়ে এসেছে, এবার সব মালপত্র গোটাবে। দুই বুড়ো এই সময়ে একটু সুখদুখের কথা বলেন। একটু তপ্ত চীনাদের প্রিয় পানীয় সেবন করেন।
এমন সময় একটা বেশ ঢ্যাঙা একমাথা ঝাঁকড়া চুল, একজন মধ্যবয়স্ক সাইকেলে করে এলেন। সাইকেল একটু টলমল করছে। পাশেই দেশীয় মদ্যের দোকান- কাজেই উপস্থিত কয়েকজন ধরেই নিলো মানুষটি সুরসিক।
হাতুড়ে ছেলেটাকে, আমরা একে ছেলেই বলবো, চেনেন। এক ভাই একলা মানুষ। এই পঞ্চাশোর্ধ অবিবাহিত ছেলেটা প্রাইভেট টিউশনি করে দিন চালাতো। শুধু দিন চালাতো না মা বাবাকেও চালাতো। অর্থাৎ বাজার হাট দুএকটা রান্নার পদ- মানে মা যেগুলো পারতো না সেগুলো আরকি। হাতুড়ের সঙ্গে দিব্য ভালোই পরিচয় আছে। এক গভীর রাতে, এর নাম ধরুন বিষ্ণু, হাতুড়ের হাত ফোনে ডাক দিলেন।বিষ্ণু ওনার মরণাপন্ন মাকে অটোরিকশা করে যাদবপুরের মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাচ্ছিলেন, পথে মা চিরতরে চক্ষু বোঁজেন। না হাসপাতালে মরা মানুষের সার্টিফিকেট দেবে, না অটোওয়ালা সার্টিফিকেট ছাড়া এই নিশুতি রাতে ডেডবডি নিয়ে যাবে। রাতে ওনারা রোঁদে বেরোন,সার্টিফিকেট ছাড়া বডি দেখলে সব ছোঁক ছোঁক করবেন।
রাত তখন সত্যিই নিশুতি, দুর্দারুণ কুকুরগুলো পর্যন্ত ল্যাজের মধ্যে মাথা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়েছে। অগত্যা হাতুড়ে ওনার দুচাকা নিয়ে-কুকুরদের ঘুম ভাঙিয়ে-ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে যাদবপুর চললেন।
তখনও বিষ্ণু সিগারেট খেতো, হাতুড়ের সঙ্গে ভাগাভাগি করে রাতের শেষ সিগারেটটা খেয়ে সার্টিফিকেট ইত্যাদি সেরে যে যার পথে……
“কি ব্যাপার বিষ্ণুবাবু” হাতুড়ে প্রশ্ন করেন “রিপোর্ট হয়েছে?”
বিষ্ণুবাবু জ্বর গা মাথা ব্যথা নিয়ে হাতুড়ে বুড়োকে ফোন করেছিলেন। বুড়ো কিছু ওষুধ বলেন আর করোনা পরীক্ষাটা করাতে বলেছিলেন। পাঁচদিন পরে রিপোর্ট নিয়ে এসেছেন। বিষ্ণুবাবু সাইকেল থেকে নামতে গিয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম করেন কিন্তু সামলে নিয়ে এগিয়ে আসেন।
“রিপোর্ট তো ভালো আছে” মোবাইল ফোনে পাঠানো রিপোর্টটা দেখতে দেখতে বিষ্ণুবাবুর পিঠে হাত রাখেন “যান বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিন আর নুন লেবু চিনির শরবৎ বানিয়ে খেতে থাকুন”।
আবার বোধহয় একটু টলমল লাগছিলো-এসে হাবুদার দোকানের সামনে সিনেমা হলের শান বাঁধানো আঙিনায় হাতের ভরে বসে পড়লেন। হাতুড়ে বললেন”কিছু খেয়েছেন নাকি…..?”
বিষ্ণুবাবু উত্তর দিলেন “হ্যাঁ আপনি বলার পর থেকেই ছাতু খাচ্ছি-নাহলে..” নাহলে কী হতো সেটা অনুমান করতে কারুর অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। সব চায়ের দোকানও বন্ধ। বিষ্ণুর আত্মসম্মান জ্ঞান টনটনে। ভবিষ্যতে কী কথা হতে পারে সেটা তাঁর সম্যক ধারণা আছে। তাই কেউ কোনও রকম দয়া দাক্ষিণ্য দেখাবার আগেই বাবু তড়বড়িয়ে সাইকেলে উঠে চলে গেলেন। যাবার আগে বলে গেলেন “দাদা আমার আর জ্বর আসেনি, কাশিও নেই”। কোনও ভালো মন্দ হুঁ হাঁ করার আগেই তিনি জনারণ্যে হাওয়া।
হাবুদার সপ্রশ্ন চোখের দিকে তাকিয়ে হাতুড়ে বললেন “টিউশনি করতো….লক ডাউন থেকে বন্ধ”
হাবুদার সাড়ে পাঁচ হাত লম্বা চওড়া শরীরটা হঠাৎ কমজোরী হয়ে গেলো। প্ল্যাস্টিকের চেয়ারে বসে পড়লো। একটু পরে জিজ্ঞেস করলো “ওঁর ফোন নম্বরটা আপনার কাছে আছে?”
হাতুড়ে একটু হাসলেন “নেই। থাকলেও ও আর আসতো না”
তারপর হাবুদার দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বললেন “ব খুদা সপূর্দমৎ”
হে আমার ভারতবাসী, তোমাদের আমি ওপরওয়ালার হাতে সমর্পণ করলাম। ব খুদা সপূর্দমৎ।