করতে বলা হয়েছে স্মৃতিচারণ। কী শোনাব? এক ব্যতিক্রমী ব্যথা বিশারদের কাহিনি? না কি এক নিকট বন্ধুর চেনা-অচেনা গল্প? এক বুদ্ধিদীপ্ত, সাহসী, নিঃস্বার্থ মানুষের যাপনগাথা? নাকি এক হুল্লোড়বাজ, নাট্যমোদী, সঙ্গীতপ্রেমী ভদ্রলোকের অনাবশ্যকভাবে সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত? হারিয়ে ফেলার দিনে তাকে ঘিরে কিছু লিখে ফেলেছিলাম স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের তোড়ে। আজ চার দিন পরে নিজেদের পত্রিকা স্বাস্থ্যের বৃত্তে-র জন্য আবার লিখতে বসে যে ভাষার জোগান আসছে না। মন যে এখনও নিথর। হাত এখনও অবশ। ডাক্তার হিসাবে কাছ থেকে মৃত্যু দেখতে আমরা অভ্যস্ত। আবার আমরা এটাও বিশ্বাস করি যে “সব মরণ নয় সমান”।
গুপ্তিপাড়া থেকে মহানগর। দীর্ঘ সফর। এক বর্ণময় যাত্রাপথ। এক মনোময় জীবন। যে জীবন পালটে দেয় প্রচলিত ধারণা। পরিচিতের কাছে এখন মন দিয়ে ভালোবাসার অপর নাম সুব্রত। জান লড়িয়ে ভালো কাজ করার অপর নাম সুব্রত। অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার অপর নাম সুব্রত।
মফস্সলের মেধাবী সন্তান। বিরাশি সালে প্রবেশ ঐতিহ্যশালী কলকাতা মেডিকেল কলেজে। তারপর প্রথম কিছুদিন একটু স-সংকোচ আনাগোনা। কিন্তু তারপর থেকেই শুরু দৃপ্ত বলিষ্ঠ পদচারণা। ডাক্তারি পড়াশুনাটা করলেন ভালোবেসে তবে কেরিয়ার গড়ার চেনা কক্ষপথ থেকে বেরিয়ে হাঁটলেন স্বকীয় পথে। পাথেয় সত্যিকারের মানবিক মুখ। একটু রোমান্টিক শোনালেও বলব চলার পথে ছোঁয়া হল অসংখ্য মাইলফলক। জয় হল একাধিক শৃঙ্গ। তার চেয়েও বেশি জয় হল মানুষের মন।
রাজনৈতিক হোক বা সামাজিক, মূল্যবোধ ও আদর্শের প্রশ্নে শিরদাঁড়া সোজা রেখে লড়াই চালিয়ে গেলেন সারাটা জীবন। আশৈশব বামপন্থী আবহে বেড়ে উঠে কলেজ জীবনের শুরু থেকেই জুড়ে গেলেন স্বাধীন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠন এমসিডিএসএ-এর সঙ্গে। সাধারণ সদস্য থেকে সংগঠনের সবচেয়ে চেনা মুখ হতে সময় লাগল না বেশি। পূর্বসূরিদের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলা যায় পরবর্তী প্রজন্ম পেলেন শক্ত বুনিয়াদে গড়া আরও স্বচ্ছ, স্বাধীনচেতা এবং অধিকতর গণতান্ত্রিক এক ছাত্র সংগঠন। প্রতিষ্ঠিত হল এক উন্নত সমাজভাবনার অনুষঙ্গ। তবে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে সুব্রতকে দেখতে গেলে উঠতে হয় পন্থার ঊর্ধ্বে। বাম-ডান নয়। দল নয়। দিল দিয়ে চিনতে হয় এ মানুষকে।
প্রথমে চেয়েছিলেন গ্রামের মানুষের উপযুক্ত ডাক্তার হতে। সেখানে বিশেষজ্ঞের চেয়েও বেশি দরকার এমন চিকিৎসকের যিনি আটপৌরে রোগবালাই তো বটেই ছোটো মাঝারি সার্জারি বা অর্থোপেডিক সমস্যাদি সামলে দেবেন। কয়েক বছর ধরে নিজেকে তৈরিও করেছিলেন সেভাবেই। কিন্তু বাদ সাধল বাস্তবিক পরিস্থিতি। পেশা মোড় নিল অ্যানাস্থেটিসট বা অজ্ঞান করার ডাক্তারবাবু হিসাবে, যার পূর্ণতা প্রাপ্তি হল ব্যথা বিশারদে।
শিক্ষা জগতে যেকোনো নতুন শাখার বিস্তার ঘটানোই যথেষ্ট কঠিন কাজ। চিকিৎসা বিজ্ঞানেও তাই। পূর্ব ভারতে আলাদা করে ব্যথা নিরাময় শাখার প্রসারের প্রয়োজন ছিল। যে হাসপাতালে মূলত নিম্ন মধ্যবিত্তদের চিকিৎসা হয় সেখানে ব্যথা প্রশমন নিয়ে স্বতন্ত্র শাখার প্রবর্তন ছিল দিবাস্বপ্নের নামান্তর। সুব্রত সেটাই করে দেখালেন। পরিণতিতে শহরে জন্ম নিল একটা নতুন থিম। ব্যথা উপশমের থিম। যুগপৎ রোগের অবস্থান ছাড়াও যে মানুষের ব্যথা হতে পারে এবং তার উপযুক্ত চিকিৎসার প্রয়োজন তা স্বীকৃতি পেল সুব্রতর হাত ধরে। হার্টের অসুখ, স্নায়ুর অসুখ ইত্যাদি অঙ্গভিত্তিক চিকিৎসার চেনা ছক ভেঙে স্বীকৃতি পেল রোগীর অপ্রীতিকর অনুভূতি। চালু হল ব্যথা উপশম বা ‘অবেদন’ শাখার। উদ্বোধনের দিনটা ছিল ২০১৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ শিক্ষক দিবস। আজীবন সুব্রতর সংস্পর্শে আসা সব সহকর্মী, অনুজ এবং অগ্রজ সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করেন তাঁর সহজাত শিক্ষাদানের ক্ষমতা। এক পরিচিত শিক্ষক বন্ধুর মতে সুব্রত শুধু শিক্ষক ছিলেন না। ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ আচার্য। শিয়ালদা ইএসআই হাসপাতালের পেইন ইনস্টিটিউটে তিনিই ছিলেন একলব্য। তিনিই ছিলেন দ্রোণাচার্য।
অনেকক্ষণ বিধিবৎ উপস্থাপনায়, নামে এবং ‘আপনি’ সম্বোধনে থেকেছি। এবার একটু একান্ত এক কাছের মানুষের গল্প শোনাই যাকে আমরা আদর করে ‘টাকো’ বলে ডাকতাম। দাদা বললেও চলত। না বললেও কিছু এসে যেত না। এককথায় সে ছিল বন্ধুদের নয়নের মণি। যার বন্ধুত্বের রেসিপি ছিল নিখাদ ভালোবাসা আর অনাবিল আন্তরিকতা। মেডিকেল কলেজে হস্টেলের আবাসিকরা তো বটেই, সমসাময়িক সব ছাত্র-ছাত্রীদের বিপদে আপদে সে ঝাঁপিয়ে পড়ত অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে। অনেকে তাকে বোকা বলেছেন কিন্তু থামানো যায়নি। কী করা যাবে, ওটাই যে ছিল ওর স্বভাব। হয়তো বিপুলা এ পৃথিবীর কাছে ও বিরাট কিছু নয় কিন্তু কারও কারও কাছে ও সমগ্র পৃথিবী। যেমন স্ত্রী, কন্যা, মাতা, পিতা (স্বর্গত)। শত ব্যস্ততাতেও তাঁরা থেকেছেন সবার আগে।
ছাত্রাবস্থায় আমরা নিজেদের বাবা-মা-আত্মীয়-পরিজনদের অসুখবিসুখ হলে ভর্তি করাতাম মেডিকেল কলেজেই। সেবার এক বন্ধুর বাবা মেডিকেলে জায়গা পেলেন না। ভর্তি হলেন পিজি-তে। মেসোমশায়ের পরিস্থিতি খুব খারাপ। বেডের পাশে যে কোনো একজনের থাকার অনুমতি এল। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে থেকে পড়ল টাকো। বন্ধুপিতাকে সেবার বাঁচানো যায়নি। তবে টাকো কিন্তু সেখানে থেমে থাকেনি। তাঁকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া, পরিবারের সবার দেখ-ভাল করা এবং তারপর পিতৃহীন বন্ধুকে দীর্ঘদিন ধরে সান্ত্বনা দেওয়া সব কিছু করে গেল টাকো।এ তো গেল মাত্র একটা ঘটনা। এরকম অজস্র অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে রয়েছে বন্ধুদের মনে। প্রায় সবক্ষেত্রেই মুখ্য চরিত্র সেই টাকো। স্বভাবতই তার অসুস্থতার খবরে ভেঙে পড়েন পরিচিত চিকিৎসকবর্গ এবং আপামর বন্ধুবান্ধব।
সার্বিকভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো ও অপেক্ষাকৃত দুর্বলকে ওপরে টেনে তোলা ছিল ওর চারিত্রিক স্বভাব। হাসপাতালে কাজের সময় বছরের পর বছর আমাদের রোজ চা খাইয়ে যান কিছু মানুষ। ক-জন আমরা ভাবি তাদের অবস্থার উন্নতির কথা। টাকো ভাবত। আর সে জন্যই সে একজন সামান্য টি-বয়-কে হাসপাতালের ওটি বয়-এ পরিণত করতে পারত। ওর বাড়িতে যারাই কাজ করতে আসতেন তাঁদের প্রত্যেককেই ও লেখাপড়া শেখাত।
শহরে থিতু হয়ে যাবার পরও নিয়মিত গ্রামে গিয়ে গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা করে আসা সহজ কাজ নয়। খরা, বন্যা, ঝড়ঝঞ্ঝার পর শুধু নয়। দীর্ঘ সময় ধরে টাকো তাদের পাশে থেকেছে সারা বছর। উখড়া, পাণ্ডবেশ্বর, রাজনগর, সুন্দরবন, গিধনি, ঝাড়গ্রাম, বেলপাহাড়ি, বেলিয়াতোড়, চেঙ্গাইলের মানুষগুলো তার সাক্ষী। আর তাই ৫ জুলাই সন্ধ্যেয় যখন নিমতলা মহাশ্মশানে আমরা তাকে হাওয়ায় মিলিয়ে দিচ্ছি বড়োজোড়ায় চাষিভাইরা তখন টিমটিমে আলোয় এক আটচালায় বসে নিজেদের মতো করে তাঁদের প্রিয় ডাক্তারবাবুকে শেষ বিদায় জানাচ্ছেন।
এক অদ্ভুত আদুরে দুষ্টুমি ছিল আমাদের বন্ধুটার মধ্যে। এখানেও অসংখ্য নজির। তা সে আশির দশকে বাংলা বন্ধের দিনে বিনা আমন্ত্রণে কলেজ স্ট্রিট থেকে হাওড়া অব্দি হেঁটে গিয়ে বন্ধুর কাকার মেয়ের বিয়েতে সবান্ধব চেটেপুটে খেয়ে চলে আসাই হোক বা রেডিয়ো পিকিং-এর মতো করে চীনা ভাষার অনুকরণে খবর পড়া। কোনোটাই যে ক্ষতিকারক ছিল তা একেবারে নয়। একবার তো বৌবাজার মোড়ে এক ট্রাফিক সার্জেন্ট এই মারে তো সেই মারে! অপরাধ? পুলিশের হাতের ওয়াকিটকিটাকে নাকি ওর পকেট রেডিয়ো মনে হয়েছিল এবং সেখানে ও ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের স্কোর জানতে চেয়েছিল!
সীমাবদ্ধতা কি ছিল না? অবশ্যই ছিল। কোনো সাহায্য প্রার্থীকে ও ফেরাতে পারত না। না বলতে পারাটা ওর কাছে ছিল বড়ো কঠিন। হাতে নিয়ে ফেলত হাজারো কাজ। ছিল বেহিসাবি। ছিল স্বপ্নবিলাসী। ছাত্রাবস্থায় কিছু টিউশনি করে যে টাকা পেত তাতে হস্টেল মেসের বকেয়া মেটানোর আগে কিনে ফেলত বব মারলের ক্যাসেট।
আসলে টাকো ছিল একটা কমপ্লিট প্যাকেজ। যার অসংখ্য গুণের মধ্যে একটা ভালো মানুষ সবার আগে বেরিয়ে আসে যাকে আপনি ভালোবাসতে বাধ্য। বিষাদহীন জীবনের রেসিপি খুঁজতে হলে আপনাকে তাকাতে হবে ওর দিকে। জীবনে ভালোমন্দ চাওয়া পাওয়ার জটিল হিসাবে না গিয়ে মন প্রাণ ঢেলে কাজ করলে যে সাফল্য আসতে বাধ্য টাকো সেটা করে দেখিয়ে দিয়েছে। যেকোনো পরিস্থিতির পজিটিভ সাইডটা ও দেখতে পেত। দূরারোগ্য ব্যাধিতে যখন সর্বাঙ্গ শিথিল সেই অবস্থাতেও ও না পারার তালিকা দীর্ঘায়িত করতে চাইত না। হুইল চেয়ারে বসে থাকার ক্লান্তি উপেক্ষা করে ও ভাবতে পারত অক্ষত অটুট অনুভূতিগুলোর কথা। শারীরিক দৌর্বল্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নাকি ওর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আরও ধারালো হয়েছিল। প্রকৃতির অমোঘ সৌন্দর্য ও নাকি তখন আরও বেশি করে দেখার সময় পেত!
অকাল প্রয়াণে কি আমাদের সঙ্গে তাঁর চিরস্থায়ী বিচ্ছেদ সাধিত হয়েছে? একেবারেই নয়। চলে যাওয়া মানে তো হারিয়ে যাওয়া নয়। দৈনন্দিনতার ঊর্ধ্বে উঠে ওর শারীরিক অনুপস্থিতি যেন ওর সদাহাস্যময় মুখটাকে আরও বেশি প্রত্যয়িত করে। একদিকে ওর জীবন থেকে আমরা পরিশ্রম, সীমা, সংযম, ত্যাগের শিক্ষা পাই। অন্যদিকে পাই অসীম তথা অনন্তের অন্বেষণের রসদ। কর্কশতা তো দূরের কথা সুব্রতর ব্যক্তিত্বে ছিল কোমলতার আভাস, সুন্দরের সাধনা, সুরের ছোঁয়া। ব্যথা প্রশমনসহ জীবন জুড়ে সমস্ত কর্মযজ্ঞে আমার পাই সেই সুর ফেরানোর প্রতিশ্রুতি। প্রতিশ্রুতি জীবনের। প্রতিশ্রুতি ভালোবাসার।
Wonderful write up…I was his one year junior….in the same school…
His two Brothers are well known to me also…
Six years back I met him at Guwahati Airport…
Had small discussion…
He was my face book friend…used to read his ach always…
Sir truly depicted his Charector…
I was also helped by him at Medical College for my Elder Sister’s admission.
He has helped….many many in needs…
But again I am amazed & spellbound at your writing….Superb…
My Regards for you….
Thank you…so much..
Shyamal Ganguly
Guptipara,Telipara.
Now in Kolkata.