ওপরের হ্যাশট্যাগটা খুব প্রয়োজনীয়। খুন হবার পর থেকে, আমার মেয়েটা আমাকে ছাড়ছেই না। অল্প যাও বা লিখতাম, নতুন কিছুই লিখে উঠতে পারিনি গত আড়াই মাস।
★
এই বারের ঝড়ের পরিপ্রেক্ষিতে “সাইক্লোন ট্যুরিজম” কথাটা খুব শুনতে পাচ্ছি। ঘটনা কিন্তু সত্যি।
আমরা নেহাতই পাতি মধ্যবিত্ত, মানে দারিদ্র-রেখা-প্রায়-ছুঁই-ছুঁই গোছের নই, মাথার ওপরে ছাদ, দুবেলা খাবার ইত্যাদির জোগাড় রয়েছে। আমাদের জীবনে বৈচিত্র্য খুব বেশি না।
সামর্থ্য নেই বলে, আমরা বিপ্লবের জন্মভূমি দেখতে মস্কো যেতে পারি না। সন্তান ইউকে থাকে, সেই অজুহাতে সে দেশে যেতে পারি না। নর্দার্ন লাইটের বিভা সন্তর্পণে ছুঁয়ে দেখি শুধুমাত্র ইউটিউবে।
সেই আমাদের, মধ্য-মধ্যবিত্ত সেই আমাদের কষ্টের পয়সায় পুরী-দীঘা পোঁছোবার পর, কিছুই না দেখে ফিরে আসতে বলার মধ্যে এক ধরণের প্রবল নিষ্ঠুরতার আভাস পাই। মনের ভাবটা যেন… আমি পরাণের সাথে খেলিব আজিকে মরণখেলা টাইপের, যদিও মরতে রাজি নই মোটেই। তাইই ওই “ঝড় দেখতে থেকে যাওয়া”।
এই ব্যাপার কিন্তু আমাদের লেভেলে রয়েছে অনেকদিন ধরেই। ডিজ্যাস্টার ট্যুরিজম। বন্যা, অগ্নিকাণ্ড, ভূমিকম্পের ধ্বংস, মানুষের দুর্গতি, একটু আলগোছে দেখে আসা। কী করা, আমাদের জীবনে তো অন্যতর রোমাঞ্চ নেই!
এরই ছোঁয়া লাগা এক গল্প লিখেছিলাম।
★
দশ ঘণ্টার ম্যাজিক
______________
আমার আগামী দশ ঘণ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে।
অবশ্যি এমনিতেও আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই খুব ক্রিটিক্যাল। যা কাজ করি সেই কাজের জায়গায় তো বটেই। এমনকি বাড়িতেও। এমনই কপাল।
আমি রাজ্যের ত্রাণমন্ত্রীর পিএ। রাজ্য সরকারের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার ক্যাডারে আছি। এমনিতে পাবলিক সার্ভেন্ট। মানে জনগণের চাকর হবার কথা আমার। কিন্তু ব্যাপার তা না। আমি আসলেই এই সেচ ও ত্রাণমন্ত্রীর চাকর। চাকর কথাটা শুনতে খারাপ। তাই পোস্টটাকে বলা হয় পি এস।
তিনি আমার বস। ডাকসাইটে মন্ত্রী শ্রী ভুবনবিজয় রায় হেলাফেলার লোক না। ক্যাবিনেটে তাঁর অফিসিয়াল প্রতাপ সেকেন্ড পজিশনে।
যদিও তিনি মনে করেন, এক নম্বর জায়গাটি তাঁরই পাবার কথা ছিল। মাঝে মধ্যে মুখ ফসকে তাঁর এই গোপন আক্ষেপ আমাকে বলেও ফেলেছেন।
আমার ওপর স্ট্যান্ডিং পরামর্শ রয়েছে এই জাতীয় সব তথ্য এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বার করে দিতে হবে। পরামর্শটা দিয়েছেন পরিতোষ সান্যাল। আমার তিন ব্যাচ সিনিয়র অফিসার। দুর্ভাগ্যপীড়িত। কিছুদিন আগে কম্পালসারি ওয়েটিং সেরে কাজে ফিরেছেন।
সামনের দশ ঘণ্টা কেন এত ইমপরট্যান্ট। এই দশ ঘণ্টার ওপরেই নাকি আমার মন্ত্রী মশাইয়ের আগামী কয়েক বছর নির্ভর করছে। কেন?
সে হিসেব অতি বিচিত্র। সাধারণ মানুষেরা বুঝবেই না। আমি বুঝেছি অতি কষ্টে। এমনিতেই রাজনীতি আর মন্ত্রীত্বটা সাধারণ কাজ নয়। এক ধরণের ব্যবসার মত। এই বাণিজ্যে অন্য সব বাণিজ্যের মতনই ইনভেস্টমেন্ট লাগে, ক্রেতা লাগে, ঠিকঠাক বিক্রিবাটা হলে তবেই লাভের কড়ি ঘরে ওঠে। দেখনদারি আর সেলসম্যানশিপ ঠিক না হলে ব্যবসা মাটি হয়।
আজ স্যার বন্যাত্রাণে বেরোবেন।
স্যারের খুব ইচ্ছে ছিল হেলিকপ্টার। কিন্তু আকাশভ্রমণের ওই যন্ত্রটা চিফই একমাত্র পান। আর তিনি যদি খুব ভালোবাসার কাউকে অনুমতি দেন, সে পায়। আর কেউ পায় না। আমার স্যারের জন্য আজ হেলিকপটার জোগাড় করা যায়নি। স্যারের জন্য চিফের ভালোবাসা কমেছে এটা একটা সম্ভাব্য কারণ। এই কারণ সত্যি হলে ব্যাপার ভয়ানক।
বন্যা দেখতে হলে হেলিকপ্টার সব চেয়ে ভালো। বিজ্ঞাপন হিসেবে ভালো। অনেক লোক ভিড় করে দেখতে আসে। আর দৃশ্য হিসেবে তো অতুলনীয়। সেই কবেই সুনীল গাঙ্গুলি লিখেছিলেন…
“ প্রিয় ইন্দিরা, তুমি বিমানের জনলায় বসে,
গুজরাটের বন্যা দেখতে যেও না
এ বড় ভয়ঙ্কর খেলা
ক্রুদ্ধ জলের প্রবল তোলপাড়ে উপড়ে গেছে রেললাইন
চৌচির হয়েছে ব্রীজ, মৃত পশুর পেটের কাছে ছন্নছাড়া বালক
তরঙ্গে ভেসে যায় বৃদ্ধের চশমা, বৃক্ষের শিখরে মানুষের
আপৎকালীন বন্ধুত্ব”
সত্যিই বন্যা হেলিকপ্টার থেকে দেখতে অতুলনীয়। ওপর থেকে দেখলে ব্যাপ্তি প্রচুর। অবশ্য লঞ্চের থেকে অপার জলরাশির সেই সৌন্দর্যভরা দৃশ্যও আর এক রকমের। এই রকমের ছবি দেখার জন্য প্রকৃত ভ্রমণরসিক হাজার হাজার মাইলও পেরোতে পারে।
শুনেছি কোন কোন দেশে নাকি এই রকমের বন্যাদৃশ্য দেখানোর ব্যাপক ব্যবস্থা রয়েছে। রিলিফের ছদ্মবেশ পরে ছুটে যায় প্রায় অলৌকিক সব জলযান।
ফ্লাড ট্যুরিজম বলে একটা প্রপোজাল নেক্সট ক্যাবিনেট মিটিংএ দিতেও পারেন স্যার!
তিনি আবার পর্যটনেরও চার্জে আছেন কী না!
আজ হেলিকপ্টার পাওয়া গেলে শুধু স্যারের না আমারও উপকার হত। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার একটা ব্যক্তিগত দরকার ছিল। অবশ্য পাব্লিক সার্ভেন্টের নাকি ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে কিছু থাকতে নেই। আমার না, এটা স্যারের বক্তব্য।
কিন্তু আমার আজ সত্যিই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা দরকার। একই দিনে অন্য একটা সেনসিটিভ ব্যাপারের তারিখ পড়ে গেছে।
খুলে বলি। আজ আমার মেয়ে বন্যার জন্মদিন। কাকতালীয় ভাবে তার নামও বন্যা। তার নাম যে বন্যা সেটা কিন্তু এমনিতে না। পেছনে গল্প আছে। রোমাঞ্চকর গল্প।
সে আমার চাকরি জীবনের শুরুর দিকের কথা। আমি অমিত কুমার রায়।
চাকরি পাবার পরপরই আমার বিয়ে হল। কলেজ জীবনের প্রেমিকা লাবণ্য আর আমার বিয়ের তখন বয়স বছর দেড়েক।
নদীয়ায় এক ব্লকের বিডিও আমি।
লাবণ্য প্রেগন্যান্ট হবার পর প্রবল চিন্তিত হয়ে পড়লাম। কোয়ার্টারে থাকি। যেখানে আমার পোস্টিং সেই গ্রামে একটা দশ শয্যার পিএইচসি আছে বটে, কিন্তু তার ভরসায় বউকে রাখতে ভরসা পাচ্ছিলাম না। ভেবেছিলাম শহরে আমার মা বাবার কাছে রেখে আসব। কিন্তু যার জন্য চিন্তা সে অকুতোভয়।
– দ্যাখো অমিত, রবিঠাকুর অবধি পারেননি লাবণ্য অমিতের বিয়ে দিতে। আমরা তো নিজেরা সেটা করে দেখিয়েছি, বলো!
হ্যাঁ তা দেখিয়েছি। কিন্তু বাচ্চা পেটে নিয়ে সেই সাহস কি আদৌ দেখান উচিত?
কোথায় আমি ওকে বোঝাব, উলটে লাবণ্যই কাউন্সেলিং করল আমার।
– তুমি জন্মেছিলে এই রকমেরই এক গ্রামের হাসপাতালে। ঠিক কি না? দরকার হলে আমারও তাই হবে।
অস্বীকার করতে পারলাম না।
বাবা ছিলেন সেই গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার। প্রায় গল্পের মতন। মায়ের মুখে শুনেছি। বাবার স্কুলে সেদিন ইনস্পেক্টর এসেছিলেন। দৌড়োতে দৌড়োতে হাসপাতাল থেকে একজন এসে খবর দিয়েছিল,
—- মাস্টামশা, আপনার খোকা হইয়েছে। খোকা কানতেছে নাকো। ডাক্তারমশা আর ছিস্টার দিদি আপনেরে যাতি বল্লো।
বাবার তাপ উত্তাপ নেই দেখে স্কুল ইন্সপেক্টরই তাড়া দিয়ে বাবাকে তড়িঘড়ি নিজের জিপে তুলে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিলেন। কপাল গুণে পিঠে চাপড়টাপর খেয়ে তার আগেই কেঁদে ফেলেছিলাম নাকি আমি।
সেই যে কাঁদতে সামান্য দেরি হল তার জেরে জীবনের প্রায় পুরোটাই কাঁদতে হল আমায়। চাকরিতে ঢুকেও। অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অফিসার হবার জ্বালায় এখনও কাঁদছি।
আমার জন্মের সময়ে যাই হয়ে থাকুক, লাবন্যর বেলা সেটা হতে দেওয়া যাবে না। কলকাতার গাইনিকোলজিস্ট দেখানো হয়েছে। আজকাল নর্মাল ডেলিভারি হয় না। আমরাও মানসিক ভাবে সিজারের জন্য তৈরি।
ওঁরা বলেন ইডিডি, সেই এক্সপেক্টেড ডেটের থেকে তখন চার সপ্তাহ বাকি। ডাক্তার বলেছেন দিন দশেক আগে গিয়ে ভর্তি হতে হবে।
দুটি জিনিস একসাথে ঘটল। এক নম্বর অঝোর ধারায় বৃষ্টিপাত। একদিন নয়, টানা পাঁচদিন। আকাশের সমস্ত মেঘ যেন জড়ো হয়েছে আকাশে। আর কোনও এক আকাশী জলাধার ফুটো হয়ে সহস্র ধারায় জল পড়ছে আমাদের এই রাজ্যে। রেডিওর খবরে বুঝছি, শুধু এখানেই নয়। সমস্ত দক্ষিণ বাংলা তো বটেই, ঝাড়খণ্ডেও এই কাণ্ড ঘটেছে। প্রথম দুদিন বেশ রোম্যান্টিক কাটল।
এমনই বরষা ছিল সেদিন, নিদ নাহি আঁখিপাতে আর রবিঠাকুরের বরষার গান অবিরাম গুনগুন করে গেল লাবণ্য। বৃষ্টির প্রথম দুদিন কাজের মেয়ে এসেছিল। তার আসা বন্ধ হতে খিচুড়ি আর ওমলেট। হপ্তা খানেকের মাথায় এল সমস্ত ছুটি ক্যানসেল হবার নোটিশ। বিডিও অফিস তো বটেই, থানা আর হাসপাতালের সবার ছুটি বাতিল। জল ছাড়তে শুরু করেছে ড্যামগুলো। সমস্ত নদীতে জল বইছে বিপদসীমার ওপর দিয়ে। বন্যা হবেই।
থানায় রেডিওগ্রাম এসেছে ডিএম অফিস থেকে। বিডিওর কাছে কপি পাঠিয়েছে ওরা। আমি যেন সৈন্য সামন্ত নিয়ে তৈরি থাকি।
পরদিন সকালে ক্যাশিয়ার বাবু কোয়ার্টারে এসে খবর দিয়ে গেলেন। ওঁর বাবা দেখে এসেছেন। জল ঢুকেছে হাটখোলায়।
সবার মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। আমাদেরও কোয়ার্টার ছেড়ে উঁচু জায়গার নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হবে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে।
লাবণ্যকে রেখে এলাম সেই উঁচু নিরাপদ আশ্রয়ে। বেচারার খুবই কষ্ট হল। অ্যাডভান্সড প্রেগন্যান্সি তার সঙ্গে বৃষ্টি।
কোয়ার্টার তো বটেই, অফিসও ডুবে গেল। পুরো প্রশাসন উঠে এসেছে বাস রাস্তার একপাশে তাঁবুর নীচে।
এমন সময় দ্বিতীয় ঘটনা। অফিসে খবর এল লাবন্যর ব্যথা উঠেছে। অভিজ্ঞরা বলল, আনকমন কিন্তু অতিরিক্ত স্ট্রেনে এমনটা হতেও পারে।
হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর সঙ্গে একরকমের বন্ধুত্বই ছিল। হলে কী হয়, সেই হাসপাতালও তো জলের তলায়। ওরা কোনও রকমে একটা উঁচু জমিতে ওই আমাদেরই মত তাঁবু খাটিয়ে আউটডোর গোছের করছে। প্ল্যান করে রাখা সিজারিয়ানের প্রশ্নই ওঠে না। এমনিতেই এখানে সে সবের ব্যবস্থা নেই। এখন হাসপাতাল ডুবে গেছে। কাজেই এমনকি ইনডোরে ভর্তি রেখে ডেলিভারিরও প্রশ্ন ওঠে না।
আর একটা রহস্য জানলাম, আগে জানতাম না। সব ডাক্তারই এমবিবিএস পাশ বটে, কিন্তু সব কাজে সবাই পটু নন। আমার এই ডাক্তার বাবুটি যেমন। স্কিনে হাউসস্টাফশিপ করে চাকরি পেয়েছেন, গাইনি অবস্টেট্রিকসএ দক্ষ নন।
– তবে যে শুনি হাসপাতালে ডেলিভারি হয়?
আমার হতবাক জিজ্ঞাসার উত্তরে জানলাম, সেটা নাকি করান সিস্টার আর দাইয়েরা। তাঁদের মধ্যে এই হাসপাতালের সবচেয়ে দক্ষ সিস্টার যিনি তিনি সুধাদি। তিন সপ্তাহের আর্ন লিভ নিয়ে কলকাতা গেছেন। বন্যা শুরুর অনেক আগেই।
এই সব জ্ঞান লাভে সমস্যার কোনও সুরাহা হবে না। এদিকে অফিসের কাজের মাথা খারাপ করা ব্যস্ততা। আর ওদিকে লেবারপেন। সেই টালমাটাল সময়ে বুঝেছিলাম, মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়ায়।
আমার অফিসের হেডক্লার্ক অসীমবাবু অফিসের সবার গার্জিয়ান মতন। এমনকি আমারও। তাঁর স্ত্রী, খবর পেয়ে নিজেই এগিয়ে এলেন অগ্রণী হয়ে।
ডাক্তারবাবু একজন সিস্টার আর দাইমাসিকে পাঠালেন। সেই আপৎকালীন আবাসে শাড়ি টাঙিয়ে বানানো হল লেবার রুম। আর জন্মের নির্ধারিত সময়ের একমাস আগেই গগন ফাটানো চিৎকার করে আবির্ভূত হলেন আমার রাজকন্যা।
সেদিন আবার তদারকিতে এসেছেন সদরের এসডিও মাজাহার আলম। তাঁকে ফেলে বউএর আর সদ্যোজাত কন্যার কাছে ঘুর ঘুর করার কোনও উপায়ই নেই। বাইরে যখন বন্যা!
এসডিও সাহেব এই খবর শুনে চমৎকৃত হলেন শুধু তাই নয়, সেই সাময়িক আবাসে হাজিরও হয়ে গেলেন।
মাজাহার আলম সাহেব আমাদের জুনিয়র অফিসারদের পুরো ফাদার ফিগার। ছোটোদের সঙ্গে মেলামেশা করেন বলে অফিসার মহলে তাঁর সমবয়সীদের মধ্যে একটু দুর্নামও আছে । ভারি হাসিখুশি মানুষ। গতবছর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারদের পিকনিকে তিনি নাকি ম্যাজিক দেখিয়ে ছিলেন। সেই থেকে মাজাহার নাম পালটে সবাই তাঁকে ডাকে ম্যাজিশিয়ান আলম।
তিনি নিজেই হা হা করে হেসে বললেন লাবণ্যকে, – তুমি তো দেখি আমার চাইতেও বড় ম্যাজিশিয়ান। এই বন্যার মধ্যে প্রায় শূন্য থেকে হাজির করলে জ্যান্ত একটা পুতুল। তোমার মেয়ের নাম রাখলাম বন্যা।
কাজেই, এই যার ইতিহাস, সেই মেয়ের নাম অবধারিত ভাবেই রাখা হল বন্যা। ওর মা লাবন্যর সঙ্গে হাল্কা করে একটা মিলও রইল।
তারপর চাকরির নানান ঘাটে জল খেতে খেতে এখন আমি রাজ্যের মন্ত্রীর সেক্রেটারি। দেহের ওজন বেড়েছে। নিশ্চিতই বেড়েছে।
কিন্তু ক্ষমতা? বিডিও থাকাকালীন কিম্বা এসডিও বা কালেক্টর থাকার সময়েও যা ক্ষমতা ছিল এই মন্ত্রীটির লেজুড় হবার পর সেই প্রতাপের কিছুই অবশিষ্ট নেই।
পরিতোষদা’র মতে ক্ষমতা আসলে কমেছে। অ্যডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে অনেক বছর কাটালে সবাই ভাবে ক্ষমতা বাড়ে। ব্যাপার তা না। আসলে ক্ষমতা কমে।
পরিতোষদা’র কথাবার্তা অমনই। রামকৃষ্ণভক্ত। রামকৃষ্ণকথামৃত মুখস্ত। রামকৃষ্ণের কথায়, না কামড়ালেও ফোঁস করতে হয়। তো সেই ফোঁস করতে গিয়েই বেচারাকে আচমকা কমপালসারি ওয়েটিংএ যেতে হয়েছিল।
যা বলছিলাম।
আমার একমাত্র মেয়ে বন্যার এই বছরে আঠারো বছর পূর্ণ হচ্ছে। সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়ে। এ তো গেল আমার কন্যার কথা।
এইবারে এই বছরে আসল যে প্রাকৃতিক বন্যা তার কথা বলি। এ দেশে প্রায় প্রতি বছরেই বন্যা হয়। যে বছর সত্যিকারের অতিবৃষ্টি হয় সামাল সামাল রব ওঠে ত্রাণ দফতরের। অতিবৃষ্টিতে কারও কোনও হাত থাকে না। তবু কেন জানি না মন্ত্রীরা সমস্বরে বলে ওঠেন ম্যান মেড বন্যা। মানুষজন অসহনীয় দুর্দশায় দিন কাটায় আর আমাদের মানে সরকারি অফিসের লোকেদের দিন কাটে নিরুপায় ছুটোছুটির মধ্যে।
কিন্তু বন্যাটা বোধ হয় দরকারিও । মানে মন্ত্রীদের ভাবসাব দেখে তাইই মনে হয়। পরিতোষদা’ বলে ও নাকি কোন মন্ত্রীকে ডিভিসি আর নানান জায়গায় ফোন করে তাড়া দিতে শুনেছে,– কী মশাই এ বছর আপনারা জল ছাড়ছেন না কেন? ভাদ্র মাস পেরোতে চলল। এত দেরি করে ফ্লাড হলে হবে?
প্রথমে শুনে বিশ্বাস করিনি। পরে মনে হয়েছে বন্যার ব্যাপারে এই তাড়ার ব্যাপার সত্যি হলেও হতে পারে।
আমরা ত্রাণ দফতর তো বটেই আর অন্য সব দফতরের সরকারি লোকেরাও আগের থেকে তৈরি থাকি। সে তৈরি আমাদের বহু ব্যাপারেই থাকতে হয়। নইলে ম্যানেজ করা যায় না।
প্রবল শীতকালে গ্রীষ্মের দাবদাহ নিয়ে মিটিং করি। প্রচণ্ড খরার সময়ে বন্যাত্রাণের মিটিং করি, প্রস্তুতি নিই।
সত্যিকারের বন্যা না হলে পুরো প্রস্তুতিই মার যাবে তো। তাই বন্যার ব্যাপারে খাটুনির কথা ভেবে আমাদের যা অনীহা, মন্ত্রী আর চেলাচামুণ্ডাদের আগ্রহ তার শতগুণ বেশি।
আমার মেয়েটার জন্মদিনটা ইতিহাস শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এই বন্যার মরশুমেই পড়ে প্রতিবছর। তার জন্মদিনে প্রতিবছরই ঘটাপটা করা হয় তা না। এই বছরটা স্পেশাল। আঠারো বছর পেরোবে সে। এই আঠারো বছরটা নিয়ে তার চাইতে তার মায়ের আগ্রহ বেশি।
মা মেয়ে যেন নয় তারা। যেন দুই সখী। কুটুর কুটুর করে নানান গল্প করে। সেই সব গল্পে আমার প্রবেশাধিকার নেই। সত্যি কথা বলতে কী সরকারি কাজের ধকল সামলে সেই সব ব্যাপারে অংশগ্রহণ করার সময়ও নেই আমার। এই ব্যাপারে লাবন্য একটা নকল অনুযোগ গোছের কিছু বন্যার ছোটোবেলা থেকেই করে। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে হয় এই ব্যাপারে সে যথেষ্টই খুশি এবং সুখী। এই যে বন্যার ছোটোবেলা থেকেই তার স্কুল কোচিং গানের ক্লাস, আঁকার ক্লাস, আরও কতকিছু দশভূজার মত তাকে একলাই সামলাতে হয়েছে তাতে সে আদৌ বিব্রত হয়নি কোনওদিনই। শুধু পেরেন্ট টিচার মিটিংএর দিন আমার যাবার দাবী করত মেয়ে, অন্য মেয়েদের বাবারা যায় বলে। সেও আমার এক নিয়ম রক্ষার যাওয়া শুধুই। তার বেশি কিছু না।
এই বারের এই জন্মদিনের জন্য তাদের প্ল্যানও তারা আমাকে বলেনি।
আঠারো বছরের এই সাবালকত্ব অর্জন নিয়ে কন্যা মোটেই উত্তেজিত না। আসলেই সাবালকত্ব ব্যাপারটা এমন কিছু না যে আগের দিন অবধি নাবালক আর সেই দিন ঘড়ির কাঁটা পেরোলেই সে সাবালক হয়ে যাবে। এটা একটা প্রসেস। ভেতরে ভেতরে ধীরে ধীরে ঘটে চলে। আর মেয়েদের ভেতরে যে সেই ব্যাপারটা একটু আগেই ঘটে প্রাকৃতিক নির্দেশে, সেই তথ্য সবাই জানে। বন্যাও আমার ধারণা সাবালক হয়ে গেছে ভেতরে ভেতরে বহু আগেই।
তা সত্ত্বেও তার এই সাবালকত্ব প্রাপ্তিকে আমরা বিশেষ করে তার মা যে একটা উৎসবের চেহারা দিতে চাইছি তার কারণ দুটি।
প্রথম কারণ রাষ্ট্রীয়। রাষ্ট্র বলেছে এই দিন থেকে ভোটাধিকার আর অন্য নানা আইনি বিষয় মিলিয়ে সে পূর্ণ নাগরিক হল।
দ্বিতীয় কারণ, এমনকি কবিও বলে গেছেন, আঠারো বয়স বছর কী দুঃসহ।
মেয়ের উত্তেজনাহীনতা তার মাকে স্পর্শ করেনি।
মা লাবণ্য খুবই উত্তেজিত। এই ব্যাপারে সে যা ব্যবস্থা করেছে তা এককথায় অসাধারণ। কী কৌশলে জানা নেই সে যোগাযোগ করেছে এমন কী বন্যার নামকরণ যিনি করেছিলেন সেই মাজাহার সাহেবের সঙ্গেও।
যোগাযোগ করা বলা বাহুল্য সহজ ছিল না। আরও অনেক উচ্চপদে পৌঁছে, তিনি ইতিমধ্যেই তাঁর চাকরি জীবন সমাপ্ত করেছেন । তারপরে তিনি শহর ছেড়ে তাঁর গ্রামের বাসায় চলে গেছেন। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। কিন্তু মানুষটিও অন্যরকম ছিলেন, আগেই বলেছি।
সেই মানুষের খোঁজ পেয়ে তাঁর গ্রামে গিয়ে আমরা দুজন তাঁকে নিমন্ত্রণ করে এসেছি। স্যার, বেশ বয়স হয়ে গেছে যদিও, আসতে রাজি হয়েছেন।
রাজি হয়েছেন শুধু না, বিকেলের পার্টিতে তিনি পারফর্মও করবেন। ম্যাজিক দেখাবেন।
সরঞ্জাম তিনিই আনবেন। তার মধ্যে একটা ম্যাজিক হচ্ছে কেক কাটার ম্যাজিক। অতি সুদৃশ্য একটা বিশাল কেক কাটা হবে। সেই কেক কাটা মাত্রই তার ভেতর থেকে একটা সাদা পায়রা বেরোবে। সেই পায়রা হলঘরের মধ্যে উড়তে থাকবে। অত্যন্ত আনন্দঘন উত্তেজনাময় দৃশ্য তৈরি হবে, বলাই বাহুল্য।
স্যার এই স্পেশাল কেক বানাতে দিয়েছেন তাঁর পরিচিত এক নিজস্ব কারিগরকে। গোপন আর জটিল রহস্যময় এই কেক বানাতে খরচ পড়বে বিশ হাজার টাকা। মাজাহার স্যার কিছুতেই টাকাটা আমাকে দিতে দিলেন না। যে ম্যাজিক শিশুর নামকরণ তিনি করেছিলেন, তার জন্য এইটিই নাকি তাঁর প্রীতি উপহার।
আমার ওপর নির্দেশ আছে তৈরির পর এই বস্তুটা রিসিভ করতে হবে আমাকে। কঠিন ভাবে বলে দেওয়া আছে কারিগরটিকে। বাড়ির অন্য কারওর হাতে দিলে রহস্য ফাঁস হয়ে যেতে পারে। স্যার ফোনে আমাকে বলেছেন কেকটা খুব যত্ন করে রাখতে। সাদা পায়রা তাঁর সঙ্গেই আসবে। পায়রা জীবিত প্রাণী। তাকে বেশিক্ষণ আবদ্ধ রাখা যাবে না।
আমার বাড়িতে ম্যাজিকের প্রস্তুতিতে তাঁকে একটা ঘর ছেড়ে দিতে হবে। তখন তিনি কী সব গোপন কায়দা করবেন।
মাজাহার সাহেব তো আসবেনই। এছাড়া আসবে মেয়ের হাতে গোণা কিছু বন্ধু, কয়েকজন আত্মীয় আর আমার কয়েকজন বন্ধু আর সহকর্মী। সবে মিলে লোকজন কম হবে না। কাজেই আমাকে ছুটি নিতে হয়েছিল অফিস থেকে।
ছুটি নিতে হয়েছিল বলছি এই জন্য যে সেই ছুটি আমার নেওয়া হয়নি। শেষ অবধি ক্যানসেল করতে হয়েছে। আমি যার সেক্রেটারি সেই মন্ত্রীমশাইয়ের নির্দেশ।
এতদিনে তাঁর সেই অনেক কামনার ধন সেই ভাসাভাসি বন্যাটি হয়েছে। তিনি আজকেই বন্যা দেখতে যাবেন। হেলিকপ্টার পাওয়া যায়নি তাই সরকারি লঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সঙ্গে যাবে কিছু সাংবাদিক, পাইক পেয়াদা সিকিউরিটি আর বলাবাহুল্য আমি।
তড়িঘড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে অফিসে এসেছি। এখান থেকে গাড়ি করে রাণাঘাট অবধি গিয়ে লঞ্চে উঠব সবাই। ধকল কম নয়।
সকাল আটটায় কলকাতা থেকে বেরিয়ে আজ বন্যাত্রাণ হবে। মানে মন্ত্রীমশাই নিজের হাতে ত্রাণটান দিচ্ছেন এমন ভিডিও আর স্টিল ছবি তোলা হবে। ওই লঞ্চে বসেই তাঁর সাক্ষাৎকার রেকর্ডিং করাবেন তিনি। কলকাতায় সন্ধ্যে আটটার স্লটে সেই খবর দেখানো হবে এইটিই প্ল্যান তাঁর। ঠিকঠাক প্রচারটি পেলে সামনের মরশুমে হয় তো হেলিকপ্টার পাবার যোগ্যতা অর্জন করবেন।
রাণাঘাটে লঞ্চে ওঠার ঠিক মুখে বাধা পড়ল। এক বিশাল কার্ডবোর্ডের বাক্স নিয়ে একজন হাজির। সে কলকাতা থেকে আমরা রওনা হবার ঠিক পরে অফিসে পৌঁছেছিল। তারপর আমাদের টানা অনুসরণ করে এসেছে তার কোম্পানির গাড়িতে। তার কাছে রয়েছে মাজাহার সাহেবের অর্ডার দেওয়া সেই কেক। যে কেক কেটে ম্যাজিকের শুরু হবে।
এই দেশের লোকের সাধারণ বুদ্ধি যে কবে হবে! এমনিতেই মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল অবস্থা। তার মধ্যে সেই লোক দাঁত বার করে জানাচ্ছে,—- কেক আপনার হাতেই দিতে হবে। সেই রকমই ডিরেকশন আমার ওপর। আপনাকে দিয়ে মাজাহার স্যারকে ফোন করতে হবে, ডেলিভারি দিয়েছি। তবে আমার ছুটি।
একবার ভাবলাম যা হয় হোক, কেকসমেত পত্রপাঠ বিদায় করি লোকটাকে।
কিন্তু মাজাহার স্যারের কথা ভেবে ওই রূঢ়তাটা করতে ইচ্ছে করল না। ভাবলাম যা শিডিউল, ঘণ্টা দশেকের মধ্যে ফিরে আসা নিশ্চিত। সাবধানে বাক্সটাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে, এই যা।
কেক কাটা ব্যাপারটা একটু দেরিতে হবে। তা হোক। সারেঙকে বললাম বিশাল বাক্সটা তার কেবিনে রাখতে।– দেখো ভাই, খুব সাবধান! ঝাঁকুনি না লাগে।
আমাদের এই লঞ্চ নিয়ে অগভীর জলে যাওয়া যায় না। অথচ বন্যার তাড়নায় মানুষেরা উঁচু জায়গায় সরে গেছে। সেখানে যেতে হলে লঞ্চের থেকে নেমে ছোটো নৌকায় কিছুদূর গিয়ে তারপর কাদার ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে।
মন্ত্রী নিজে চাইছেন না। সিকিউরিটির লোকেরাও সেটা চাইছে না। অন্যান্য রিলিফ টিমের দু একটা ভুটভুটি নৌকো দেখা যাচ্ছে। তারা দূরে সেই সব অগম্য জায়গার দিকে যাচ্ছে।
কাজ ফেলে রাখা যাবে না।
ইতিমধ্যে মন্ত্রীর বন্যাত্রাণের অভিজ্ঞতা নিয়ে সাক্ষাৎকার দেওয়া হয়ে গেছে। এইবারে ত্রাণসামগ্রী বণ্টনের ভিডিও তোলা হলেই আজকের মত কাজ শেষ।
আমাদের দুপুরের খাবার সার্ভ করে দেওয়া হল। বাসমতী চালের ভাত, অন্যান্য তরকারি আর ইলিশ মাছ।
হেড কুক আরও কিছু প্রোটিন আইটেম যোগ করতে চেয়েছিল। কিন্তু মিনিস্টার বারণ করেছেন তাকে। রিলিফে বেরিয়ে এত খাওয়া দাওয়া ভালো না। সাংবাদিকদের এই মেনুর ছবিও তুলতে বারণ করা হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে রিলিফে যা যা জিনিস আনা হয়েছে একমাত্র সেইসবেরই ছবি তুলতে। আমরা কিছু রান্না করা খাবারও এনেছি বন্যার্তদের জন্য। সারি সারি গোটা কুড়ি বিশাল অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে সেই খিচুড়ি রাখা আছে। তার ছবিও তোলা হয়েছে।
সমস্যা হল লঞ্চ নিয়ে কাছাকাছি যাওয়া যাচ্ছে না বলে সত্যিকারের বানভাসি কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না কিছুতেই, যাদের হাতে ত্রাণের জিনিস আর খাবার তুলে দেওয়া যায়। ঘোরাঘুরিই সার। বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যে। মন্ত্রীমশাইয়ের আজকের অভিযান ব্যর্থ হয় হয় এমন সময় সেই তাদের দেখা পাওয়া গেল।
থই থই জলের মধ্যে একটা দ্বীপ মতন। সেইখানে একটা পরিবার আটকে পড়েছে। নারীপুরুষ মিলিয়ে গোটা দশেক মানুষ। বোঝাই যাচ্ছে সময় মত পালাতে পারেনি।
ভিডিও তোলার লোকজনেরা তৈরি হয়ে নিয়েছে। এইবার ত্রাণ বিতরণের ভিডিও তোলা হবে। মন্ত্রী সাংবাদিকদের সঙ্গে নীচু গলায় কথা সেরে নিয়েছেন। এই টাটকা ছবির সঙ্গে পুরোনো ফাইল ছবি পাঞ্চ করে খবরে দেখানো হবে।
ওদের উদ্ধার করে আমাদের লঞ্চে তোলা যেতেই পারত। কিন্তু সেটা উচিত হবে না। ফেরার পথে অন্য রিলিফ টিমের কোনও নৌকোকে ওদের হদিশ দিয়ে তুলতে বলা হবে, এইরকমই ঠিক হল।
ছবি উঠছে। মন্ত্রী ওদের ত্রিপল দিলেন। আরও নানা কিছু সামগ্রী দিলেন। পরিবারের কর্তাটি এমন সময় বলল,– ছার! আমরা তিনদিন কিচু খাইনিকো। জলও নেই আজ্ঞে। যদি কিছু খাবার…
– হ্যাঁ হ্যাঁ খাবারও দেব তো!
স্যার হাঁক পাড়লেন।– অ্যাই, ওদেরকে খিচুড়ি দাও শিগগিরি।
মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল খাবারের চার্জে থাকা লোকটা,– কী বলব স্যার, সেই গতকাল রাতের রান্না আর গরমটাও পড়েছে ভ্যাপসা। পুরো খিচুড়িই টক হয়ে গেছে স্যার। সবটাই ফেলে দিতে হবে।
কিন্তু এই লোকগুলোকে খিদের মুখে এইরকম ছেড়ে যাওয়া কি ঠিক?
আমাকে এবারে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হল।
ওই বিশাল বিশহাজার টাকা দামের কেকের বাক্স সারেঙের কেবিন থেকে বার করালাম। মন্ত্রীমশাই আর সাংবাদিকদের অবাক চোখের সামনে সেই রহস্যময় কেক কেটে ওই দশজন ক্ষুধার্তকে ভাগ করে দেওয়া হল।
এবার ফেরা। সময় নষ্ট করা যাবে না। কোনও একটা রিলিফ নৌকোকে বলতে হবে এদের তুলে নেবার জন্য।
বাড়ি ফিরেছি। দশ ঘণ্টা বাদে। ফিরতে দেরি দেখে বাড়িতে জন্মদিনের অনুষ্ঠান শুরু করে দেওয়া হয়েছে।
মাজাহার সাহেবকে কেন কেক নেই, বাধ্য হয়েই আমাকে কী করতে হয়েছে চুপিচুপি বুঝিয়ে বলেছি। কেক কাটার ম্যাজিক-আইটেমটা বাদ গেল বাধ্য হয়েই।
ম্যাজিকের একটা আইটেম বাদ গেল। তাতে কী? মাজাহার স্যার অপ্রতিরোধ্য।
পূর্ণিমা রাত আস্তে আস্তে ঘন হচ্ছে। এখন আকাশে মেঘ নেই একটুও। মাজাহার স্যার আমার মেয়ে আর অন্য সব অতিথিদের নিয়ে ছাদে গেছেন। সেখানে তিনি সবাইকে নতুন একটা অন্য ম্যাজিক দেখাবেন।
পূর্ণ চাঁদের কলসি থেকে আকাশের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঘন ক্ষীরের মত জ্যোৎস্নার বন্যা।
বন্যার জন্মদিনে জ্যোৎস্নার বন্যা… এ ও কি কম ম্যাজিক!
★