কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য স্বীকার না করে সংগঠন চালানোর বিপুল অভিজ্ঞতা আছে চিকিৎসকদের। আই এম এ এর পাশাপাশি সার্জন, পেডিয়াট্রিকস, গাইনী এদের আলাদা আলাদা এসোসিয়েশন আছে। এরা হয়তো সে অর্থে আন্দোলন করেন না, কিন্তু বিভিন্ন ফোরামে দাবিদাওয়া পেশ করার অভিজ্ঞতা এদের অনেকেরই আছে।
আশির দশকে অল বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফেডারেশন নামে দলবিহীন সংগঠন তৈরি করে আন্দোলন করার অভিজ্ঞতাও আছে। এর পাশাপাশি মূলত চিকিৎসক নিগ্রহের প্রতিবাদে সরকারি বেসরকারি চিকিৎসকদের নিয়ে গড়ে ওঠে ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম এই দশকেই। তাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও দর্শনের অনুগামী চিকিৎসকদের যৌথ ভাবে কাজ করতে অসুবিধে হয় নি। যে কোন ফোরাম বা ফ্রন্ট বা অন্য যে নামেই এই সংগঠনগুলি পরিচালিত হোক না কেন, এদের দুটি বৈশিষ্ট্য আছে।
এক) এরা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের বা দর্শনের অনুগামী নয়, সংগঠন হিসেবে এদের স্বাধীন সত্তা আছে,
দুই) এরা যেহেতু দাবি আদায়ের জন্য কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হয় সেহেতু এদের কাজকর্ম আন্দোলনের সুচিমুখ ধাবিত হয় সরকার এবং সেই সময়ে সরকারে যারা আছেন সেই রাজনৈতিক দলের প্রতি। যেমন ABJDF এর লক্ষ্যবস্তু ছিল তৎকালীন বাম সরকার তথা সিপিআইএম, যেমন এখন WBDF এর ক্ষেত্রে তৃণমূল সরকার ও দল।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই সংগঠনগুলি সরকারকে নিশানা করে আন্দোলন করলে সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বিরোধী পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলিও তাদের মতো করে এই আন্দোলনে তাদের অবস্থান নেয়। যেমন ABJDF এর সময় কংগ্রেস, নকশাল সহ বিরোধী দলগুলি তাদের মতো করে সরকার অর্থাৎ বামফ্রন্ট ও সিপিআই এম বিরোধী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল, ওই আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল, বলা যায় রাজনৈতিক সুবিধা লাভ করার চেষ্টা করেছিল। আজ স্বাভাবিক ভাবেই জুনিয়র চিকিৎসকদের যৌথ মঞ্চ যে সরকার বিরোধী আন্দোলন করছে তাতে কংগ্রেস, সিপিআই এম, বিজেপি সহ বিরোধী দলগুলি তাদের অবস্থান নেবে এবং রাজনৈতিক লাভের চেষ্টা করবে। এটাই রিয়েলপলিটিক।
সরকারের পক্ষ থেকে, ক্ষমতাসীন দল অর্থাৎ তৃণমূল-এর পক্ষ থেকেও এটাই চেষ্টা থাকবে যে বিরোধীরা যাতে লাভ না করতে পারে। এই চেষ্টার অঙ্গ হিসেবে বিরোধীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার চেষ্টাও থাকবে। তার একটা প্রভাব এই রাজনৈতিক আনুগত্যহীন ব্যানারের তলায় একত্রিত হওয়া চিকিৎসক সংগঠনের ওপরে পড়তে পারে। তারা যৌথ ভাবে আন্দোলন যাতে চালিয়ে যেতে না পারে তার জন্য নানান চেষ্টা চলবে। এতে আমরা কেউই বিস্মিত হবো না।
যেটা বিস্ময়ের সেটা হল এই যে শাসকের পাতা এই ফাঁদে রাজনৈতিক ভাবে বিজ্ঞ প্রাজ্ঞ অভিজ্ঞ অনেক মানুষও পা দিয়ে ফেলছেন। চিকিৎসকদের যৌথ মঞ্চ তাদের মতাদর্শগত বা কৌশলগত দিক থেকে তাদের দলীয় রাজনৈতিক পরিচয় বিহীন পরিচয়কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাদের আন্দোলনকে অরাজনৈতিক তকমা দিতেই পারেন। এতে বিস্মিত, ক্ষুব্ধ বা ক্রুদ্ধ হওয়ার কোনো কারণ নেই কোনো বিরোধী দলের সদস্য সমর্থকদের। যা আমাদের সকলেরই চোখে পড়েছে সেটা হল এই যে জুনিয়র ডাক্তাররা এখনও অবধি কিন্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে তাদের কর্মপদ্ধতি ঠিক করছেন। বিরোধী দলগুলোর সদস্য সর্মথকরা যদি গণতন্ত্র নামক ধারণাটিকে আস্থা রেখে চলতে অভ্যস্ত হন তাহলে তারা জুনিয়র ডাক্তারদের সংগঠন ও তাদের পরিচালিত আন্দোলনের প্রতি আস্থা রাখবেন।
মতের সাথে না মিললেই অন্যকে এর ওর দালাল বলে দাগিয়ে দেয়া আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এর অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাম রাজনৈতিক দলগুলির কর্মীদের একাংশের মধ্যেও এই ঝোঁক আছে। এই ধরনের ঝোঁক আসলে একটি চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনের যুথবদ্ধতার শক্তির ক্ষয় করে, দুর্বল করে। এটা মাথায় রেখেই যে যার মতো করে আন্দোলনে যোগ দেবেন, সেই আন্দোলনের ন্যায্য দাবিদাওয়া পূরণে সচেষ্ট হবেন এটাই কাম্য।
অরাজনৈতিক ব্যানারে গণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কৌশলটা যে দিনের শেষে একটা রাজনৈতিক কৌশল এই বোধটা মাথায় রাখতে হবে। আপনার আমার কথায় কোনো আন্দোলনকারী ওঠ বোস করবে না, তারা আমার আপনার অধস্তন কর্মচারী নন, আজ্ঞাবহ ভৃত্য নন, কোনো রেজিমেন্টেড পার্টির ক্যাডার নন। মতের অমিল থাকবেই, মনের অমিল যেন না হয়। অমিল এর ফায়দা তোলার জন্য ওঁত পেতে শকুনের দল বসে আছে। অন্যের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকারকে বামপন্থীরা চিরকাল চ্যাম্পিয়ন করে এসেছে। আজও সেই ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে। “শত পুষ্প বিকশিত হোক”, মূল লক্ষ্য থেকে আমরা যেন বিচ্যুত না হই, অভয়া কান্ড এর পুনরাবৃত্তি যেন আমাদের বেঁচে থাকতে আর দেখতে না হয়।