“আমি জানি, এরা আমাকে হত্যা করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। একথা আমি ভালভাবেই জানি যে এই আন্দোলন চলাকালীনই ওরা আমাকে মেরে ফেলতে পারে। মৃত্যু প্রত্যেকের জীবনেই আসে। আমার জীবনেও আসবে। আজ নয়তো কাল। এক বছর বাদে অথবা পরের বছর। এমন কি আগামীকালও আসতে পারে।
আমি জানি পৃথিবী বড়োই সুন্দর। আমি এই দুনিয়ায় এমন এক ব্যবস্থা আনার জন্য লড়াই করছি, যে ব্যবস্থায় শোষণ শোষণ থাকবে না, মেহনতি মানুষ, শ্রমিক কৃষক শান্তিতে জীবনযাপনের সুযোগ পাবে। কিন্তু আমি চাইলেই সব কিছু হয়ে যাবে না। তবুও আমার জীবনের কর্তব্য পূরণ করতে হবে। আমি এই সুন্দর পৃথিবীটাকে ভীষণ ভালবাসি।কিন্তু আমার কর্তব্য, আমার কাজ আমার কাছে সবার চেয়ে প্রিয়….”
শুনতে শুনতে শুভ-র দু চোখ জ্বালা করে ওঠে। একজন মানুষ কী ভাবে এমন সাহসী এবং ঋজু হতে পারে! মৃত্যু ওত পেতে বসে আছে জেনেও তার অবর্তমানে কী ভাবে সংগঠন চলবে, তার স্বপ্ন কি কি সে সম্বন্ধে টেপ রেকর্ড করে ক্যাসেট বানিয়ে রাখতে পারেন। আঠাশে সেপ্টেম্বর তাঁকে খুন করা হয়েছে আর আজ দেখতে দেখতে অক্টোবরের পাঁচ তারিখ হয়ে গেল। শংকরের দেখা স্বপ্নগুলো কি অধরাই থেকে যাবে নাকি শুভ আর বাকিরা পারবে সেসব স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে। শুভ-র কানে বাজতে থাকে গুরু গম্ভীর স্বরে শংকরের বলা কথাগুলো।
‘আমার মৃত্যুর পর এমন এক নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে যে নেতৃত্বের এই আস্থা থাকবে যে তারা সঠিক দিশায় আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আমাদের আন্দোলনের দুই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নির্মাণ ও সংঘর্ষ। গড়ার কাজ করে যাওয়ার সাথে সাথে সব ধরণের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।” শংকর অনুমান করেছিলেন একদিন ভারতে একটা প্রকৃত মার্কসবাদী লেনিনবাদী পার্টি গঠিত হবে এবং ছত্তিশগড়ের বিপ্লবী সাথীদের সেই পার্টির সাথে মিলে গিয়ে নতুন দুনিয়া তথা নতুন সমাজ গড়ার সংগ্রামে শরিক হতে হবে।’
যে ভিলাই আন্দোলন নিয়োগীজির নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল তা এগিয়ে নিতে উদ্যোগী হলেন পরবর্তী সংগঠকরা। ১৯৯২ সালের ১ জুলাই সকাল ন’টায় ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার অধ্যক্ষের নির্দেশে শ্রমিকরা ভিলাই পাওয়ার স্টেশনের দিকে এগিয়ে চলল। চলল রেল লাইনের ওপর অবস্থান। বার বার মালিক পক্ষের সাথে বৈঠক করেও কোনও লাভ হচ্ছে না। শ্রমিকদের নয় দফা দাবী অধরাই থেকে যাচ্ছে। যে নয় দফা দাবী শ্রমিকদের ছিল তার মধ্যে প্রধান তিন দাবী হল, স্থায়ী কারখানায় স্থায়ী চাকরি, মোটামুটি বেঁচে থাকার উপযোগী বেতন, ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্য যে সব শ্রমিককে কারখানা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল তাদের কারখানায় পুনর্বহাল করা। নিয়োগীজি চলে যাওয়ার পর আন্দোলন ও সংগঠনের হাল ধরতে নয় সদস্যের এক কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। শুভ বুদ্ধিজীবি হিসাবে ওই কমিটির একজন মেম্বার হল। শান্তিপূর্ণভাবে শ্রমিকরা রেলপথে বসে স্লোগান দিচ্ছে, সমস্বরে গণ সংগীত গাইছে সেই সময় বেলা গড়িয়ে একটা বাজে। এক বিশাল পুলিশ বাহিনী হাজির হল সেখানে।শ্রমিকদের লাইন ছেড়ে দিতে বলা হল। তারা নারাজ। খুব সামান্য দাবী তাদের। শ্রমিকদের পুনর্নিয়োগের যে খসড়া তৈরি হয়েছে মালিক পক্ষ তাতে সাইন করলেই তারা রেল অবরোধ তুলে নেবে। বিকেল চারটে নাগাদ বিক্ষোভকারীদের ঘিরে ফেলে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছোঁড়া শুরু করল। শ্রমিকদের অবিচল থাকতে দেখে লাঠি চার্জ শুরু হল। ছ’টার নাগাদ চলল গুলি। গুলিতে শহীদ হলে এগারো জন ইউনিয়নের সদস্য আর চার জন সদস্য নন এমন মানুষ।
রক্ত রাঙা ছত্তিশগড়ের মাটি যেন আরও লাল হয়ে উঠল। বিপ্লবে, সংগ্রামে, সংঘর্ষে…… কিন্তু নির্মাণ? শংকরের আদর্শ, দেখান পথ, স্বপ্ন?