ভদ্রলোক কথা বলতে গিয়ে কাশছেন। কাশতে কাশতে চোখ দিয়ে জল বেরোচ্ছে৷ কোনো রকমে কাশি থামিয়ে বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, কিছু একটা করুন। দেখছেন তো অবস্থা।’
তারপর আবার কাশতে শুরু করলেন, ‘খক.. খক…, খকর খক, খ্যাঁক খ্যাঁক.. খ্যাঁকস….’
গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘কবে থেকে কাশি?’
ভদ্রলোক হাত নেড়ে বোঝালেন তিনি কাশিতে মনসংযোগ করেছেন। আপাতত আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না।
আমি স্টেথো বাগিয়ে ধরলাম। তবে স্টেথো লাগানোর দরকার ছিল না। দূর থেকেই দিব্যি হারমোনিয়ামের সপ্ত সুর শুনতে পাচ্ছিলাম।
বুক পকেটের ওপর স্টেথো বসিয়ে হতাশ হলাম। আমার উদ্দেশ্য সফল হল না। খচ মচ.. শব্দ শুনতে পেলাম না।
বললাম, ‘উঠে দাঁড়ান।’ স্টেথো বুক থেকে পেটে, তারপর যখন আরও নিচে নামাচ্ছি.. ভদ্রলোক প্রতিবাদ করলেন।
তবে তার আগেই আমার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ভদ্রলোকের প্যান্টের ডান পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেট টেনে বার করলাম। বললাম, ‘ছিঃ ছিঃ…, এই জটিল কাশি নিয়েও আপনি বিড়ি খাচ্ছেন।’
উনি রুষ্ট হয়ে বললেন, বিড়ি না খেয়ে বুর্জোয়াদের মতো সিগারেট খাব নাকি? গরীবের রক্তচোষা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির হাতে পয়সা তুলে দেব?’
বললাম, ‘সিগারেট খাওয়ার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে!! কোনটাই খাবেন না আপনি। বিড়িও নয়, সিগারেটও নয়।’
ভদ্রলোক এতটাই উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন যে কাশিটা অনেক কমে গেছে। বললেন, ‘আপনার আইডিয়া আছে কত গরিব মানুষ বিড়ি বেঁধে খায়? আপনার কথা মত সবাই চললে ওদের তো না খেয়ে মরতে হবে!!’
এই হয়েছে এক মুশকিল। বাঙালী সুযোগ পেলেই গরিব মানুষ দরদী হয়ে যায়। কথায় কথায় শ্রেণী বৈষম্য টেনে আনে।
বললাম, ‘আপনি কি লজিক্যাল ফ্যালাসি কাকে বলে জানেন?’
ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে বললেন, ‘ভুল যুক্তি।’
‘ভুল যুক্তি নয়। ভুল যুক্তিকে সরাসরি ভুল বলা যায়। লজিক্যাল ফ্যালাসি মানে হলো কু যুক্তি। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি হাতে অতগুলো আঙটি পরেছেন, তবু আপনার শরীরের এই হাল কেন? আপনি তার উত্তরে বললেন; জানেন, আমি এক নামকরা ডাক্তার কে দেখাতে গেছিলাম। তাঁর দু’হাতের আঙুলে সাতখানা আঙটি। তিনি কি তাহলে ডাক্তারির কিছুই জানেন না।’
ভদ্রলোক কোন রকমে বললেন, ‘সে আঙটি না হয় খুলে রাখব। আপনি আপাতত কাশি কমান। পরে লজিক্যাল ফ্যালাসি নিয়ে তর্ক করা যাবে।’
এরমধ্যে দরজা খুলে একটি ছেলে ভয়ে ভয়ে মুখ বাড়াল। দেখেই চিনলাম। কালকে বাবাকে দেখিয়ে নিয়ে গেছে। ওর বাবার স্ট্রোক হয়েছে।
বললাম, ‘কিছু বলবে?’
‘আজ্ঞে ডাক্তার বাবু, বাবা তো শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। এতো কাঁদলে খারাপ কিছু হবে না তো?’
হাত বাড়িয়ে প্রেশক্রিপশ নিলাম। ব্রেন স্টেমে ছোট্ট একটা স্ট্রোক হয়েছে। তার ফলে সিউডো বালবার পলসি। সাধারণত স্ট্রোকে একপাশ দূর্বল হয়ে যায়। ভাগ্য ভালো থাকলে ব্যায়াম ট্যায়াম করে অনেকেই দিব্যি জোর ফিরে পান।
এই সিউডো বালবার পলসি নিয়ে ভারি ঝামেলা। এনাদের নানা রকম মানসিক সমস্যা দেখা যায়। কেউ কেঁদে ভাসান, কেউ সব কিছুতেই হাসেন। অনেকেরই কথা জড়িয়ে যায়। চিৎকার করে অদ্ভুত স্বরে কথা বলেন।
বললাম, ‘ওষুধ দিয়েছি। কটা দিন দেখা যাক।’
ছেলেটি আবার বললো, ‘সারাক্ষণ কাঁদলে বাবার তো শরীর খারাপ হবে।’
আমি বললাম, ‘দেখো, তোমার বাবার প্রেশার বেড়ে স্ট্রোক হয়েছে। চোখের জল কখনও মুখে দিয়ে দেখেছো? সমুদ্রের জলের চাইতেও লোনা। যত কাঁদবেন, ততো ওনার শরীর থেকে লবণ মানে সোডিয়াম বেরিয়ে যাবে। আর সোডিয়াম বেরোলে ওনার প্রেশারও স্বাভাবিক থাকবে।’
ছেলেটি হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর বলল, ‘তাহলে কি প্রেশারের ওষুধ বন্ধ করে দেব? যা কাঁদছেন, প্রেশার ফল করে যাবে না তো?’
সর্বনাশ করেছে। বললাম, ‘খবরদার না। আমি কান্নার হিসাব করেই ওষুধ দিয়েছি। তুমি বরঞ্চ দশ দিন বাদে বাবাকে নিয়ে আসো। আরেকবার দেখি।’
ছেলেটি বিদায় নিল। ভদ্রলোক কাশি থামিয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে আছেন। তিনি বললেন, ‘আপনার এই কথা গুলিকেও কি লজিক্যাল ফ্যালাসি বলা যায়?’
তখনই ছেলেটি আবার দরজা ফাঁক করলো। বললো, ‘ডাক্তার বাবু, কাঁদতে কাঁদতে বাবার আবার সোডিয়াম ফল করে যাবে না তো? সোডিয়াম কি একবার মেপে নেব?’
আমি একটু রাগ দেখিয়েই বললাম, ‘নিজে থেকে কিচ্ছু করতে হবে না। দশ দিন বাদে নিয়ে আসতে বললাম তো। যদি মাপতেই হয় তখন বলব।’
মাস্কের আড়ালে ভদ্রলোক হাসছেন স্পষ্ট বুঝলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ হাসতে পারলেন না। কাশি শুরু হলো। আমি আন্তরিক খুশি হলাম। বেশ হয়েছে।
ওষুধ পত্র লিখে তাঁকে বিদায় করলাম। সবার উপরে বড় বড় করে বাংলায় লিখলাম, বিড়ি বন্ধ করুন। একান্তই যদি বিড়ি শ্রমিকদের বাঁচাতে চান, বিড়ি কিনুন আর ড্রেনে ফেলুন।
বাড়ি ফিরে রাত দশটায় ফেসবুক খুললাম। চিকিৎসকরা এবার কালীপুজোয় করোনা মহামারীর জন্য বাজী নিষিদ্ধ করার আবেদন করেছেন। করোনায় বহু মানুষের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের জন্য বাজীর ধোঁয়ার নানা রকম সুক্ষ্ম কণা ও বিষাক্ত গ্যাস অত্যন্ত ক্ষতিকারক। এমনকি মৃত্যুর কারণও হতে পারে।
বাজী প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির ফোরাম আবার বিবৃতি দিয়েছে বাজী নিষিদ্ধ করলে এই শিল্পের সাথে জড়িত বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন গাড়ির ধোঁয়াতেও তো পরিবেশ দূষণ হয়। তাহলে ডাক্তার বাবুরা কেন গাড়ি চড়েন? হেঁটে হেঁটে, সাইকেলে বা আগেকার দিনের মতো ঘোড়ায় চড়ে কেন যাতায়াত করেন না?
অত্যন্ত সঙ্গত প্রশ্ন। লজিক সত্যিই এক আশ্চর্য জিনিস।