সকালে ঘুম ভাঙার পরে খানিকক্ষণ শুয়ে শুয়ে আড়মোড়া ভাঙা রণজিতের অভ্যেস। তখন চিন্তা করেন। আগে ভাবতেন সারা দিনে কী কী করবেন, কোথায় যাবেন, কার সঙ্গে দেখা করবেন; ভাবতেন কাজের কথা, আগের দিনের ভুল শুধরোন, এই সব।
আজকাল ভাবেন কটা বিড়ি খাবেন… ক’ কাপ চা? সকালেই চান করবেন, না কি একটু বেলায়? কাউকে কি ফোন করবেন? কারও সঙ্গে দেখা করা যাবে? শেষ পর্যন্ত কিছুই করেন না। বেশিরভাগ দিন বাড়ি থেকেই বেরোন না। মাসের শুরুতে ভাবেন নিচের তিনজন ভাড়াটের কাছ থেকে আজই ভাড়া চাইতে যাবেন, না কি অপেক্ষা করবেন – যদি কেউ এসে যেচে দিয়ে যায়!
আজ একটা মৃদু উত্তেজনার অনুভূতিতে কেমন ছটফট করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন। সাড়ে ছ’টা। কতদিন এত ভোরে বিছানা ছাড়েননি? একটু হাসলেন। দিন? ক’বছর!
কাজের মেয়েটার আসতে আরও এক ঘণ্টা। চা পাবার উপায় নেই। তৈরি হতে শুরু করলেন। লেকচারের কাগজগুলো রাতে বাইরের ঘরেই পড়ে ছিল। অপাঠ্য হাতের লেখা উদ্ধার করে রহিমা কম্পিউটারে বাংলাতে টাইপ করে এনে দিয়েছিল। এই ছেলেমেয়েগুলোই রণজিতের ব্যর্থ জীবনের একমাত্র আলো। এদের দিকে তাকিয়েই মনে হয়, সবটা হয়ত ফেলা যায়নি।
কাগজগুলো নিয়ে তক্তপোষে বাবু হয়ে বসলেন। লেখাটা পড়তে পড়তে হঠাৎ ভীষণ রাগ হল। নিজেরই জীবনের কাহিনী – তাও বলতে হবে কাগজ দেখে? এতটাই অকর্মণ্য হয়ে গেছেন রণজিৎ মান্না? ধিক্কার।
দরজার কড়া নড়ল। মতি। বললেন, “চা বানা, চানের আগে খাই।”
বালতিতে জল ভরে ইমারশন হীটার ডুবিয়ে গরম করতে দিলেন। আর বেশি সময় নেই। খাটে ছড়ান কাগজগুলো গুছিয়ে ব্যাগে ভরলেন। অনেক বছর পাব্লিক স্পিকিং করেননি। খারাপ লাগলেও, সঙ্গে থাক। ইনভিটেশন লেটারটা নিতে হবে? ট্রেনে বা বাসে গেলে নিতেই হত। এই চেহারা দেখে কেউ বলতই না এই লোকটা গেস্ট লেকচার দিতে এসেছে। নেহাত ওদেরই গাড়িতে যাচ্ছেন, তবু, থাক সঙ্গে…
চিঠিটা আর একবার দেখে নিলেন – ‘অন বিহাফ অফ আওয়ার ইউনিভার্সিটি আই টেক গ্রেট প্লেজার টু কনফার্ম দ্যাট উই উইল বী অনর্ড টু হ্যাভ ইউ অ্যাজ আওয়ার গেস্ট লেকচারার…’
চিঠিটা গত তিন সপ্তাহে অজস্র বার পড়েছেন। কী নিয়ে বলতে হবে লেখা নেই। কাদের লেকচার দেবেন সেটা লেখা নেই। লেখা আছে ডিপার্টমেন্ট অব কন্টিনিউইং এডুকেশন। রুদ্রেন্দু যখন ওর কম্পিউটার থেকে চিঠিটা ছেপে এনে দিয়েছিল, প্রথমে তো কিছু বুঝতেই পারছিলেন না। এ কী চিঠি!
রুদ্রেন্দু আজ লব্ধপ্রতিষ্ঠ অ্যাক্টর-ডিরেক্টর। কাগজে, টিভিতে ওর ছবি, খবর আর ইন্টারভিউয়ের ছড়াছড়ি। আজকাল ওর বক্তব্যের সঙ্গে রণজিতের মতের অমিল থাকলেও ওর সব কাজেই রণজিৎ নিজের ছায়া দেখতে পান। রুদ্রেন্দুও বলে, “আমি আর কী করলাম রণজিৎদা? আপনার কথাগুলোই তো বলে চলেছি। যেগুলো আপনাকে বলতে দেওয়া হয়নি।” রণজিতের কথা? হতেও পারে। কথা তো কম বলেননি জীবনে…
রুদ্রেন্দু বলেছিল, “আমি আপনার হয়ে প্রমিজ করে এসেছি। না বলবেন না।”
জিজ্ঞেস করেছিলেন, “চিঠির তো কিছুই বুঝলাম না, কী নিয়ে লেকচার দিতে হবে?”
রুদ্রেন্দু বলেছিল, “আপনার আবার কী নিয়ে কী? যা খুশী বলবেন। আপনার জীবনের কথা বলবেন।”
আলমারি খুলে জামা বের করতে গিয়ে থমকালেন রণজিৎ। ভেবেছিলেন একটা পাঞ্জাবী পাজামা ইস্তিরি করিয়ে রাখবেন। ভুলে গিয়েছেন। শেষে একটা সবজে পাঞ্জাবী আর সাদা পাজামা বের করে বিছানায় পেতে রাখলেন। ইস্তিরি নেই, কিন্তু ওই পরেই যেতে হবে।
গালে হাত বুলিয়ে দাড়ির দৈর্ঘ বোঝার চেষ্টা করলেন। ভেবেছিলেন, সেলুনে গিয়ে ছেঁটে নেবেন। ভুলে গেছেন। ভালোই হয়েছে। নিজের এই ভাঙা গাল, উন্নত নাকের পাশ থেকে কোটরাগত চোখ চেয়ে আছে দেখতে চান না বলে ঘর থেকে আয়না বিদায় দিয়েছেন। আজকাল চুল আঁচড়ান আন্দাজে। দাড়ি ছেঁটে কী এমন রূপ দেখাতে পারতেন?
কেন এত তাগিদ? কিসের এই উত্তেজনা? কী বলবেন গিয়ে? নিজের জীবনে কী আছে যেটা বলা যেতে পারে? ফেলে আসা এক রাশ ব্যর্থতা, অকৃতকার্যতা আর হতাশার তালিকা?
বড়ো করে শ্বাস টেনে নিজেকে সামলালেন রণজিৎ। দেওয়ালে প্লাস্টিক মোড়া মস্ত ঘড়িটা দেখলেন। সময় হয়ে এসেছে।
নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে গাড়ি এসে পৌঁছল। ততোক্ষণে রণজিতের আরও দু কাপ চা আর দুটো বিড়ি খাওয়া হয়ে গিয়েছে। এক হাতে মোবাইল আর অন্য হাতে স্টিয়ারিং সামলাতে সামলাতে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে গিয়ে ঢোকাল একটা নতুন দেখতে হাউজিং সোসাইটিতে। বলল, “এখানে এক বাবু উঠবেন।”
সে বাবু এলেন মিনিট দশেক পরে। রণজিৎ গাড়িতে একটা বিড়ি শেষ করে, বাইরে পায়চারি করতে করতে আর একটা বিড়ি খাচ্ছিলেন আর ভাবছিলেন রাস্তার ওপারের চায়ের দোকানটায় ঢুকবেন কি না। ফ্যাটফেটে সাদা শার্ট-প্যান্ট, কালো জুতো, কালো বেল্ট। আজকাল আবার কেউ সাদা শার্ট-প্যান্ট পরে নাকি? পুলিশ বোধহয়। আড় চোখে তাকিয়ে নমস্কার করে বললেন, “আমি চিরঞ্জীব করগুপ্ত। আপনি?”
প্রতিনমস্কার করে রণজিৎ নাম বললেন, কিন্তু ভদ্রলোক ততক্ষণে নজর ঘুরিয়েছেন ড্রাইভারের দিকে। “তুমি নতুন? কী নাম?” নাম জেনে তর্জনী তুলে বললেন, “মোবাইলমে বাত করতে করতে ঘুসা কম্পাউন্ডমে। সাফ বোলতা হুঁ, আমি যতক্ষণ তোমার গাড়িতে থাকব, ফোন ধরা বারণ। নইলে কালই নয়া নোক্রি ঢুণ্ডনা পড়েগা। বুঝেছ?”
টুঁ শব্দ না করে ড্রাইভার ঘাড় নেড়ে জানাল, বুঝেছে। ভদ্রলোক রণজিতের দিকে ফিরে বললেন, “আগে গিয়েছেন?”
না, রণজিৎ কোনওদিনই কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে লেকচার দেননি।
“আমাকে প্রায়ই যেতে হয় – নানা কারণে। আর তার মধ্যে বছরে দু’বার যাই এই লেকচারটার জন্য।”
রণজিৎ মাথা নাড়লেন, ও-আচ্ছা গোছের। কথা আর এগোল না। গাড়ি চলতে শুরু করল। করগুপ্ত পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে কথা শুরু করলেন। ভদ্রতার খাতিরে রণজিৎ ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরে তাকালেন। তবে করগুপ্তর গলা উচ্চগ্রামের।
উকিল। যার সঙ্গে কথা হচ্ছে তিনি জুনিয়র। নির্দেশের ভঙ্গী আর ধমকের সুর থেকে স্পষ্ট। কেস-এর ডেট, ফাইলের ব্যবস্থা, এই সবই কথা।
বাইরে বাড়িঘরের সাইজ ছোটো হয়ে বাড়তে থাকল সবুজের ঘোর। আউশ ধান কাটা হয়ে গেছে। শুকনো মাটির ওপর হালকা কুয়াশার দোদুল্যমান ফিতে।
করগুপ্তর ফোন শেষ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন, “আপনার নামটা বললেন। কিন্তু পরিচয়টা?” পিপ্-পরিচয়?
অনেকদিন আগের একটা নাটকের সংলাপের টুকরো মনে পড়ে রণজিতের প্রায় হাসি বেড়িয়ে এসেছিল। দাড়ির ফাঁকে সেটা লুকিয়ে বললেন, “ইয়ে, আমি এককালে নাটক-টাটক করতাম আরকি!”
চোখ কপালে তুলে করগুপ্ত বললেন, “নাটক? মানে আপনি অ্যাক্টর?”
“অ্যাক্টিং, ডিরেক্টিং, নাটক-লেখা… সবই করার সৌভাগ্য হয়েছে এককালে।”
করগুপ্ত বললেন, “কোথায় নাটক করেছেন? মানে কোন গ্রুপ্-টুপ্… আমার অবশ্য নাটকে বিশেষ ইনটারেস্ট নেই। মাঝে মাঝে ফ্যামিলির প্রেশারে দু-একটা সিনেমা-টিনেমা দেখি আরকি… এই সত্যজিৎ রায়-টায়…”
এবার রণজিৎকে হাসি চাপতে সত্যিই বাইরের দিকে তাকাতে হল। বললেন, “আমি ছোটো গ্রুপে নাটক করেছি। জীবনের শুরুতে অবশ্য একটা বিখ্যাত নাটকের গ্রুপে ছিলাম।”
করগুপ্তর ইনটারেস্ট কমে গেল, বাইরে তাকালেন। তার পরে ড্রাইভারকে বললেন, “এক্সপ্রেসওয়ে নিয়েছ, রাস্তায় তো একটা চায়ের দোকানও নেই।”
ড্রাইভার ভাঙা বাংলায় বলল, “নতুন রাস্তা স্যার, এখনও দোকান দেবার লোকই নেই কোথাও… তবে দেখবেন, ছ’মাসের মধ্যে জায়গায় জায়গায় ধাবা খুলে যাবে।”
“হুঃঁ, আর আজ কপালে শুকনো যাত্রা।”
ভদ্রলোকের হাবভাবে রণজিতের বিরক্তি হচ্ছিল। তাই জানার ইচ্ছে না থাকলেও জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়ে, আপনার পরিচয়টা জানা হল না।”
ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, “আমি চিরঞ্জীব করগুপ্ত।”
খুব ধৈর্যের সঙ্গে বাচ্চাকে বোঝাচ্ছেন এমন ভাবে রণজিৎ বললেন, “হ্যাঁ, নামটা শুনেছি। কিন্তু পরিচয়টা…”
তেতো একটা মুখ করে করগুপ্ত বললেন, “আমি ল’ইয়ার।”
দরকার ছিল না, কিন্তু কাজটা করে ভেতরে একটা কেমন জিতে-গেছি অনুভূতি হল। মাথা নেড়ে তথ্যটা অ্যাকনলেজ করে রণজিৎ আবার বাইরে তাকালেন। ছেলেমানুষি।
কয়েক মুহূর্ত পরে বুঝলেন করগুপ্ত আবার ফোন করছেন। এবারে গলা অনেক নরম, প্রায় ফিসফিসে। নিজের নামটা শুনলেন একবার? সন্তর্পণে মাথা না ঘুরিয়ে কান খাড়া করলেন।
দ্রুতগামী গাড়ির দু দিকের খোলা জানলা দিয়ে হু হু করা হাওয়ায় ফিসফিস শোনা কঠিন, কিন্তু তবু… “নাটক… ডিরেকশনও… না, না… মনে হয় না… নাম শুনিসনি? তুই যখন শুনিসনি…”
ফোন শেষ করে, রণজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি কখনও…”
রণজিতের মোবাইল ফোন বেজে উঠল।
কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে হাতড়ে ফোন বের করলেন। রুদ্রেন্দু। “কতদূর পৌঁছলেন?”
“জানি না। দু দিকে ফাঁকা জমি।”
রুদ্রেন্দুর গলার স্বরে চাপা দুষ্টুমি। “আর পাশে?”
“মানে?” জানতে চাইলেন রণজিৎ।
“সঙ্গে চিরঞ্জীব করগুপ্ত যাচ্ছেন না?”
যাচ্ছেন বইকি। বললেন, “কে বল তো?” “সেকি!”
রুদ্রেন্দুর গলায় চোখ কপালে তোলা বিস্ময়। “নামই শোনেননি? আপনাকে নিয়ে কী করি বলুন তো? টিভি দেখবেন না, ট্যাবলয়েড পড়বেন না… বিখ্যাত ল’ইয়ার – যাকে বলে রমরমা! টিভি খুললেই দেখা যায়… কাগজে রোজ মতামত… সব খুন, ডাকাতি, রেপ কেসেই ওনাকে গিয়ে ধরে মিডিয়া। সেলিব্রিটি, এবং সেলিব্রেটেড…”
সেলিব্রিটি… সেলিব্রেটেড… কত দূরের শব্দ, কত দূরের স্বপ্ন…
ফোন বন্ধ করতেই করগুপ্ত বললেন, “আমাদের কলেজে একবার একটা খুব বিখ্যাত নাটক হয়েছিল। নাম শুনেছেন? ‘শের আফগান’।”
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন রণজিৎ। “কে করেছিলেন? বাদল সরকার নিজে?” “বাদল সরকার?”
করগুপ্তের মুখে একটা হালকা দ্বিধা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। “না, সেরকম কেউ না। আমরাই করেছিলাম আর কী, কলেজের স্টুডেন্টরা।”
সম্ভ্রম হল। বললেন, “আপনি কোন রোলে ছিলেন?”
“আমি? আমিও ছিলাম। রোলটা মনে নেই অবশ্য… আপনি কখনও শের আফগান করেছেন?”
মাথা নাড়লেন রণজিৎ। না। সে সৌভাগ্য হয়নি।
“আপনি কী কী বিখ্যাত নাটক করেছেন?”
বিখ্যাত নাটক? এক লহমায় অনেক বছর পিছিয়ে গেলেন রণজিৎ। অশোক স্তম্ভ আঁকা সেই চিঠিটা। রাষ্ট্রপতি পুরষ্কারের জন্য শর্ট-লিস্টেড। তখন রণজিতের তিন-তিনটে নাটকের ডায়ালগ লোকের মুখে মুখে ঘুরত। বাসে ট্রামে শুনেছেন। রাস্তায়, বইমেলায়, অপরিচিত লোক থামিয়ে কথা বলেছে, হ্যান্ডশেক করেছে, অটোগ্রাফ চেয়েছে… তখন বৃহস্পতি তুঙ্গে।
তখনই আবার নতুন নাটক, ‘মন্থরা’। রামায়ণের পার্শ্বচরিত্রকে মধ্যমণি করে পলিটিক্যাল স্যাটায়ার। এক সপ্তাহও কাটল না, চিফ সেক্রেটারি ডেকে বললেন, “রণজিৎবাবু, আপনাকে কী বলব, আপনি তো নিজেই পার্টি মেম্বার। কিন্তু ওই নতুন নাটকটা… ওটা আপনাকে উইথড্র করতে হবে…”
রণজিৎ বেরিয়ে এসেছিলেন। নাটক বন্ধ হয়নি। রাষ্ট্রপতি পুরষ্কারের শর্ট-লিস্ট-এর গল্পও আর এগোয়নি। ক্রমশঃ রণজিতের কাজ বন্ধ হয়েছে। যত লড়াই করার চেষ্টা করেছেন, ততই আরও আটকে গেছেন। ভালো ভালো অ্যাক্টররা ছেড়ে চলে গিয়েছে। বড়ো, নামী হল স্টেজ ভাড়া দিতে চায়নি। নিজের খরচায় আনকোরা স্টুডেন্ট নিয়েও নাটক করেছেন কিছুদিন। তাদেরও ভয় দেখিয়ে ভাগান’ হয়েছে।
করগুপ্ত তাকিয়ে রয়েছেন। জানালা থেকে মুখ ঘুরিয়ে এক লহমা তাকিয়ে নিয়ে বললেন, “বিখ্যাত? নাহ্, তেমন কিছু করিনি।”
করগুপ্ত একটু তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, “পারফর্মিং আর্টিস্ট-দের পক্ষে বিখ্যাত হয়ে ওঠা রিলেটিভ্লি সহজ। অন্য কোনও প্রোফেশনে অত সহজ নয়।”
খানিকটা সময় গাড়ি চলল নিঃশব্দে। কিন্তু সে সুখ বেশিক্ষণ সইল না। করগুপ্ত নানা আলোচনা শুরু করলেন। পার্ফরমিং আর্টিস্ট যদি লিগ্যাসি রেখে যেতে না পারে, তবে তাঁর জীবনের অর্থ নেই, এই হল প্রধান উপপাদ্য বিষয়।
এক দেশবরেণ্য আর্টিস্টের কাউকে আঁকা শেখাতে না চাওয়ার আলোচনার মধ্যে একটা বিকট শব্দ বেরোল গাড়ির ইঞ্জিন থেকে। এবং সেই সঙ্গে একটা কটূ গন্ধযুক্ত ধোঁয়ায় ভেতরটা ভরে গেল। কথার মাঝখানেই বক্তব্যের সুর পালটে করগুপ্ত হেঁকে বললেন, “গাড়ি রোকো, রোকো, আরে বুরবাক, ইঞ্জিন বন্ধ্ কর্ দো!”
গাড়ি থামা মাত্র এমন ত্বড়িতগতিতে ভদ্রলোক বেড়িয়ে গেলেন, যে যন্ত্রে অনভিজ্ঞ রণজিৎ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে নেমে পড়লেন। ড্রাইভার অবশ্য অতটা তড়িঘড়ি করল না, আস্তে আস্তে নেমে বনেট খুলল তার গাড়ি মোছার লাল ন্যাকড়া হাতে জড়িয়ে। ভক্ ভক্ করে কালো ধোঁয়া বেরিয়ে চার দিক ঢেকে দিল।
“আগ লগা হ্যয় ক্যয়া?” জানতে চাইলেন করগুপ্ত। ড্রাইভার মাথা নেড়ে কী বলল, বিন্দুবিসর্গও বুঝলেন না রণজিৎ। করগুপ্ত গাড়ির খোলা বনেটের দিকে এগিয়ে গেলেন, দুজনের কী আলোচনা হল, তার পরে রণজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এ তো বড়ো সমস্যা হল।”
“আর চলবে না?” জানতে চাইলেন রণজিৎ।
“চলবে না তো বটেই, আর এই জনমানবহীন রাস্তায় কী ভাবে আমরা যাব, তাও ভাবতে হবে।” বলতে বলতে ভদ্রলোক পকেট থেকে মোবাইল বের করে নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন।
রণজিৎ ড্রাইভারের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে ভাই?”
ড্রাইভারও তখন তার মোবাইলে কথা বলা শেষ করেছে। একটু উদ্বিগ্নভাবে করগুপ্তর দিকে তাকিয়ে হিন্দী মেশান বাংলায় বলল, শহর থেকে গাড়ি আসতে অন্ততঃ ঘণ্টা তিনেক লাগবে।
করগুপ্ত ফোন করতে করতে একটু দূরে চলে গিয়েছেন। কাউকে বেশ দাবড়াচ্ছেন। একটু বাদে একটা “ধ্যাৎ,” বলে ফোন বন্ধ করে হন্ হন্ করে ফিরে এসে বললেন, “ইউনিভার্সিটি এমন ক্যালাস, বলছে বাস ধরে চলে আসুন! ইয়ার্কি! রদ্দি গাড়ি পাঠাবে, আর আমাকে বাসে করে যেতে হবে! বলে দিয়েছি, গাড়ি পাঠাও, নইলে আজকের প্রোগ্রাম ক্যান্সেল।” বলে ড্রাইভারের দিকে ফিরে তেমনই তেড়িয়া সুরে বললেন, “ক্যয়া হুয়া?”
বেচারা ড্রাইভারের কী হবে না ভেবেই রণজিৎ হেঁটে একটু দূরে গেলেন। রুদ্রেন্দুকে ফোন করতে গিয়ে দেখলেন সিগন্যাল নেই। নিশ্চিন্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে রণজিৎ ব্যাগে ফোন রেখে চারিদিকে চেয়ে দেখলেন।
বিরক্ত করগুপ্তর “তিন ঘণ্টা! ক্যয়া বলতে হো, তিন ঘণ্টা…” চিৎকারটুকু বাদ দিলে জায়গাটা বেশ মনোরম। রাস্তার ধারে ছোটো ছোটো পাতাওয়ালা বেঁটে বেঁটে গাছ – নতুন রাস্তা, গাছগুলো বড়ো হবার সময় পায়নি। সরু সরু ডাল, ছোটো ছোটো সাদা বলের মতো ফুল। উঁকি মেরে দেখলেন রাস্তার পাশে পাশে আর একটা রাস্তা গিয়ে বাঁক খেয়ে একটা গ্রামের মধ্যে ঢুকেছে। রাস্তার ঢাল ধরে চলতে শুরু করলেন গাছের নিচের ঘাসজমি ধরে। একটু দূরে ভাঙাচোরা একটা ঝুপড়ি। বাঁশের কাঠামো থেকে ঝুলছে কয়েকটা ডাব। দোকান। চা পাওয়া যেতে পারে… পা চালালেন রণজিৎ।
পৌঁছন’ হল না। খানিকটা যেতেই দুটো পুকুর, মাঝখান দিয়ে একটা সরু পায়ে চলা পথ। থমকালেন রণজিৎ। জায়গাটা সবুজে ভরা। পুকুরপাড়ে হেলে আছে কয়েকটা বাঁশের ঝাড়। তার মধ্যে তির তির করে উড়ে বেড়াচ্ছে একটা ছোটো সাদা-কালো পাখি। ডাকটা ভারি মিষ্টি। রণজিত থামলেন। হাইওয়ের ওপর দিয়ে সশব্দে ট্রাক গেল একটা। পায়ে চলা পথটা পুকুরটাকে ঘিরে বাঁক নিয়ে কয়েকটা গাছের মধ্যে হারিয়ে গেছে। তাদের মধ্যে একটা চেনেন রণজিৎ। আম। ডালগুলো নিচু হয়ে পুকুরের দূরের পাড় থেকে জলের কাছে ঝুঁকে পড়েছে। সাদা-কালো পাখিটা এখন আমগাছের ডালে।
কী আছে ওই গাছগুলোর আড়ালে? রণজিৎ পায়ে চলা পথে নামলেন। সঙ্গে সঙ্গে একটা আর্ত চিৎকার ভেসে এল পেছন থেকে।
“আরে, আরে, ওকি মশাই, চললেন কোথায়?” করগুপ্তও আসছেন। রণজিৎ বললেন, “ভাবছি গ্রামটা একটু দেখে আসি।”
“আচ্ছা আবদার তো মশাই!” করগুপ্তের গলায় এবার একটু অভিমান মেশান উষ্মা? “রাস্তার মাঝখানে গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে, আপনি চললেন গ্রাম দেখতে!”
নির্লিপ্ত গলায় রণজিৎ বললেন, “গাড়ি তো আসতে অন্ততঃ তিন ঘণ্টা। তাহলে কি বাসে যাবেন?”
অধৈর্য মাথা নেড়ে করগুপ্ত বললেন, “এ রাস্তায় শুধু লং ডিস্ট্যান্স। থামবেই না। বাসের রুট এখান থেকে দূরে। আর এই গ্রাম থেকে কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।”
তবে রণজিতের গ্রাম দর্শনে আপত্তি কিসের?
ভদ্রলোক বলে চললেন, “শহর থেকে আরেকটা গাড়ি এসে পৌঁছতে অন্তত তিন ঘণ্টা, আর আমাদের তার পরে আরও তিন ঘণ্টা যেতে হবে। ঠিক তেমনই, ইউনিভার্সিটি যদি গাড়ি পাঠায়, তাহলে আসতে যেতে তিন তিন – ছ’ঘণ্টা। আমি ভাবছিলাম গাড়ি আসলে, আমরা ফিরে যাই। দুপুরের পর তো গিয়ে লাভ নেই, বরং আর এক দিন যাব?”
ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে রণজিৎ বললেন, “ইউনিভার্সিটিতে জানিয়ে দিন তবে। আপনার সিগন্যাল আছে? আমার নেই।”
করগুপ্ত ফোন বের করে সম্ভবত ইউনিভার্সিটিতেই কথা বলার চেষ্টায় রত হলেন।
হাঁটাপথটা পুকুরপাড় ধরে, আমগাছটা পেরিয়ে একটা পাড়ায় ঢুকেছে। পাড়াটা ছোটো। কয়েকটা মাত্র বাড়ি। আর সেগুলোর মধ্যে প্রথমেই একটা স্কুল।
খোলার চাল দেওয়া একতলা স্কুলবাড়িটার জীর্ণদশা চোখে দেখা যায় না। কিন্তু বাইরে, মাঠে, একজন বয়স্ক টিচারের সামনে জনা বিশেক ছাত্রছাত্রীর উৎসাহ দেখে মনে হয় না তারা স্কুলবাড়ির দশার ধার ধারে। সকলেই চিৎকার করতে করতে মাস্টারমশাইয়ের চারপাশে লাফাচ্ছে, হাবভাবে মনে হচ্ছে তারা কিছু চাইছে।
আর একটু এগিয়ে গেলেন রণজিৎ। হট্টগোলের মধ্যে কিছু কথা শোনা যাচ্ছে এখন। ছেলেমেয়েরা চিৎকার করছে। কেউ বলছে, “আমি সিরাজ, আমি সিরাজ,” কেউ বলছে, “আমি রবার্ট ক্লাইভ,” কেউ বলছে, “ও মিরজাফর, স্যার, ও মিরজাফর…” যাকে বলা হচ্ছে সে ছুটে পালাতে চাইছে, কিন্তু বাকি সকলে তাকে ধরে ফেলেছে…
উৎসুক হয়ে রণজিৎ এগিয়ে গেলেন আরও। ব্যাপারটা কী ঘটছে জানতে হচ্ছে! মাস্টারমশাই হাত তুলে সকলকে থামিয়ে বললেন, “দাঁড়া, দাঁড়া। নিয়ম তো জানিস, আগের বারে যারা সুযোগ পায়নি এবারে তাদের চান্স আগে। ইয়াসিন কোথায়?”
ছাত্ররা অনেকটাই চুপ। পিছন থেকে একটা ছেলে এগিয়ে এল। মাস্টারমশাই বললেন, “তুই এবারে সিরাজ। বুল্টু?” বুল্টু সামনেই দাঁড়িয়ে, লাফিয়ে উঠল। “তুই মিরজাফর, আর সুকুর মিরকাশিম। রহিমা এবারে ক্লাইভ হবে…”
ছেলেমেয়েরা হেসে গড়িয়ে পড়ল – “এ বাবা, এ বাবা, মেয়ে হয়ে সাহেব সাজবে…”
“চুপ, চুপ,” মাস্টারমশাই বললেন, “এর আগে যেন কেউ মেয়ে হয়ে ছেলে, বা ছেলে হয়ে মেয়ে সাজেনি?”
একটা মোটা-সোটা মেয়েকে তিন চার জন ধরে টেনে সামনে এনে বলল, “ওকে মোহনলাল করে দিন, স্যার, বেশ মানাবে।”
স্যার এর উত্তরে কী বলতেন জানা হল না। পিছনে রাস্তার বাঁক থেকে বাজখাঁই গলা ভেসে এল, “এই যে আপনি। বলে দিয়েছি। এখন গাড়ি এলেই ফিরতে পারি…”
ঝুপ করে সামনের সিনে পরিবর্তন ঘটল। সক্কলে থমকে ফিরে তাকাল রাস্তায় দাঁড়ান দুই মূর্তির দিকে। ছাত্র-ছাত্রীরা সকলে যেন রিহার্সাল দেওয়া স্টেজ পারফরমেনসের মতো একযোগে পিছিয়ে মাস্টারমশাইয়ের পিছনে চলে গেল। আর মাস্টারমশাই এগিয়ে এলেন কয়েক পা। কুঞ্চিত ভুরুর নিচে মোটা পাওয়ারের চশমার কাচের পিছনে উজ্জ্বল চোখ নবাগতদের দিকে নিবদ্ধ।
রণজিৎও একটু এগিয়ে দাঁড়ালেন। মাস্টারমশাই লম্বা পায়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে বেড়িয়ে রাস্তায় এসে ওদের দিকে এগোলেন। দূর থেকে যতটা বয়স্ক লাগে ততটা নয়। অপুষ্ট দুর্বল শরীর, পাতলা চুল, কাঁচাপাকা দাড়ি আর চোখে চশমা তাই বয়স বেড়ে গিয়েছে। কাছে আসতে বুঝলেন বছর পঁয়ত্রিশেক। বললেন, “ইয়ে, আমরা, গাড়িটা ওই হাইওয়েতে খারাপ হয়ে গেছে…”
একটা অব্যক্ত চিৎকার করে মাস্টারমশাই ঝাঁপিয়ে রণজিতের দু বাহু ধরে বললেন, “রণজিৎদা!”
পিছনে শব্দ শুনে রণজিৎ বুঝলেন একই সঙ্গে চিরঞ্জীব করগুপ্তও একটা “এই” গোছের হাঁক পেড়ে ছুটে আসতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু ‘-দা’ ডাক শুনে থমকে গিয়েছেন।
কে এই শিক্ষক? রণজিৎকে চেনেন কী করে? আবার দাদা বলছেন?
শিক্ষক বলে চলেছেন, উত্তেজনায় রণজিৎকে অল্প ঝাঁকানি দিচ্ছেন বাহুতে। “আমাকে চিনতে পারলেন না রণজিৎদা? আমি প্রদীপ… প্রদীপ সেনগুপ্ত।”
স্মৃতির অতল পাথারের জগদ্দল ওজন ঠেলে একটা মুখ কি উঁকি দেয়? অত্যুৎসাহী একটা ছেলে, হাত পা নেড়ে পার্ট বলে রণজিৎকে ইম্প্রেস করার ব্যর্থ প্রয়াসের পর ধমক খাচ্ছে…
একগাল হেসে বললেন, “তুই এখানে কী করছিস? স্কুল টিচার? নাটকের ক্লাস?”
প্রদীপও হেসে বলল, “না, রণজিৎদা, ইতিহাস। এটা প্রাইমারী স্কুল – আমি একাই পড়াই…” থেমে জানতে চায়, “আপনারা, এখানে…?” পিছনে চিরঞ্জীব করগুপ্তকে আড়চোখে দেখে নেয়।
রণজিৎ বললেন, “আরে বলিস না, যাচ্ছিলাম হাইওয়ে দিয়ে, গাড়িটা খারাপ হয়ে গেল…”
করগুপ্ত এগিয়ে এসে বললেন, “আপনাদের এখান থেকে কোন বাস টাস চলে না?”
প্রদীপ বলল, “এখন তো পাবেন না, সকালে, দুপুরে আর বিকেলে আসে বাস। সেও বড়ো রুটে নয়, শহর ফিরতে গেলে বাস বদল করতে হবে…”
করগুপ্ত থামিয়ে দিয়ে বললেন, “দুপুরের বাসে লাভ নেই, ততক্ষণে আমাদের গাড়ি এসে যাবে।”
প্রদীপ একটু ব্যস্ত হয়ে বলল, “আপনারা আমার ইশকুলে এসে বসুন না, ইয়ে, আলিম, চট করে তোর বাবাকে খবর দে তো…”
পিছনে ছাত্রদের ভীড় থেকে একটা ছেলে ছুটে বেরিয়ে গেল পিছনের রাস্তা ধরে।
করগুপ্ত আড়চোখে স্কুলবাড়িটা দেখে নিয়ে নাকটা অল্প কুঁচকে বললেন, “নাঃ, থাক, আমরা বরং গাড়িতেই বসি, কী বলেন, মিঃ মান্না?”
খানিকক্ষণ নৈঃশব্দের পরে রণজিতের হঠাৎ খেয়াল হল, কথাটা তাঁকেই বলা হয়েছে। থতমত খেয়ে বললেন, “ইয়ে… আমি ভাবছিলাম, গাড়ি আসতে তো দেরী আছে, আপনি যান, আমি একটু থাকি।”
যাওয়া, থাকা, গাড়ি আসা, ডেকে পাঠান’ ইত্যাদি নিয়ে কিছু আলোচনার পরে করগুপ্ত ফিরলেন। নিশ্চিন্ত হয়ে প্রদীপ বলল, “বাপরে! কে উনি? আপনাকে মিঃ মান্না বললেন, আমি প্রায় ফ্যাক্ করে হেসে দিয়েছি!”
রণজিৎ একাধারে নিশ্চিন্ত ও আনন্দিত স্বরে বললেন, “তার মানে তুইও আমার মতো। টিভি দেখিস না, খবরের কাগজ পড়িস না… উনি নাকি বিখ্যাত উকিল। সারাক্ষণ টিভি নিউজপেপারে ছবি বেরোয়।”
“চলুন, ইশকুলে চলুন,” বলে রণজিতের হাত ধরে পিছন ফিরতে গিয়ে প্রদীপের খেয়াল হল ছাত্রছাত্রীরা ভীড় করে ঘিরে ধরেছে। বলল, “এই, কী দেখছিস? আমার স্যার, জানিস?”
বারো চোদ্দটা উৎসুক মুখ তাকিয়ে আছে। যে মেয়েটাকে ছাত্ররা মোহনলাল করতে চেয়েছিল, সে ঘাড় কাত করে বলল, “বাপরে, তাই এত বুড়ো!”
সক্কলে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। “এই গাধা কোথাকার, এরকম ভাবে বলে?” ইত্যাদি।
তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে সবাইকে থামিয়ে রণজিৎ বললেন, “কিন্তু সত্যি তো বলেছে!”
“বলেছে, কিন্তু সবসময়ে সত্যিটা মুখের ওপর বলতে নেই,” বোদ্ধা মার্কা একটা ছেলে বলল।
সকলে হেসে উঠল, আর তখনই রাস্তার মোড় ঘুরে আলিম এল, সঙ্গে একজন বয়স্ক, দাড়িওলা, গেঞ্জি, লুঙ্গী আর মাথায় ফেজ পরা ব্যক্তি। প্রদীপ এগিয়ে গিয়ে বলল, “মিঞাসাহেব, ইনি রণজিৎদা, আমার মাস্টারমশাই ছিলেন। যাচ্ছিলেন বড়ো রাস্তা দিয়ে, এখানেই গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে…”
মিঞাসাহেব ব্যস্ত হয়ে বললেন, “আরে মাস্টারমশাইয়ের মাস্টার, আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি – আমাদের গাঁয়ের আজ কী সৌভাগ্য, আসেন আসেন, গাঁয়ে আসেন! আমার বাড়ি এই সামনেই…”
আতিশয্যে একটু ভ্যাবাচ্যাকাই খেয়ে গেলেন রণজিৎ। কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না, প্রদীপ বলল, “তার দরকার নেই, উনি ইশকুলেই বসতে পারবেন, আমি ভাবলাম গ্রামের গণ্যমান্যদের মধ্যে আপনার সঙ্গেই আগে পরিচয় করিয়ে দিই।”
একগাল হেসে মিঞাসাহেব বললেন, “তা আমার সৌভাগ্য। তবে কিনা, ইশকুল বাড়িটার তো ভগ্নদশা!”
রণজিৎ বললেন, “তাতে অসুবিধা হবে না। আমি এখানেই ভাল থাকব।” যেটা বললেন না, তা হল প্রদীপ ছাত্রদের নিয়ে একটা নাটক মতো কিছু করছে, সেটা কী তা দেখার লোভ সামলাতে পারছেন না।
শেষে রণজিতের কথা ফেলতে পারলেন না মিঞা, বললেন, “বেশ আপনি এখেনেই বসুন, আমি চা জলখাবার পাঠিয়ে দিই…”
রণজিৎ একবার ভাবলেন, চা হলেই চলবে, কিন্তু তারপর মনে হল, খেয়ে না নিলে কখন আবার পাবেন… দাওয়ায় বসে বললেন, “তুই চালিয়ে যা, আমি এখানেই বসছি।”
প্রদীপ বলল, “দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে। মিড-ডে-মিল এখানে রান্না হয় না, প্রধানের বাড়িতে গিয়ে ছেলে মেয়েরা খেয়ে আসে। এই তোরা এক কাজ কর, কে কী রোল করবে আমরা এখন ঠিক করে নিই, ফিরে এসে ভাল করে শুরু করব।”
ছেলেমেয়েদের দুপুরের খাবারের ছুটি দিয়ে প্রদীপ আর রণজিৎ ইশকুলের দাওয়ায় বসে খানিকক্ষণ আড্ডা দিলেন। রণজিতের জীবনের কথা, প্রদীপের নাটক ছেড়ে শিক্ষকতায় ঢোকা, সবই এল এই গল্পে। তার পরে প্রদীপ বলল, “চলুন, গ্রামটা ঘুরে আসি।” যেতে যেতে রণজিৎ
জিজ্ঞেস করলেন, “তোর বাড়ি কোথায়?”
প্রদীপ বলল, “ওই যে মিঞাসাহেব, উনি হলেন গ্রামের মুরুব্বি। পঞ্চায়েত প্রধান। ওনার বাড়িতেই একটা চালা আছে, আগে ওনার শাশুড়ি থাকতেন, ওখানেই থাকি, ওখানেই খাই – একা মানুষ, চলে যায় আরকি।”
ছোট্ট গ্রাম। একটু ঘুরতেই শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তার মধ্যেই গ্রামবাসীরা সকলে দল বেঁধে দেখতে এল তাদের মাস্টারের মাস্টারকে। সকলেই রণজিৎকে বাড়ি নিয়ে যেতে চায়, সকলেই বলে, “দুটো ভাত খেয়ে যান!”
খাওয়া হল শেষে সেই মিঞা সাহেবের বাড়িতেই, প্রদীপের ছাত্রদেরই সঙ্গে। খাওয়া শেষ হবার আগেই গ্রামশুদ্ধ ছেলে মেয়ে, বাচ্চা বুড়ো রণজিৎকে ‘রণজিৎ-দা’ বলে ডাকতে শুরু করল।
মিড-ডে-মিল শেষ করে সকলে রওয়ানা হলেন স্কুলের দিকে। প্রদীপ বলল, “চলুন সিরাজদৌল্লা অভিনয় দেখবেন। এখন ইতিহাসে পলাশীর যুদ্ধ পড়াচ্ছি।”
রণজিৎ বললেন, “ইতিহাস নাটক করে পড়াস?”
প্রদীপ হেসে বলল, “প্রায় সবকিছুই নাটক করে পড়াই। বাংলা, ইতিহাস, ভূগোল – বিশেষ করে ইংরিজি। নইলে আসবেই না! পালাবে! আর, এ ছাড়া তো আমার জীবনে নাটক নেই, রণজিৎদা, আমি এই করেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখছি…”
বিকেলের দিকে ড্রাইভার যখন ফিরে এসে বলল, “ও দাড়িওয়ালা সাব” বলেছেন উনি ফিরবেন না, তখন করগুপ্ত একটু বিরক্ত হয়েই ডাকতে এলেন। সারা দিনে এক কাপ চা খেয়েছেন, গিয়েছিল প্রধানের বাড়ি থেকে। সঙ্গে অবশ্য মুড়ি-নারকোল ছিল, কিন্তু তাতে পেট ভরেনি। গ্রামে গিয়ে মধ্যাহ্নভোজনের আহ্বানও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
“মশাই যাবেন না? এ কী রকম আশ্চর্য কথা?”
স্কুলের মাঠে তখন মোহনলালরূপী বুলবুল বলছে, “এগোও, এগোও, এখনই ইংরেজ ধ্বংস হবে…”
করগুপ্তর সঙ্গে স্কুলের সামনের রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে গিয়ে রণজিৎ বললেন, “নাঃ, আজ আর ফিরব না। অনেক দিন পরে দেখা হল ছেলেটার সঙ্গে। বলছে… তাই ভাবলাম, কাটিয়ে যাই দুটো দিন। বাচ্চাগুলোও খুব উৎসাহ নিয়ে নাটক করছে…”
করগুপ্তর নাক আবার কুঁচকে গেল। “এই নাটকের জন্য আপনি…”
নমস্কার করে আবার স্কুলের দিকে ফিরলেন রণজিৎ। শব্দে বুঝলেন করগুপ্তও চলে যাচ্ছেন। একটা অস্ফূট, “আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়েছিলাম, যা হোক,” ভেসে এল। পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাবার পর আবার ফিরে তাকালেন। রাস্তাটা খালি। ঝুঁকে পড়া আম গাছটায় সকালের সাদা-কালো পাখিটা আবার নেচে বেড়াচ্ছে।
রণজিৎ বেড়ার ওপর হাত রেখে স্কুলের মাঠের দিকে তাকালেন। সিরাজ লালকুঠি ধূলিসাৎ করার আদেশ দিচ্ছেন। প্রদীপ হাতের মুভমেন্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে। পরীক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে অর্থহীন, কিন্তু কী চমৎকার শিক্ষা! খ্যাতি কোথায় থাকে, আর লিগ্যাসি কী ভাবে তৈরি হয় বললে কি বুঝতেন চিরঞ্জীব করগুপ্ত?
সূর্যের আলোর রং হলুদ হয়ে এসেছে। দূরের ক্ষেতে আবছা কুয়াশার রেশ কি চোখে পড়ে?
স্কুলের মাঠে সিরাজের কথা এখনও শেষ হয়নি।