শুভ ভাবতেও পারে নি কলেজে এত তাড়াতাড়ি এতটা পরিচিত মুখ হয়ে উঠতে পারবে। নির্বাচনে জিতে সে এখন পাঁচ জন ছাত্র প্রতিনিধির এক জন। সেটার থেকেও বড় কথা সিনিয়ররা ওর ওপর যথেষ্ট নির্ভর করে। ওর ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়াটা বাবা মোটেই সহজে মেনে নিতে চায় নি। কিন্তু শুভ এই ব্যাপারটায় আগাগোড়া শক্ত হয়ে থেকেছে। জীবনের সব সিদ্ধান্ত বড়দের মত অনুযায়ী নেওয়ার বয়স তার পেরিয়েছে। কলেজে সেদিনের আলোচনায় যেটা ঠিক হয়েছে তার অনেকটা দায়িত্ব শুভকে নিতে হয়েছে। আশীষদার কথা সে ফেলতে পারে নি। যদিও শুভ জানে পড়াশোনার দিকটা তার ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে। ফার্স্ট এম বি বি এস পরীক্ষার যে খুব বেশি দেরি আছে তা নয়। দেখতে দেখতে তো প্রায় এক বছর গড়িয়ে গেল। কিন্তু এখন তার দম ফেলার ফুরসত নেই। খানিকটা গা ছেড়ে দেয় ও। যা হবে পরে দেখা যাবে। যেন সময়ের ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ এসে ওকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে এক অনাস্বাদিত রোমাঞ্চের দিকে। বিপ্লব শব্দটা শুধু বইয়ের পাতায় পড়েছে, ছাপার অক্ষরে লেখা শব্দটার ভেতরে যে বারুদ ঠাসা তার গন্ধ এখন যেন নাকে এসে লাগছে। ক্লাসের অন্যান্য ছেলে মেয়েদের সাথে বেশ ভালই সম্পর্ক শুভ-র। কেবল একজনই যেন একটু এড়িয়ে এড়িয়ে চলে ওকে। শুভ খেয়াল করেছে। কখনও করিডরে বা ক্লাসের ফাঁকে সামনা সামনি পড়ে গেলে সযত্নে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আর এই এড়িয়ে চলাই যেন চতুর্গুন আকর্ষণে শুভকে কক্ষচ্যুত করে। আশীষদা আর সুমিতাদির মধ্যে যে একটা বিশেষ সমীকরণ আছে তা এতদিনে বুঝে গেছে শুভ। ওদের চোখের ভাষায় সে কথা অনায়াসেই পড়ে ফেলা যায়। ওরা যে দুজনে এক সঙ্গেই জীবন কাটাবে এবং ভবিষ্যতে একই কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন কিছু করবে সে বিষয়ে কোনও দ্বিধা নেই। শুভও মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে চলে ক্রমাগত। অন্যরকম ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে। সেই স্বপ্নের এক কোণে বার বার ঘুরে ফিরে আসে একটা মুখ। এ এক আশ্চর্য সমাপতন!
কলেজে গিয়েই আগে বিভাসদার সঙ্গে দেখা করে যে তথ্যগুলো পেয়েছে সেগুলো জমা দিতে হবে। আজ নীলেশদা আর অভিজিৎ স্টোরে ওষুধের ব্যাপারটা খোঁজ নিয়ে জানাবে বলেছে। গত এক মাস ধরে হাসপাতালে ব্যাপক অনুসন্ধান চালাচ্ছে ওরা। উদ্যোগটা ছাত্র সংসদ আর এমসিডিএসএ যৌথ প্রচেষ্টায় নেওয়া। কিন্তু যে সব তথ্য সামনে আসছে তা দেখে বুঝে শুভরা হতবাক। হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে সিনিয়র অফিসার অন ডিউটির সাতটা পদের মধ্যে তিনটে পদ খালি। হাউস স্টাফেদের নিজেদের কাজ প্রচুর কিন্তু তবু তাদের দিয়ে জোর করে জুনিয়র অফিসার অন ডিউটির কাজ করানো হয়। গত এক মাস ধরে ইসিজি মেশিন খারাপ হয়ে পড়ে আছে। ফলে হার্টের রুগীদের অন্য হসপিটালে রেফার করা হচ্ছে। পথেই এক দু’জন মারা গেছে। ইমার্জেন্সিতে রক্ত পাওয়া যায় না। সেখানে ঘূণ পোকার মতো সিস্টেমের গায়ে জন্মে গেছে চোরা কারবারি। অতিরিক্ত পয়সা দিলে ওদের থেকে রক্ত পাওয়া যায়। অক্সিজেন সিলিন্ডারের অভাব। বহু জীবনদায়ী ওষুধ স্টোরে নেই। ফলে রোগীরা বিনা ওষুধে ধুঁকতে ধুঁকতে মরছে। হাসপাতাল না নরক গুলজার!
শুভ কিছুটা জোরে পা চালিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। ক্যান্টিনে বসে এসব আলোচনা সম্ভব নয়। ওখানে সব সময়ে গিজ গিজ করছে ছাত্র ছাত্রীরা। যদিও ছাত্র পরিষদ এখন কিছুটা কেঁচো হয়ে গেছে। কেন্দ্রে কংগ্রেসের হেরে যাওয়া আর পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে জ্যোতিবাবুর নেতৃত্বে বাম সরকারের মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা এই দুই ধাক্কায় ওরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। তুলনায় এমসিডিএসএ এখন অনেক সক্রিয়। বিভাসদার নির্দেশ মতো খানিকটা চুপি চুপি ক্লাসের অন্যান্যদের চোখ এড়িয়ে সিনিয়র হস্টেল বিল্ডিং-এ ঢুকে পড়ল শুভ। গোটা বিল্ডিংটা খাঁ খাঁ করছে। দু’ চার জন যাদের নাইট ডিউটি ছিল তারা এই মূহূর্তে ঘুমিয়ে কাদা। বাকিরা দিনের ডিউটিতে ব্যস্ত। পাশের বড়ো জাম গাছটায় বসে একটা কাক তারস্বরে ডেকে চলেছে। এক ঘেয়ে যে কোনও কিছুই কিছুক্ষণ পরে গা সওয়া হয়ে যায়। শুভর মনে হল সরকারি হাসপাতালের এই চরম অব্যবস্থাও যেন সাধারণ মানুষের গা সওয়া হয়ে গেছে। কই কোনও দিকে কেউ প্রতিবাদ করে না। করলেও পাবলিকের যত রাগ গিয়ে পড়ে কর্মরত ডাক্তারদের ওপর। আসল কারণ খতিয়ে দেখার সদিচ্ছা কোথায়। নিজেকে হঠাৎ খুব ভাগ্যবান মনে হয় শুভ-র। প্রথম দিন ভাগ্যিস আশীষদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তার জন্যই তো আজ ও সম্পূর্ণ অন্য রকম ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। এই যে ধীরে ধীরে একটা বৃহত্তর আন্দোলনের বীজ বুনে চলেছে ওরা, সেই সেতু বন্ধের কাজে শুভও তো কাঠবেড়ালিটার মতো নুড়ি পাথর বয়ে এনে জোটাচ্ছে। করিডর দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে শুভ-র কানে এল অভিজিৎ-এর গলার আওয়াজ। খুব উত্তেজিত মনে হল ওকে। শুভ ঘরে ঢোকে। বিভাসদা চৌকির এক কোণে বসেছিল। চোখের ইশারায় বসতে বলে ওকে। শুভ পাশে রাখা একটা কাঠের টুল টেনে নিয়ে বসে। খবরটা বেশ চমকপ্রদ বটে আউটডোরে বা ইনডোরে কোথাও পেনিসিলিন বা সালফা ড্রাগ ছাড়া অন্য কোনও আন্টিবায়োটিক নেই। চামড়া ডিপার্ট্মেন্টে তো তাও পাওয়া যায় না। একটা এত বড় হাসপাতালের ভেতরে এত অব্যবস্থা! ক্রমে ক্রমে ওদের সার্ভেতে আরও তথ্য উঠে আসে। মেডিক্যাল কলেজে একটা বার্ন ইউনিট নেই, পোড়া রুগীদের বারান্দায় ফেলে রাখা হয়। তার ফলে তাঁদের মধ্যে অনেকেই সংক্রমণে মারা যান। আউটডোরে তিন ঘন্টা অপেক্ষা করলে তবে রুগী ডাক্তারের সাথে এক মিনিট কথা বলার সুযোগ পান, আর ভাগ্য খুব ভাল হলে সময় পান তিন থেকে চার মিনিট। ওষুধের অবস্থাও তাই। দীর্ঘ ক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে গড়ে পঁচিশ পয়সার ওষুধ পাওয়া যায়। অনেকে খালি হাতেই বাড়ি ফেরেন। এই ফিরিস্তির যেন শেষ নেই। আশীষদা বলে ওঠে,”যক্ষ্মা রুগীদের থাকার ঘরটা দেখেছিস? ইউ উইল এক্সপেরিয়েন্স দ্য হেল আই স্বয়ার” বিভাসদা সংযোজন করে।“ আমি শুভকে দিয়ে খবর করিয়েছি, মেটারনিটি ওয়ার্ডের অবস্থাও খুব খারাপ। এক একটা বেডে তিন জন করে মা থাকতে বাধ্য হচ্ছে ফলে সংক্রমণের হার বাড়ছে।“ ওষুধ কোম্পানীগুলোর কাছে সরকারের ধার পঞ্চান্ন লাখ টাকা। হায় রে ভারতবর্ষ স্বাধীনতার তিরিশ বছর কেটে যাওয়ার পরেও এই দুরবস্থা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার! আচ্ছা ইংরেজ আমলেও কি ওষুধ আর পথ্যের কারচুপিটা এমনই ছিল? ভেতরে আর বাইরে এত ধুলো এত দুর্গন্ধ? বোধ হয় না। স্বাধীনতার এমন সুফল সত্যিই কি আমাদের কাম্য?
সমস্ত তথ্য গুছিয়ে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল অবস্থা পরিবর্তনের দাবীতে আন্দোলনে নামবে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র আর জুনিয়র ডাক্তাররা।
সে দিনের সেই সিদ্ধান্ত তুমুল আন্দোলনের আকার নিল। মেডিক্যাল কলেজ উত্তাল হল ছাত্র আর জুনিয়র ডাক্তারদের দাবীতে। হসপিটাল মুভমেন্টের ঢেউ আছড়ে পড়ল আর জি কর হসপিটালেও। অবস্থা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় যখন কলকাতা শহরের বুকে ডাক্তারদের আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে ঠিক সেই সময়ে সূদূর ছত্তিশগড়ে দল্লী আর রাজহরা পাহাড়ের কোলে আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে চলেছে কমরেড শংকর গুহ নিয়োগী। শুভ জানতেও পারে না তার জীবনে এও এক আশ্চর্য সমাপতন।