“All that live must die”.
“Every flesh is grass”.
আমরা সবাই তা জানি। তবু আমরা বাঁচতে চাই। সুস্থভাবে বাঁচতে চাই।
দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য তার মেয়ে দেবযানীর কান্নাকাটিতে জামাই যযাতিকে অভিশাপ দিয়েছেন যে যৌবনের তাড়নায় তিনি তাঁর মেয়ের সাথে প্রতারণা করে অন্য নারীর (শর্মিষ্ঠা) সাথে সহবাস করেছেন তাই তাঁর দেহে অকালেই বার্ধক্য দেখা দেবে।
যযাতিকে আপনারা সকলেই চেনেন। ইনি চন্দ্রবংশের এক বিখ্যাত রাজা। পরে আমরা দেখব তাঁর বংশধারা থেকেই কালক্রমে কুরু ও পান্ডবদের সৃষ্টি হবে। যযাতি শ্বশুরের এমন অভিশাপে বেজায় বিষন্ন হয়ে পড়লেন। তিনি শুক্রাচার্যের কাছে কাকুতিমিনতি করতে থাকলেন যেমন করে হোক এই অভিশাপ তিনি ফিরিয়ে নিন। শুক্রাচার্য বললেন, নিক্ষিপ্ত বাণ যেমন ফেরানো যায় না, অভিসম্পাতও তেমনি। তবে তিনি যেহেতু তাঁরই জামাই তাই মেয়ের কথা ভেবে তিনি বললেন, তাঁর পাঁচ পুত্রের মধ্যে কেউ যদি তাঁর বার্ধক্য নিজের দেহে ধারণ করে তবে তিনি জরামুক্ত হবেন।
যযাতি একে একে সকল পুত্রদের কাছে গেলেন। কিন্তু কেউ তাঁর বার্ধক্য নিজের দেহে গ্রহণ করল না। কেবলমাত্র তার ও শর্মিষ্ঠার কনিষ্ঠ পুত্র কুরু বাবার জরা গ্রহণ করতে চাইল। যযাতি কুরুকে আশীর্বাদ করলেন যে তাঁর মৃত্যুর পরে কুরুই তাঁর একমাত্র উত্তরসূরি হবে।
যযাতি জরামুক্ত হয়ে হাজার বছর ধরে অপার ভোগসুখে কাটিয়ে উপলব্ধি করলেন যে পার্থিব ভোগসুখ মানুষকে শান্তি দিতে পারে না। ইন্দ্রিয়সুখ ক্ষণিকের ভেজা কাঠের আগুন। জ্বলে উঠেই আবার নিভে যায়। তাই তিনি পুনরায় তাঁর জরা ধারণ করে পুত্র কুরুর হাতে রাজ্যভার দিয়ে পরলোকে যাত্রা করলেন।
যযাতি যে উপলব্ধি হাজার বছর ধরে ভোগসুখের পরে লাভ করেছিলেন কঠোপনিষদের বিস্ময়বালক নচিকেতা বাল্যেই তা জানতেন। যমরাজ যখন তাঁর সাধনায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে তিনটি বর দিতে চাইলেন তখন তিনি সেই অসম্ভব তৃতীয় বরটি চাইলেনঃ হে মৃত্যু (যমরাজ), তুমি আমাকে সেই জ্ঞান দাও যাতে আমি জানতে পারি মৃত্যুর পরে জীবের কী হয়? জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে কী আছে, হে মৃত্যু?
যমরাজ পড়লেন মহা ফাঁপড়ে। এই বালক বলে কী? অথচ তিনি প্রতিশ্রুত। বর দিতে তিনি বাধ্য। তিনি এবার নচিকেতাকে কথায় খেলাতে লাগলেন। প্রথমে বললেন, “তুমি এ কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করছ কেন? বহু প্রাজ্ঞ মানুষ এই প্রশ্নের উত্তর জানতে তাদের সারা জীবন সাধনায় ব্যয় করেছেন। এর সাধনা বড় কঠিন। তুমি এত সহজে জানবে কিভাবে”?
নচিকেতা ছাড়ার পাত্র নয়। “হে মৃত্যু, আমি এত কঠিন রাস্তা অতিক্রম করে এখানে এসেছি শুধু এই প্রশ্নের উত্তর পেতে, এত সহজে আমি এর উত্তর না পেয়ে ফিরে যাব না”।
যমরাজ এরপর তাকে লোভ দেখালেন। তাকে বললেন, “তুমি দীর্ঘজীবন লাভ করবে। সহস্র বছর জরাহীন হয়ে পৃথিবীতে বাস করবে। অনেক সুন্দর সুস্থ সন্তানের জনক হবে তুমি। তোমার গোশালায় গাভী, অশ্বশালা ও হস্তীশালায় অগণিত অশ্ব ও হস্তী থাকবে। পৃথিবীর যত ভূমি চাও তা তোমার অধিকারে আসবে। চিরযৌবনা অপ্সরারা চিরকাল তোমার সঙ্গে থাকবে। পার্থিব ভোগসুখে তুমি আকন্ঠ নিমজ্জিত থাকবে আমার বরে। কিন্তু দয়া করে তুমি তোমার আগের প্রার্থনা ফিরিয়ে নাও”।
বালক বললেন, “হে মৃত্যু। তুমি আমাকে যা দিতে চাইছ তা আশীর্বাদ নয় অভিশাপ। তুমি কি ভেবেছ, আমি বালক হতে পারি কিন্তু ভেবো না যে জাগতিক ব্যাপারে আমি অন্ধ। হাজার বছর ধরে ভোগসুখে নিমজ্জিত থেকে মানুষের কী হাল হয় তা আমি জানি না ভেবেছ? তারা সারাজীবন ভোগে নিমজ্জিত থেকে কখনই জীবনের সার্থকতা লাভ করে না। তাদের হাল হয় ফাঁপা সীসার মত। আর এত সবের পরও কি শেষে তুমি আমাকে নিতে আসবে না বল”?
এই জীবন-মৃত্যুর পারাবার তাই এক চিরকালীন এনিগমা। ঔপনিষদিক ঋষিরাও যার অন্বেষণে নিরন্তর আত্মবিশ্লেষন করে গেছেন তো আমি আপনি কোন ছাড়? দেবা না জানন্তি কুতো মনুষ্যা? মৃত্যুর পরে কি হয় তা না হয় জানলাম না কিন্তু দীর্ঘজীবন? তা কি চাই? কেমনভাবে তাকে পাব? এই প্রশ্নও কম কূট নয়।
ছবিতে যে ভদ্রলোককে দেখছেন তার বয়স ৮৯। হেঁটে আমাকে দেখাতে আসেন। শুধু আমার কাছে নয়, বাজার-হাট বলুন, ব্যাঙ্ক বা পোস্ট অফিস, গঙ্গা বা আশ্রম, বাসস্ট্যান্ড বা রেলস্টেশন সবখানে তিনি এখনও হেঁটেই যান। ষাট বছরে রিটায়ার করার পরে অষ্টাশি অব্দি প্রতিদিন সকালে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা হেঁটে গঙ্গাস্নানে যেতেন। কয়েক মাস আগে একটা টোটোর ধাক্কায় আহত হবার পর প্রতিদিন গঙ্গাস্নান বন্ধ রেখেছেন কিন্তু তাঁর হাঁটা থামে নি।
সামান্য কিছু ওষুধ খান। যার মধ্যে একটি প্রেশারের জন্য, একটি প্রস্টেটের ও একটি কোলেস্টেরলের। ব্যাস। নো ঘুম, নো গ্যাসের ওষুধ। আজ পর্যন্ত কোনোদিন এই পনের বছরে আমার কাছে গ্যাসের ওষুধ বা ঘুমের ওষুধ চান নি। মৃদু হাসি তাঁর মুখে সবসময় লেগে থাকে। গলায় তুলসির মালা। কোনো বিরক্তি নেই। দু-ঘন্টা বসে থেকেও কোনোদিন আমাকে দেখিয়ে গেছেন। কোনো অভিযোগ করেন নি।
মানুষটির পারিবারিক জীবন কেমন? স্ত্রী মারা গেছেন অনেকদিন। এক ছেলে। প্রায় কিছুই করে না। শিল্পী মানুষ। গান গাইত। নানান অনুষ্ঠানে। আজকাল আর অনুষ্ঠান কোথায় হয়? লক ডাউনে যা কিছু উপার্জন হত তাও বন্ধ। যে পুরুষের আয় নেই বউও তার সঙ্গে থাকে না। অবধারিতভাবে বউ ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে।
অথচ একদিন তাঁর ছেলের বউ, নাতিকে দেখাতেই এই মানুষটি আমার চেম্বারে বেশি আসতেন। সেদিন এসে দুঃখ করে বললেন, “ডাক্তারবাবু আমার ছেলে সাত বছর বয়সে গান গাওয়ার জন্য রেডিওতে সুযোগ পেয়েছিল। ভালো গুরু ঠিক করে দিয়েছিলাম। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ওর পেশাটাই হারিয়ে গেছে”। এই পনের বছরে প্রথম আমি ওনার মুখে ছেলের প্রশংসা শুনলাম।
“বউমা চলে গেল নাতিকে নিয়ে। আমার যা জায়গা ছিল প্রোমোটারকে বিক্রি করে দিয়েছি। অর্ধেক টাকা নাতিকে দিয়েছি অর্ধেক ছেলেকে। আমার পেনশনের টাকায় আমার নিজের চলে। যত বাঁচব তত পেনশন বাড়বে। আজ যত টাকা পেনশন পাই রিটায়ার করার সময় অত টাকা বেতন পেতাম না”।
“বড় মায়া ডাক্তারবাবু। জীবনে বড় মায়া। বড় বাঁচতে ইচ্ছে হয়। আমার মা মারা গেছিলেন ১০৩ বছর বয়সে। আমি ৮৯। আরও পনের বছর বাঁচতে চাই। তাহলে মাকে পার করে যাব”।
“আমিও চাই আপনি শতায়ু হোন”।
আজ অব্দি এই কয় বছরে আমার মাত্র একজন রুগি একশ বছর পার করেছিলেন। ইনি পারলে দ্বিতীয় হবেন। তবে আমার বিশ্বাস উনি পারবেন। উনি মোটের ওপর সুস্থই। সংসারের বিরাট চাপ রাখেন বলে মনেও হয় না কারণ তিনি সমস্যার কোনো না কোনো সমাধান বের করে ফেলেন।
“দাদা, আমি কিভাবে আপনার মত দীর্ঘজীবন পাব”?
“হাঁটুন, ডাক্তারবাবু হাঁটুন। হাঁটেন তো? হাঁটার কোনো বিকল্প নেই”।
উনি আমাকে গান্ধীজীর মত কথা বললেন। একজন একবার গান্ধীজীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আপনার এই বয়সে এত সক্ষমতার রহস্য কী”?
উনি নাকি বলেছিলেন, “আমি তো কোনো শরীরচর্চা কখনও করি নি। তবে আমি প্রচুর হেঁটেছি। সারাজীবন ধরে কেবল হেঁটেই গেছি”।
আমার এই বৃদ্ধ রুগির কথাতেও সেই সুর শুনতে পেলাম।
উনি চলে গেলেন। কিন্তু ওনার সেই কথা আমার চেম্বারের চারিদিকে বাজতে থাকল।
“বড় মায়া ডাক্তারবাবু। জীবনে বড় মায়া”।
এখনও মায়া? সার্থক জীবন তিনি তো পান নি। ব্যর্থ সন্তান। ছেলে বউয়ের অশান্তি। তারপর বিচ্ছেদ। নিজের টাকাতেই দু-দিকের সংসারকে টেনে যাওয়া। তারপরও এত মায়া? কোনো অবসাদ নেই। অন্তত প্রকাশটুকু তো নেই। মুখে স্মিত হাসি। কিছুটা আধ্যাত্মিকতা কিছুটা ধীশক্তি- এই দিয়ে ৮৯ বছর পার করে ফেলেছেন। আরও পনের বছর বাঁচতে চান। হেঁটে হেঁটেই আরও পনের বছর বাঁচতে চান।
উনি শতায়ু হোন। তবে কখনও ভাবি মানুষের এই জীবনীশক্তির রহস্য কী? নচিকেতা যমরাজের কাছে দ্বিতীয় বর চেয়েছেনঃ হে মৃত্যু, আমি জ্ঞানী মানুষদের কাছে শুনেছি এমন এক সাধনা আছে যা লাভ করলে মানুষ জীবনের, সময়ের আঘাত থেকে, ক্ষয় থেকে মুক্ত হতে পারে। তার দেহে মনে এক চিরন্তন ‘প্রাণ’ বিরাজ করে। তুমি আমাকে সেই প্রাণশক্তি লাভের পথ দেখিয়ে দাও”।
এই সেই ‘প্রাণ’ যা আমাদের কবিও চেয়েছেন। দেবব্রত বিশ্বাসের দরাজ গলায় যতবার শুনি ততবার আমার নচিকেতার বরের কথা মনে হয়। প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে/ মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ। এই প্রাণের প্রাচুর্য মানুষটির মধ্যে অটুট। আমি তাঁর চিকিৎসক হতে পারি কিন্তু আমি ওনার শিষ্য হতে রাজি। আমি জানতে চাই ওনার এই প্রাণের উৎস কী? কিসের প্রাণে জীবনের দুকূল ছাপিয়ে গেলে জাগতিক দুঃখকে তুচ্ছ বলে মনে হয়? মায়াই বা কী? তা কি বার্ধক্যের সাথে সাথে বাড়ে? মায়া কি প্রাণকে নিয়ন্ত্রণ করে?
আমি জানি না কিন্তু জানতে চাই। আমার বড়জ্যেঠু মারা গেছেন নব্বই পার করে। আমার ফুলজ্যেঠু বিরাশি পার করে এখনও আমার চেয়ে বেশি সক্ষম। জানি যতদিন এ জীবন ততদিন আঘাতের গ্রাস। তবুও ডাক্তার হিসেবে এই বৃদ্ধ মানুষটি আমার প্রেরণা।
আমি চাই উনি শতায়ু হোন।
Bah!