এবারের ভোট: প্রবল গরমে মোদিজীর প্রচারের সুবিধামত সাত পর্বের প্রতি পর্বেই গণনার আগে তাঁর জয় ঘোষিত হতে থাকে। একসময় বারাণসীতে গঙ্গায় নৌবিহার করতে করতে নিজেকে গঙ্গা মার সন্তান এবং পরমাত্মার সৃষ্টি ঘোষণা করে পুনরায় তিনি দেশ সেবার সংকল্প জানিয়ে পরবর্তী এক্সিট পোলের মাধ্যমে তাঁর জয় জয়কার ঘোষণা করেন। বিবেকানন্দ রকে তাঁর হাই প্রোফাইল কর্পোরেট ধ্যান সম্প্রচারিত হতে থাকে বিজেপির আই টি সেলের মাধ্যমে।
গায়ে গতরে খেটে খাওয়া দেহাতি জন গণেশ সবকিছু এতদিন নীরবে দেখছিলেন। দেখছিলেন। একদিকে তাঁর বিলাসিতা ও ঔদ্ধত্য, অন্যদিকে শিক্ষিত বেকার যুবক এবং অন্নদাতা কৃষকদের সাথে প্রতারণা। এবার তাঁরা নির্বাচনের মাধ্যমে এক চমৎকার রায় দিলেন:
(১) বিকল্প যোগ্য নেতা না পাওয়ায় মোদিজী কেই দেশ সেবার আরেকবার সুযোগ দিলেন কিন্তু তাঁর মধ্যে একনায়কোচিত প্রবণতা দেখে তাঁকে একচ্ছত্র ক্ষমতা দিলেন না। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা (২৪০ আসন, ৩৬.৫৬ % ভোট) দিলেন না, কিন্তু এনডিএ কে নিয়ে (২৯২ আসন) গরিষ্ঠতা দিলেন। এর ফলে আলাপ আলোচনা করে তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ইচ্ছেমত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না।
(২) দেশবাসীকে ঝুলন্ত সংসদের (Hung Parliament) সমস্যা থেকে অব্যহতি দিলেন।
(৩) এক শক্তিশালী বৈচিত্রময় বিরোধীপক্ষের (Strong Opposition) ব্যবস্থা করলেন যার অভাবে মোদি – অমিত শাহরা ভারতীয় গণতন্ত্রকে শ্মশানের দিকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
(৪) দুই তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা তো দিলেন ই না পাছে ইচ্ছামত সংবিধান পরিবর্তন করতে না পারেন।
(৫) বিরোধী জোটের যা নড়বড়ে অবস্থা সংখ্যা গরিষ্ঠতা দিলে মমতা বন্দোপাধ্যায়, শারদ পাওয়ার, লালু যাদব, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, অখিলেশ যাদব, কংগ্রেস প্রমুখ প্রধানমন্ত্রীত্ব নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে পারেন তাই তাঁদের বিরোধী রাখলেন (২৩২ আসন)।
(৬) আবার বিরোধী দলগুলি যাতে বিরোধী দলপতি হওয়ার জন্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে না পড়েন তাই কংগ্রেস কে পরিস্কার এগিয়ে রাখলেন (৯৯ আসন) অন্যদের থেকে। ফলে মমতা দেবীর দিল্লি বৈঠকে যাওয়ার উৎসাহ আপাতত কমে গেল।
বিজেপি কোথায়: এই লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ জোট সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে পরপর তৃতীয়বার জয়লাভ করলো (৫৪৩ টি আসনের মধ্যে ২৯২, ২৭২ প্রয়োজন)। বিজেপি গতবারের (৩০৩) থেকে কমলেও (২৪০) সর্ববৃহৎ দল হিসাবে (প্রধান বিরোধী দল জাতীয় কংগ্রেসের তুলনায় ১৪১ টি আসন বেশি) নির্বাচিত হলো। তাদের প্রাপ্ত ভোট (গতবার ৩৭.৭%, এবার ৩৬.৫৬%, পশ্চিমবঙ্গে ৩৮.৭১%) প্রায় একই রয়ে গেলো।
বিজেপি মধ্যপ্রদেশ (২৯/২৯), গুজরাট (২৫/২৬), ওড়িশা (১৯/২১ এবং বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ), দিল্লি (৭/৭), উত্তরাখণ্ড (৫/৫), হিমাচল (৪/৪), ছত্তিশগড় (১০/১১), অসম (৯/১৪), ঝাড়খণ্ড (৮/১১), তেলেঙ্গানা (৮/১৭) ও ত্রিপুরা (২/২) তে ভালো ফল করেছে এবং কর্ণাটক, রাজস্থান, বিহার, হরিয়ানা ও গোয়াতে বিরোধীদের সাথে সমানে সমানে লড়াই দিয়েছে। দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্র (আনাকাপল্লী, নারাসাপুরম, রাজমুন্দ্রি) ৩ টি ও কেরল (ত্রিসুর) ১ টি তে প্রথম আসন পেয়েছে। কাশ্মীরেও (উধমপুর ও জম্বু) পেয়েছে ২ টি আসন। তাই এখন আর বিজেপি কে কেবল উত্তর ভারতের পার্টি বলা যাবে না। অস্বীকার করা যাবেনা এই বিষয়ে মোদিজী প্রচুর খেটেছেন।
এই দীর্ঘ কষ্টকর বিশাল নির্বাচনে, পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া, কোথাও অশান্তি হয় নি। নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে বিরোধীদের নানারকম অভিযোগ থাকলেও শেষ বেলায় পশ্চিমবঙ্গের কিছু আসন ও ভোট কেন্দ্র ছাড়া কারচুপি, ভোট লুঠ, গণনায় বিকৃতির অভিযোগ নেই। নরেন্দ্র মোদি যেকোন মূল্যে ক্ষমতা দখল করবে প্রচার থাকলেও তিনি এখন অবধি কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মত কোন জরুরি অবস্থা জারি করেন নি, জনতার রায় মেনে নিয়েছেন এবং গণতন্ত্রের জয় আখ্যা দিয়েছেন।
এনডিএ তে বিজেপির সঙ্গীরা: এন ডি এ তে এই মুহূর্তে ১৪ টি দল রয়েছে। বিজেপি বাদে দুই প্রবীণ ও ঝানু রাজনীতিকের, চন্দ্রবাবু নাইডু (তেলেগু দেশম পার্টি, অন্ধ্র থেকে ১৬ টি আসন) ও বিহারের দীর্ঘদিনের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার (জনতা দল ইউনাইটেড, বিহার থেকে ১২ টি আসন) একদিকে চালিকা শক্তি অন্যদিকে মোদিজীর মাথা ব্যথার কারণ হিসাবে থাকবেন। এরমধ্যে চন্দ্রবাবু র নেতৃত্বে টি ডি পি অন্ধ্র বিধানসভা নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। এরপর ৭ টি আসন নিয়ে শিব সেনা (শিন্ডে), ৫ টি আসন নিয়ে চিরাগ পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি এবং ২ টি করে আসন নিয়ে জনতা দল সেক্যুলার, জয়ন্ত চৌধুরীর রাষ্ট্রীয় লোক দল, জন সেনা পার্টি রয়েছে। বাকি AGP, HAMS, NCP (Ajit Power), SAD, RLTP, AJSU, Apna Dal (Sonelal) এর রয়েছে একটি করে আসন।
জাতীয় কংগ্রেস: ভারতের সবচাইতে জনপ্রিয় দেশনেতা মোহনদাস গান্ধীর চম্পারণ বা দাণ্ডি অভিযানের চাইতে অনেক বৃহৎ ও ব্যাপক কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর এবং মনিপুর থেকে মুম্বাই দুটি দীর্ঘ ভারত জোড়ো যাত্রা করে অনেক পরিণত ও লড়াকু রাহুল গান্ধী সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। প্রথম দিকে ঢিলেমি করলেও পরে ইন্ডিয়া জোট কে এগিয়ে নিতে চেয়েছেন। পাশে ছিলেন সোনিয়া গান্ধী এবং প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র। কংগ্রেস এবার অনেক বেশি ৯৯ টি আসন পেয়েছে (২১.১৯% ভোট)। বিজেপির সাথে সরাসরি লড়াই এ ২৯% ক্ষেত্রে জয়লাভ করেছে। ভালো ফল করেছে অথবা আসন বাড়িয়েছে কেরল, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, বিহার, পাঞ্জাব ও মনিপুরে। রাহুল নিজে উত্তরের রায়বেরিলি ও দক্ষিণের ওয়াইনাদ থেকে ভালো সংখ্যক ভোটে জিতেছেন। কংগ্রেসের ম্যানিফেস্টো এবং প্রতিশ্রুতি এবার যথেষ্ট সাড়া ফেলেছিল।
ইন্ডিয়া জোটে কংগ্রেসের সঙ্গীরা: কংগ্রেসের ২২ জন সঙ্গীর মধ্যে রয়েছেঃ এর মধ্যে প্রথমেই বলতে হবে অখিলেশ যাদব এর সমাজবাদী দলের কথা। বিজেপির পাল্টা সামাজিক ইঞ্জিনিয়ারিং ঘটিয়ে মোদি – যোগী ডাবল ইঞ্জিনকে মাত করে দিয়েছেন। এমনকি অযোধ্যার রাম মন্দিরের কেন্দ্র ফয়জাবাদ তারা জিতে নিয়েছেন।
সমাজবাদী দল (৩৭ আসন, ৪.৫৮% ভোট), অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস (২৯ আসন, ৪.৩৭% ভোট), ডি এম কে (২২ আসন, ১.৮২% ভোট), শিব সেনা (উদ্ধব, ৯ টি আসন), এন সি পি (শারদ পাওয়ার, ৮ টি আসন), আর জে ডি ও সিপিআইএম ৪ টি করে আসন। এ এ পি, আই ইউ এম এল ও জে এম এম ৩ টি করে আসন। ২ টি করে আসন সিপিআই, সিপিআই লিবারেশন, JnP, VCK, JKN, JKNF। ১ টি করে আসন RSP, KEC, UPPL, BAP …।
বামপন্থীরা: সার্বিকভাবে বামপন্থীদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেলেও শেষ বেলায় তাঁরা সামান্য ফিরে এসেছেন। অবশ্য এই ক্ষেত্রে তাঁরা বিরোধী জোটে সামিল হওয়ার সুবিধা পেয়েছেন। সিপিআইএম চারটি (তামিলনাড়ুর দিন্দিগুল ও মাদুরাই, কেরলের আলাথুর ও রাজস্থানের সিকার), সিপিআই দুটি (তামিলনাড়ুর তিরুপপুর ও নাগাপত্তনন), সিপিআইএমএল লিবারেশন দুটি (বিহারের আরা ও কারাকাট) এবং আরএসপি একটি (কেরলের কোল্লাম) মোট আটটি আসনে জয়লাভ করেছে। প্রতিটি অঞ্চলেই বাম দলগুলির কৃষক, শ্রমিক ও অনান্য মেহনতি মানুষের মধ্যে দীর্ঘ কাজ ও লড়াই রয়েছে।
নির্দল, নোটা ও অন্যান্য: শাসক দলের সাথে চোখে চোখ রেখে প্রচুর লড়াই চালিয়ে ও ব্যাপক দমনের মধ্যেও দুটি নবীন দলিত ও জনজাতি দল, উত্তর প্রদেশে আজাদ সমাজ পার্টি ও রাজস্থানে ভারতীয় আদিবাসী পার্টি আসন পেয়েছে। এছাড়া অন্ধ্রের YSRCP ৪ টি আসন এবং আরও ছয়টি আঞ্চলিক দল ১ টি করে আসন পেয়েছে। নির্দল পেয়েছেন ৭ টি আসন। ওড়িশার নবীন পটনায়কের বিজেডি মাত্র ১ টি আসন পেয়েছে। উত্তর প্রদেশের মায়াবতীজীর বহুজন সমাজ পার্টি এবং তেলেঙ্গানার চন্দ্রশেখর রাও এর বিআরএস একটিও আসন পায়নি। কেন্দ্রে ও পশ্চিমবঙ্গে NOTA তে যথাক্রমে ৬২.৯৯ লক্ষ (০.৯৯%) ও ৫.১৪ লক্ষ (০.৮৭%) ভোট পড়েছে।
আমাদের পশ্চিমবঙ্গ: নরেন্দ্র মোদির ধারাবাহিক আগ্রাসী প্রচারকে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিহত করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্রমাগত পাল্টা আগ্রাসী প্রচারে এবং শক্তিশালী সংগঠন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আই প্যাক সংস্থা ও পুলিশ – প্রশাসনের সহায়তা, প্রতিটি কেন্দ্র ধরে পরিকল্পনা, লক্ষী ভাণ্ডার সহ জনগণের কর থেকেই বিভিন্ন জনবাদী (Populist) অর্থদান প্রকল্পর (Cash Transfer Schemes) মাধ্যমে মহিলা – তফসিলি – জনজাতিদের সাথে সংযোগ, বিজেপির অস্ত্র শর্তাধীন সিএএ কে বিজেপির বিরূদ্ধেই ঘুরিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ মুসলিম ভোট এবং বিভ্রান্ত মতুয়া দের বড় অংশের ভোট অর্জন প্রভৃতির মাধ্যমে ৪৫.৭৮% ভোট পেয়ে ৪২ টি আসনের মধ্যে তৃণমূলের একার ২৯ টিতে জয় নিঃসন্দেহে বিশেষ কৃতিত্বের দাবি রাখে। কিছুতেই দমে না যাওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কঠোর পরিশ্রম করেছেন, শক্ত হাতে কোন গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব হতে দেননি।
বিপরীতে প্রধান বিরোধী দল বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গে লড়াই করে প্রতিষ্ঠা করার নায়ক দিলীপ ঘোষ ও সুব্রত চট্টোপাধ্যায় কে আগেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এছাড়া ছিল গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব, বিজেপির কোন ধারাবাহিক কাজ ও সংগঠন গড়ে না তোলা, দিশাহীন নির্বাচনী কর্মকাণ্ড, প্রার্থী নির্বাচনে পরিকল্পনার অভাব। এছাড়া শুভেন্দু অধিকারীর অতীত এবং ঔদ্ধত্বপূর্ণ আচরণ কিংবা বিজেপির হিন্দিভাষী বাইরের নেতাদের সামঞ্জস্যহীন বক্তব্য অথবা কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সঠিক রূপায়ণ ও দুর্নীতি বন্ধের পরিবর্তে টাকা আটকে দেওয়ার ঘোষণা সবই তাদের বিপরীতে গেছে। সন্দেশখালির তৃণমুল মাফিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মহিলাদের বীরত্বব্যঞ্জক সংগ্রামকে তারা অধঃপতিত করে। সর্বোপরি বিজেপির কেন্দ্র নেতৃত্বের সাথে তৃণমূল নেতৃত্বের প্রতিযোগিতামূলক বোঝাপড়া (Understanding & Competition) পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বিকাশের প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
ভুল নীতি, উদ্যোগের অভাব ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অবহেলায় জাতীয় কংগ্রেস এর মূল শক্তি বহুদিন তৃণমূলে চলে গেছে। মুর্শিদাবাদ, মালদা, রায়গঞ্জ, পুরুলিয়ায় যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট ছিল তাকে হাই কমান্ড কোন সাহায্য করেনি। বরং তাদের বেশি উৎসাহ ছিল মমতা দেবীকে ধরে ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা।
মরিচঝাপি থেকে নন্দীগ্রাম তার অতীতের কলঙ্কিত কার্যকলাপ, ভুল নীতি, নির্জলা সুবিধাবাদ, উপযুক্ত উদ্যোগের অভাব এবং কলঙ্কিত নেতাদের এখনও শীর্ষে রেখে দেওয়ায় মানুষ বামদের পছন্দ করছেন না। কিছু তরুণ তরুণীকে এগিয়ে দিলেও (অদ্ভুত যুক্তিতে সবচাইতে জনপ্রিয় মুখ মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় কে প্রার্থী করা হলো না, আবার পুরোনো নেতা রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম কে মুসলিম এলাকায় প্রার্থী করা হলো) মানুষ তাদের সেভাবে গ্রহণ করে নি।
বিধানসভা ও পঞ্চায়েতে উদীয়মান লড়াকু আইএসএফ সম্ভবত তৃণমূলের সাথে কোন বোঝাপড়ায় এসে নিস্ক্রিয় হয়ে গেলো এবং তৃণমূলের ডায়মন্ড মডেল কে মান্যতা দিলো। এস ইউ সি, নকশাল রা দুর্বল হতে হতে আর বলার মত শক্তি নেই। আবার তাঁদের নিজেদের মধ্যে ন্যূনতম ঐক্যও নেই। তাঁদের বেশিরভাগ জায়গাতেই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
তথাপি তৃণমূলের এই জয় একেবারেই নিষ্কলুষ নয় যেহেতু নির্বাচন কমিশন ও আধা সামরিক বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় রেখে, গত পঞ্চায়েত ভোটের মত না হলেও, বহু জায়গায় সন্ত্রাস সৃষ্টি, কারচুপি, ছাপ্পা ভোট আর ভোট লুঠ এর ভুরিভুরি অভিযোগ রয়েছে। যে ডায়মন্ড মডেল কে জাতীয় রেকর্ড দেখানো হয়েছে সেখানকার আট লাখের বেশি ভোটের গল্প সংকলনের মধ্যে বহু জায়গায় ভোট দিতে না দেওয়া, পাড়ায় পাড়ায় সন্ত্রাস, ভোট কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট বসতে না দেওয়া, গণনা কেন্দ্র থেকে বিরোধী এজেন্ট দের মেরে বের করে দেওয়া ইত্যাদি অনেক ছোট ছোট গল্প আছে। আর সমস্তটাই পরিচালনা করা হয়েছে একটি সম্প্রদায়ের দুর্বৃত্ত বাহিনীকে দিয়ে।
যেরকম কংগ্রেস ও বামরা এতটা খারাপ ফল করতেন না যদি না মোদি এবং মমতা মিলে ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক প্রচার না করতেন। হিন্দুরা বিভক্ত তাই বিজেপির এর থেকে বিশেষ লাভ পায়নি, কিন্তু সামগ্রিক ভোটের প্রায় ৩০ – ৩৫ % মুসলিম ভোট একচেটিয়া তৃণমূলের দিকে গেছে। দক্ষিণবঙ্গ তে কিছুটা গেছে আই এস এফের ঝুলিতে। নইলে অধীর চৌধুরী বহরমপুর এ হারেন না। কংগ্রেস কেবল ১ টি আসন পেলো গণি খান চৌধুরীর পুরনো গড় দক্ষিণ মালদায় তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রর জেতার মাধ্যমে। অধীর চৌধুরী ও দিলীপ ঘোষের পরাজয়ের মাধ্যমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রধান দুই সমালোচক কে সরিয়ে পথ আরও সুগম করে ফেললেন।
পাশাপশি মনে রাখতে হবে নির্বাচনী বন্ড ও অন্যান্য সূত্র থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে তৃণমূল বিজেপির মতই সুবিধামত নির্বাচন পরিচালনা করেছে। কোন রকম বিহিত হয়নি নির্বাচন নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ রাখার, নির্বাচনী হিংসার, দুষ্কৃতী রাজের, অস্ত্র আমদানি ও বোমা তৈরির, নির্বাচনের আগে মধ্যে ও পরে বিরোধী দলের কর্মী, তাদের পরিবার এবং ঘরবাড়ি, দোকান ইত্যাদির উপর হামলার।
কেন্দ্র ও রাজ্যে কি হতে চলেছে: আপাতত পরপর তৃতীয়বার এনডিএ সরকার দিল্লির ক্ষমতায় বসতে চলেছে। নরেন্দ্র মোদি ৮ জুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন। তারপর তাঁর সঙ্গে চন্দ্রবাবু, নীতিশদের রসায়ন কি দাঁড়াবে কিংবা বিরোধীদের সঙ্গে কি আন্তক্রিয়া চলবে ভবিষ্যত বলবে। ২০২৫ এ আর এস এস এর শতবর্ষ অবধি এই সরকারকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা বিজেপির থাকবে, আর সেই সঙ্গে সঙ্গীদের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তাঁদের ধরে রাখার এবং লোভ দেখিয়ে ইন্ডিয়া জোটকে ভাঙার। মোদি ব্র্যান্ড কে জোরালো ধাক্কা দিতে পেরে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে ইন্ডিয়া জোট খুব খুশি। আপাতত তাঁরা সরকারের দাবি জানাচ্ছেন না। উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করবেন। তবে সেই উপযুক্ত সময়ে মমতা দেবী ও অন্য সঙ্গীরা কি করবেন কেউ বলতে পারেনা।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বলা যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর নেতৃত্বে তৃণমূলের ধারেকাছে কেউ নেই। আগামী ২০২৬ এর বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সম্ভবত আরেকটি বিপুল জয় সময়ের অপেক্ষা। এই দু বছরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় হয়তো বিজেপি ও কংগ্রেস কে আরও ভাঙবেন।
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমুল দল ৪২ টি আসনের মধ্যে ২৯ টি আসন পাওয়ায় এবং যুবরাজের ডায়মন্ড মডেল জাতীয় রেকর্ড করায় স্বভাবতই তৃণমূলের উপভোক্তা সাধারণ গরীব মানুষের একাংশ, শ্রমজীবী মুসলমান তফসিলি ও জনজাতি মানুষ খুশি। খুশি অনুগ্রহপুষ্ট তথাকথিত বিদ্বজ্জন ও বিপ্লবীরা। আরও খুশি এই জমানায় করে খাওয়া প্রমোটার, ঠিকাদার, ব্যাবসায়ী, দালাল, দুর্বৃত্ত, তোলাবাজ, দলদাস ও দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ – আমলা প্রমুখরা। কিন্তু বাদবাকি ও সাধারণ মানুষ খুবই আতঙ্কিত। তারা বুঝে গেছেন বিজেপি – তৃণমুল দলের বোঝাপড়ায় সারদা থেকে নিয়োগ, রেশন সর্বস্তরের দুর্নীতি ও পুকুর চুরির যেমন কোন কিনারা হলো না, আর হবেও না। ধরা পড়েন নি আর পড়বেনও না মূল অভিযুক্তরা। লুঠপাট, তোলাবাজি, নৈরাজ্য অব্যাহত থাকবে। মুখ থুবড়ে পড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ব্যবস্থা ওভাবেই চলতে থাকবে। সামান্য কিছু ডোল পাওয়া ছাড়া সাধারণ মানুষের কোন সুরাহা হবেনা। বন্ধ্যা কৃষি ও শিল্পের আবহে মানুষকে রোজগারের জন্যে অন্য রাজ্যে যেতে হবে।
সুন্দরবন ও উপকূলবর্তী অঞ্চল কিংবা মালদা ও মুর্শিদাবাদের ভাঙন অব্যাহত থাকবে। অব্যহত থাকবে সীমান্ত থেকে দ্রব্য গরু মানুষ পাছার, অবৈধ বালি – কয়লা পাচার, বেআইনি বহুতল ইটভাটা ভেড়ি ইত্যাদি নির্মাণ এবং পরিবেশ দূষণ।
যে ছেলেমেয়ে গুলো রাস্তায় থেকে এতদিন আন্দোলন করছে তাদের কোন হিললে হবে না। সরকারি কর্মচারীরা বকেয়া ডিএ পাবেন না। মাফিয়া, সন্ত্রাসী, জেহাদী, মৌলবাদী, একটি সম্প্রদায়ের দুর্বৃত্তদের জুলুম, আক্রমণ ও অত্যাচার, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এবং সীমান্তবর্তী জেলা গুলিতে, চলতেই থাকবে। পুলিশ প্রশাসন কিছু করবে না, এমনকি কোন অভিযোগ পর্যন্ত নেবেনা। অভিযোগ করলে পুলিশ উলটে তাদের দোসর সমাজবিরোধীদের জানিয়ে দেবে, ভোগান্তি আরও অনেকগুণ বাড়বে।
সম্প্রতি ভাগের ঝগড়ায় সীমান্তের ওপারের যে কুখ্যাত নেতা, সাংসদ, মাফিয়া ডন, খুনী, সন্ত্রাসী, ভারতে চোরা কারবারের পান্ডা নিউ টাউনের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে খুন হলেন সেরকমই সীমান্তের এপারে এই সব অন্ধকার জগতের শিরোমণিরাই বর্তমানে সমাজ জীবন, রাজনীতি, পুলিশ – প্রশাসন, নির্বাচন ইত্যাদি সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছেন। এদের রয়েছে বিপুল অর্থ, ক্ষমতা এবং পেশি ও অর্থের জোর। এদের করুণায় এখন সাধারণের জীবন।
০৫.০৬.২০২৪