১৩ অক্টোবর, ২০২৪
কংসাবতী নদীর দিকে অবাক ভাবে তাকিয়ে ছিলাম। একটু আগেই বাঁধের ভাঙা অংশটা দেখেছি। একটা দৈত্য যেন তাণ্ডব চালিয়েছে। এই শান্তশিষ্ট কংসাবতী এতো ক্ষেপে গিয়েছিলো?
একজন মাছ ধরছিলেন একটা পাথরের উপর বসে। তিনি বললেন, কর্তা, দুপদাপ করে হেঁটেন না। পা টিইপা টিইপা হাঁইটেন। এমনিতেই মাছ টাছ নাই। সব বানের জলে ভাইস্যা গেছে গিয়া।
ঘর দোর ভেসে যায়। গরু ছাগল ভেসে যায়। মানুষও ভেসে যায়। তবে বন্যাতে যে মাছ ভেসে যায় জানতাম না।
রূপালী ডাক দিচ্ছে পিছন থেকে, চলে এসো। খেতে ডাকছে।
তোমরা খেয়ে আসো। আমার তো আজ প্রতীকী অনশন। রাত আটটার পর খাব। আমি এই চাচার মাছ ধরা দেখি।
মাছ ধরছিলেন যে ভদ্রলোক অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ভঙ্গিতে বললেন, মা জননী যখন এত করে ডাইকছেন, যান না কেনে। খাইয়া লন। বেলা অনেক হইছে।
বুঝলাম, তিনি উড়ে এসে জুড়ে বসা এই শহুরে লোকটাকে আপদ বলেই মনে করছেন। বললাম, আপনি মাছ ধরেন। আমি কোনো শব্দ করব না। চুপচাপ বসে থাকব।
উনি বললেন, কথাও কইবেন না। লড়াচড়াও করবেন না। জলে মানুষের ছায়া কাঁপলে মাছে চার খায় না।
উনি আবার তপস্যায় রত হলেন। ওনার চোখ দুটোও বুজে আসছে। নিশ্বাসও দীর্ঘতর হচ্ছে। কী জানি ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি? ঘুমলে ভালই করবেন। কংসাবতীর জল স্ফটিক স্বচ্ছ। নদীর নিচের পাথর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এতক্ষণে একটাও মাছ চোখে পড়েনি।
বললাম, চাচা, অন্য জায়গায় ছিপ ফেললে হতো না। এইখানে মাছ নেই মনে হচ্ছে।
ভদ্রলোক এবার সত্যি সত্যি রেগে গেলেন। তিনি বললেন, আপনি মাছ ধরার জানেন টা কী? কিছুই জানেন না। আমি ত্রিশ বছর ধরে মাছ ধরছি। কী কইরলে ভালো হইবে শিখার দরকার নাই।
এর মধ্যে সৌমেন কাকু এসে ডাকছেন, এই ঐন্দ্রিল। চলে আয় তাড়াতাড়ি।
সৌমেনকাকুর গণসংগীত গাওয়া বাজখাই গলা। গলার আওয়াজে চারদিক গমগম করে উঠল। মাছ ধরার ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে বললেন, আইজ সকালটাই পুরা লস। আচ্ছা আপনারা কী যাত্রাপার্টি? বন্যার পানি এখনও নামে নাই। এর মধ্যে যাত্রা জমবে?
অনেক কষ্টে হাসি চেপে বললাম, নানা, আমরা মেডিকেল ক্যাম্প করতে এসেছি।
ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, কী করতে এয়েচেন?
মেডিকেল ক্যাম্প। মানে ইয়ে… রোগের চিকিৎসা। ডাক্তারি। গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা করব। শুধু এ গ্রামের নয়। পাশের আরও দুটো গ্রামের।
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন- হুঁ বুঝেছি। আপনারা হলেন গিয়ে আর জি কর পার্টি।
মাথাটা একটু গরম হয়ে গেল। খাল পাড়ের হাসপাতালের সাথে আমাদের মেডিকেল কলেজের একটা আকচা আকচি সম্পর্ক আছে। সে আদায় কাচকলায় সম্পর্ক একমাত্র দুই কলেজের ছাত্র ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারবেন না। গম্ভীর গলায় বললাম, না আমি মেডিকেল কলেজ থেকে এসেছি।
ভদ্রলোক সম্ভবত কিছু বুঝলেন না। তবে তাঁর আচরণের অনেক পরিবর্তন হলো। তিনি ছিপ টিপ গুটিয়ে বললেন, আমি বুঝতে পারি নাই, আপনারে ছোটো বড়ো কথা কয়ে ফেলেচি। আপনারা এখনই ওষুধ দিবেন? আমার কোমরে বড় ব্যথা। একটু বড়ি লইতাম।
একটা ভাঙাচোরা প্রাইমারি স্কুলে খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। অনেকদিন স্কুল ঘরের মেঝে জলের তলায় ছিল। মেঝেয় শ্যাওলা জমেছে। সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে।
সবাই স্কুলের বেঞ্চে বসে খাচ্ছে। আমি বাইরে এসে দাঁড়ালাম।
ধর্মতলায় জুনিয়র ডাক্তারদের অনশন চলছে। আজ অষ্টম দিন। চতুর্থ দিন থেকেই আমিও প্রতিদিন বারো ঘণ্টা করে অনশন করছি। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা। কোনোদিনই এ সময়ে বিন্দুমাত্র খেতে ইচ্ছে করেনি। আজ করছে। মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া ব্লকের এক অজ পাড়াগাঁয়ে ভাঙাচোরা স্কুল বাড়ির বেঞ্চে বসে গরম ভাত, লাবড়া আর কুচো মাছের ঝোল খাওয়ার মতো সুখ খুব কম জিনিসেই আছে।
ওদিকে গ্রামের মানুষ জড় হতে শুরু করেছেন। তিনটে গ্রাম থেকে পিল পিল করে মানুষ আসছেন। প্রথমে রোগী দেখা হবে। তারপর শাড়ি বিতরণ। সৌমেন কাকু তাঁর গীততীর্থ গানের স্কুলের পক্ষ থেকে প্রচুর শাড়ি নিয়ে এসেছেন। কিন্তু এতো মানুষ, কম না পরে যায়।
ইব্রাহিমদা বলে স্থানীয় একজন সব দেখা শোনা করছেন। তিনি বারবার বলছেন, কোনো সমস্যা নাই। যারা একেবারে গরীব তাঁদের টোকেন দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের শাড়ি দিলেই হবে। আমরা সার্ভে করে দেখেছি এদের সত্যিই পরার মতো শাড়ি আর নেই।
খাওয়ার পর মেডিকেল ক্যাম্প শুরু হলো। তিনটে গ্রাম থেকে ঝেঁটিয়ে রোগী এসেছেন। তাতে অবশ্য কোনো সমস্যা নেই। আমি মুর্শিদাবাদের গ্রামীণ হাসপাতালে চাকরি করে আসা ডাক্তার। তিনটে গ্রাম কেন, গোটা ব্লকের সব রোগীরা চলে এলেও সামলে দেব। সঙ্গে ওষুধ পত্রও অনেক আছে।
মুশকিল হলো বয়স্ক কিছু ঠাকুর্দা আর ঠাকুমা কানে শোনেন না। এক জিজ্ঞাসা করলে আরেক উত্তর দেন। চিৎকার করে কথা বলতে বলতে গলা বসে গেল। রূপালী সঙ্গে আসায় সুবিধা হয়েছে। প্রেশার মেপে দিচ্ছে। ওষুধ বুঝিয়ে দিচ্ছে। আর আমার দিকে কড়া চোখে তাকাচ্ছে।
বাড়ি ফিরে ঝাড় খাব। রূপালী অনেকদিন ধরেই বলছিল, কোথাও নিয়ে যাও না। সকাল হলেই চেম্বারে ছোটো। ফেরো রাত্রে। আমি ভুজুং ভাজুং দিয়ে নিয়ে এসেছি। বলেছি, নদী দেখাবো। জংগল দেখাবো। নৌকা চড়াবো। এসব বলে বন্যা বিধ্বস্ত এলাকায় এনে শ’দুয়েক রোগীর ভিড়ের মধ্যে বসিয়ে দিয়েছি। তা যা হবে দেখা যাবে। আগে তো ক্যাম্প শেষ করি।
এক ঠাকুমা চেয়ার থেকে উঠছেনই না। দেখার পর আমার হাত ধরে শুধু বলছেন, বাপধন, আমার বাড়ি কাছেই। এট্টু চা করে আনি। চিনি নাই। বাতাসা দিয়ে করে আনি।
বললাম, চা আমাদের সাথেই আছে। বলে একটা ফ্লাক্স দেখালাম।
ঠাকুমা বললেন, তাহলে দুটা বাতাসা খাও। আর জি করের লোক তোমরা।
রেগে মেগে বললাম, আর জি কর নই, আমি অন্য জায়গার। ওই দিদিমণিকে বাতাসা খাওয়ান। উনি বাতাসা খুব ভালোবাসেন। বলে রূপালীকে দেখিয়ে দিলাম।
আমাদের সাথে মুনমুন দি এসেছেন। তিনি মধ্যমগ্রাম হাই স্কুলের অংকের শিক্ষিকা। আমাদের সময় স্কুলে কোনো শিক্ষিকা ছিলেন না। সকলেই পুরুষ, এবং বেত, ডাস্টার, পেন এসবকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারদর্শী ছিলেন। এখন নাকি মধ্যমগ্রাম স্কুলে বেশ কয়েকজন শিক্ষিকা আছেন।
জিজ্ঞাসা করলাম, দিদিমণি, উঁচু ক্লাসের ছেলেদের ঠ্যাঙাতে আপনার সমস্যা হয় না?
তিনি অবাক হয়ে বললেন, ঠ্যাঙাব কেন। আমি তো ক্লাসে যাই, পড়াই, চলে আসি। কোনো সমস্যা নেই।
সমস্যা না থাকলেই ভালো। আমি রোগী দেখায় মন দিলাম। অনেকেই পাশ থেকে উঁকি ঝুঁকি মারছে। মায়েরা বাচ্চাদের ফিসফিস করে কীসব বলছেন। একটা কথাই শুধু বারবার কানে আসছে। আর জি অর… আর জি কর।
এক স্থানীয় কর্মকর্তাকে ডাকলাম। বললাম, দাদা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব, যদি কিছু মনে না করেন?
করেন?
আচ্ছা দাদা, এখানে সবাই আর জি কর, আর জি কর করছে কেন? আমরা তো আর জি কর থেকে আসিনি। কোনো হাসপাতাল থেকেও আসিনি। মধ্যমগ্রামের কয়েকজন মিলে এসেছি। আর গীততীর্থ বলে একটি গানের স্কুলের কয়েকজন।
কর্মকর্তা বললেন, এখানকার মানুষ দেশের খবর টবর কম রাখে। তবে গত দুমাস ধরে আর জি কর আন্দোলনের খবর সবাই শুনেছে। ওখানকার ডাক্তারবাবুরা মানুষের ভালোর জন্য আর একটা মেয়ের বিচারের জন্য আটদিন না রয়েছেন, সেটা অনেকেই জানে। তাই যারাই এদের পাশে দাঁড়াতে আসছেন, ওরা ভেবে নিচ্ছে আর জি করের লোক।
বললাম, কিন্তু যেসব জুনিয়ররা অনশন করছে, তারা তো সবাই আর জি করের নয়। অন্যান্য কলেজেরও আছে। আমার কলেজ মেডিকেলেরই আছে তিনজন।
কর্মকর্তা হাসলেন। বললেন, ওসব মেডিকেল, এন আর এস, পিজি এখানকার কেউ জানেনা। এরা জানে যারা ওদের সাহায্য করতে আসছে তাঁরা সবাই আর জি কর।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝে গেলাম কথা পুরোই সত্যি। মহিলাদের হাতে শাড়ি তুলে দেওয়া শেষ হলো যখন, ঘুটঘুট্টে অন্ধকার হয়ে গেছে। আকাশ গঙ্গা ছায়াপথ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। ততক্ষণে আমিও পুরোপুরি আর জি কর হয়ে গেছি। শুধু আমি নই, রূপালী, মুনমুন দিদিমণি, গানে স্কুলের ছাত্রীরা, কেষ্টোদা, সৌমেন কাকু সবাই আর জি কর হয়ে গেছি।
আর এই প্রথম মেডিকেল কলেজের ছাত্র হয়েও নিজের আর জি কর পরিচয় দিতে মোটেও খারাপ লাগছে না।