১১.১০.২০২৪
শেষ অধ্যায়ে আপনারা দেখেছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা তাদের ন্যায্য দশ দফা দাবি নিয়ে অনশনে বসেছে। এই প্রতিবাদ আজ যদি না হয়, এর প্রতিকার যদি না হয়- আজ থেকে দশ বছর বাদে সরকারি হাসপাতালগুলোকে আপনি কীভাবে দেখবেন, তা বিচার্য… আজকের দিনে সরকারি বিদ্যালয়গুলোর যে কঙ্কালসার দশা, সরকারি হাসপাতালগুলো কি খুব একটা পিছিয়ে আছে!!
১২২. একটা সময় ছিল যখন ডাক্তারি পড়তে ঢুকতে পারাটাও একটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। সরকারি কলেজ ছিল সীমিত। কাঞ্চনমূল্যে সীট কিনে ঢোকার সুযোগ ছিল বটে, তবে খুবই সীমিত সংখ্যক। এখন পাড়ার মোড়ে মোড়ে মেডিক্যাল কলেজ, তাতে একখান কাঠামো দাঁড় করিয়ে দিলেই হলো। পড়াশোনা দূরে থাক, রোগীপরিষেবার বুনিয়াদি পরিকাঠামো সেখানে অমিল। দুই বিচক্ষণ পরিসংখ্যানবিদ মোদীজি ও মমতাদি মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যায় দেশকে বিশ্বের এক নম্বরে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। সেখানে ডাক্তারি শিক্ষার মানটাও বুঝে নিন। এনএমসি ভিসিটের সময় একই শিক্ষককে বিভিন্ন কলেজে কুমিরছানার মতো দেখিয়ে এরা কলেজের মান্যতা নিয়ে নিচ্ছে। এরপরেও যারা ডাক্তারিতে সুযোগ পাবেনা, সেই নেগেটিভ আই কিউ লোকেদের জন্য পরীক্ষায় স্ক্যামের ব্যবস্থাও আছে- এবছর তার নগ্ন রূপ বেরিয়ে এসেছে। সব মিলিয়ে মেডিক্যাল এডুকেশনে কী মেধার লোকজন এখন ঢোকার সুযোগ পাচ্ছে, কারা আপনার চিকিৎসার সুযোগ ভবিষ্যতে পেতে চলেছে, বুঝে নিন।
১২৩. আপনি বলবেন, ঢুকতে সবাই পারে- কিন্তু মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষকেরা এদের হয় শিখিয়ে পড়িয়ে নেবেন- নচেৎ পরীক্ষায় নিশ্চয়ই গোল্লা!! কিন্তু আদতে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো! মেডিক্যাল কলেজগুলোতে পড়াশোনার মান দিনদিন নিম্নমুখী। সামনের সারির ছেলেরা অনলাইন বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে পড়াশোনা করছে, তারাই হয়তো ক্লাসেও মুখ দেখাচ্ছে। আবার এখন সব কলেজে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর ছাত্রসমাজ পুরোপুরিভাবে পার্টির সদস্য হিসেবে কাজ করছে। এরাই ছাত্রপ্রতিনিধি হিসেবে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পাচ্ছে, এরাই ফেস্ট ইত্যাদি বিভিন্ন ছুতোয় টাকাপয়সা তুলছে, এরাই হুমকি সংস্কৃতির ধারক-বাহক হচ্ছে। আবার পরীক্ষার সময় দেখা যাচ্ছে এদের পাশ করানোর জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদন আসছে। আজ একথা সর্বসমক্ষে বেরিয়ে এসেছে কীভাবে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার নম্বর কর্তৃপক্ষ নিজে থেকেই পরিবর্তন করেছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক যোগ্য ছাত্রছাত্রীদেরও কর্তৃপক্ষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য পরীক্ষায় ফেল করানো হচ্ছে। আজ অভয়ার সাথেও এরকম ‘অ্যাকাডেমিক টক্সিসিটি’র খবরও বাইরে আসছে। আমাদের অভিভাবকসম শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিজেদের চাকরি বাঁচাতে কীভাবে মেডিক্যাল শিক্ষার সর্বনাশ করেছেন এবং সমগ্র মানবজাতির স্বাস্থ্যের অধিকারে কোপ হেনেছেন, ভাবলে লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে!!
১২৪. যাহোক এসব চোর-চামার ডাক্তার পাশ করলো, আপনার পাড়ায় বসে আপনার সর্বনাশ করলো- এপর্যন্ত ঠিকই আছে। এখনো আশ্বাসের যে, কিছু ডাক্তার এখনো কিছু শিখে পড়ে বেরোচ্ছে। এরপর কী!! এরপর ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর জন্য কারা থাকছে আর আপনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে এলে আপনার চিকিৎসাতেও কারা থাকছে!!
চিকিৎসকদের সরকারি চাকরি আজ ইতিহাস হতে চলেছে। দুই সরকারই কন্ট্রাকচুয়াল বা বন্ডেড ডাক্তার দিয়ে কাজ চালানোয় বিশ্বাসী, স্বভাবতই যাদের হাসপাতালের সঙ্গে কোনো ‘বন্ড’ গড়ে উঠবে না! চাকরি পাবে, যারা দলদাস হয়ে থাকবে তারাই। প্রসঙ্গত উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, তৃণমূল নেতা সুদীপ্ত রায়, যিনি মেডিক্যাল কাউন্সিলের কর্ণধারও- তার দুই মেয়ে পিজি হাসপাতালের দুই বিভাগের শিক্ষিকা। যদিও তাঁদের একজনের মেডিক্যাল অ্যাডমিশনের কোনো rank লিপিবদ্ধ নেই, কোনো এক কোটায় তাঁর ভর্তি। একইভাবে নির্মল মাজি মহাশয়ের ছেলে, যিনি প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস করেছেন, তাঁকে পিজি হাসপাতালের একটি সুপারস্পেশালিটি বিভাগের আরএমও পদ দেওয়া হয়েছে। যে পদের বাকি সদস্যের সকলেরই ন্যূনতম যোগ্যতা ডিএম/ডিএনবি নিউরোলজি!!
এরকম উদাহরণ দিতে থাকলে শেষ হবেনা। এমন নয় শুধু শাসকদলের, আইনের ফাঁক গলে সব দলের নেতামন্ত্রীর ছেলেপিলেরাই ছলেবলে এই মেডিক্যাল কলেজগুলোতে বসে থ্রেট কালচার চালাবে এবং ছাত্রছাত্রী ও রোগীদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে, এটাই আমাদের ভবিষ্যৎ।
১২৫. এই গেল ডাক্তারির উপাখ্যান। অসুস্থ হলে বেড পাবেন তো? শুধুমাত্র আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বহু হাসপাতালের বেড নেতামন্ত্রীদের অনুমোদনে ভর্তি হয়ে যায়। সন্ধ্যের পর হাসপাতালে বেড পাওয়া এখনই কষ্টকল্পনা। বেড না পেয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ানো রোজকার চিত্র। তারপর প্রাইভেট বা ভিন রাজ্যে ছোটা! অথবা দালাল ধরে বেডের সংস্থান। চটিচাটার দল যখন ছেয়ে যাবে, এই চিত্র আরো কঠিন হতে চলেছে, বলাই বাহুল্য! আজ যখন চিকিৎসকরা অনশন করছে সেন্ট্রাল রেফারাল সিস্টেমের জন্য, বেড ভ্যাকান্সির স্ট্যাটাসের জন্য, তখন মানুষজন প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে সেলফি তুলে বেড়াচ্ছে- এরা জানেনা এরা যখন ব্লাড টেস্ট করাবে, সেই ছুঁচটা পূর্বব্যবহৃত কিনা তার কোনো গ্যারান্টি নেই। তার ক্ষতের ড্রেসিংয়ের গ্লাভসটা সংক্রমিত কিনা কেউ জানে না। এমনকি মরার পর তার শরীরটার উপর যৌন নিগ্রহ হবে কিনা তারও গ্যারান্টি নেই। যে রাজ্যে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী হাঁটুতে ইঞ্জেকশন নিতে গিয়ে সেপটিক আর্থ্রাইটিস নিয়ে বাড়ি যান, সে রাজ্যে সাধারণ মানুষের আর কী-ই বা করার থাকতে পারে!!
১২৬. যদি বা ভর্তি হয়ে গেলেন, ওষুধ কী পাবেন? নিম্নমানের ওষুধের কারচুপি আজ সবার সামনে দিবালোকের মতো পরিষ্কার। কখনো গাইনি বিভাগে একত্রে বহু মায়ের কিডনি বিকল হয়ে যাচ্ছে, কখনো কার্ডিওলজিতে অত্যধিক রক্ত জমাট বাঁধার জন্য রোগী খারাপ হচ্ছে- কিন্তু অক্সিটোসিন বা হেপারিনের মধ্যে গোলমালের কথা কেউ তুলছে না। কারণ এরাজ্যে ডেঙ্গুকে ডেঙ্গু, করোনাকে করোনা বলা যায়না, এসব তো অনেক দূরের কথা। স্যালাইনের বোতলে ছত্রাকের বাসা- এ তো রোজকার চিত্র! বছর দুয়েক আগেও একটা নিম্নমানের দেশীয় পেসমেকার রাজ্যের মানুষদের বসানো হয়েছিল- হঠাৎ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সুনাম ছিল সেই পেসমেকারের। মাঝে রোগিমৃত্যুর কারণে তা ব্ল্যাকলিস্টেডও হয়। কিন্তু আবারো কোনো দৈববলে তারা আবার ফিরে আসে। অবশেষে আবারো পেসমেকার বিকল হওয়ার ঘটনা মিডিয়াতে জানাজানি হওয়ায় অবশেষে সেই কোম্পানিকে বাতিল করা হয়। এভাবেই ফ্রি চিকিৎসার ফাঁকে আপনার প্রাণপাখিটিও কখন আকাশলোকে ফ্রি হয়ে উড়ে যাবে, ধরতেও পারবেন না।
বিনামূল্যে চিকিৎসা ভালো উদ্যোগ, আপনার অধিকারও বটে। কিন্তু তার আড়ালে ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে রোগীদের জীবন নিয়ে যেভাবে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে, এর প্রতিকার আজ না হলে আগামী দিনে সরকারি হাসপাতালগুলো শ্মশানেরই নামান্তর হবে। তখন ঘটিবাটি বেচে সেই প্রাইভেটেই ছুটতে হবে। তাই আজ আওয়াজ তুলুন- আর কারো জন্য নয়, নিজের স্বাস্থ্যের জন্য।