ক্লাস টেনের টেস্ট। ইতিহাস পরীক্ষা। বাংলা মিডিয়াম স্কুল।
কোশ্চেন পেপার দেওয়া হয়ে গেছে।
আগেই হেডস্যারকে লোকাল এমএলএ নির্দেশ দিয়ে গেছেন। টেস্টে একজনকেও আটকানো যাবে না। তাই সবার মধ্যেই একটা গা ছাড়া ভাব। গার্ড দিতেও স্যারেরা কেউ আসেননি। সেই কাজটা করছে দপ্তরি হরিপদ, দারোয়ান আর মালি।
ইতিহাসের স্যার কোশ্চেন সেট করেছেন। হলে শুধু তাঁর থাকার কথা। কিন্তু তিনি ট্রেন অবরোধে আটকে পড়েছেন দু স্টেশন আগে। ফোনে জানিয়েছেন, আসবেন। তবে দেরিতে।
চারটে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। প্রথম তিনটে বড় প্রশ্ন। পঁচিশ নম্বরের। শেষেরটা টীকা লিখ। পাঁচটা শর্ট নোট। ওগুলো শেষ ঘন্টায় হল কালেকশনের ভরসায় রেখে সবাই প্রথম তিনটে লং কোশ্চেন লিখতে শুরু করল।
প্রথম প্রশ্ন, কবরের রাজত্বে শান্তির প্রাচুর্য, কথাটি ব্যাখ্যা করো।
এই প্রশ্নটায় একটু থমকে গেছে ছাত্ররা। শুধু কবরের শান্তিই বললে হবে? না কি শ্মশানের কথাও বলতে হবে? শ্মশানের শান্তি বলে একটা কথা ইদানীং চলছে খুব। সেই রকমের কোনও গোলমেলে ব্যাপার? ঠিক হ্যায়। তাইই সই।
কিন্তু অনেককটা প্রাণ হানি… জখম… ডেঙ্গি… উন্নয়ন এই সব যোগ করেও কবর আর শ্মশান ভরে গেল। কিন্তু খাতার মাত্র এক পাতা ভরল না। স্যার পঁচিশ নম্বরে কত দেবে কে জানে! ইতিহাসের উত্তরের নিয়ম হল পঁচিশ নম্বরে মিনিমাম আড়াই পাতা।
অবশ্য এর পরের প্রশ্নটার উত্তর চুটিয়ে লিখেছে সবাই। পাতার পর পাতা। এক্সট্রা পাতা নিয়েছে কেউ কেউ। সহজ প্রশ্ন, কিন্তু লিখতে হচ্ছে অনেক। প্রচুর পয়েন্ট। কয়লা, গোরু, বালি, পাথর, চাকরি আরও কত কী। যারা আরও বুদ্ধিমান, রোল এক থেকে দশ, তারা অতিরিক্ত পয়েন্ট যোগ করেছে। সিণ্ডিকেট, প্রোমোটারি, চাল, ত্রিপল, মিড ডে মিল, বাড়ি বানানো সব কিছু। এত লিখেও কিন্তু বেশি নম্বর পাওয়া যাবে না কারণ এই প্রশ্নের নম্বরও পঁচিশ। প্রশ্ন এসেছে চৌর্য সাম্রাজ্য বিস্তারের সম্পূর্ণ বিবরণ দাও।
এর পরের প্রশ্নটা দেখে কো-এড স্কুলের ছাত্রছাত্রী সবাই গোপনে উত্তেজিত। কেউ কেউ সন্দেহ করছে এটা আসলে জীবন বিজ্ঞানের প্রশ্ন। লাইফ সায়েন্সের পুরো সিলেবাস শেষ হয়নি। সেখানে জীবন শৈলীর এই প্রশ্ন থাকলেও থাকতে পারে। শেষের দিকে যাদের রোল নাম্বার তারা এটার উত্তর লিখল চুটিয়ে। ইতিহাসের প্রশ্ন বলে রেয়াত করল না। যে যার নিজের নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারস্যাপার, পরের মুখে শোনা যা কিছু জ্ঞান, স্বপ্নাদ্য অভিজ্ঞতা সব উজাড় করে দিল এই প্রশ্নে।
দ্বিতীয় ঘণ্টার বেল পড়ল। তার কিছু পরেই অবরোধ-মুক্ত স্যার এসে পৌঁছোলেন। এলেন বেশ হাসিখুশি। হাঁপাচ্ছেন যদিও। ছাত্ররা তাঁকে ঢুকতে দেখে থেকেই গুঞ্জন শুরু করেছে। গুঞ্জন বেশ জোরেই। মোটেই মৃদু নয়। ছাত্রীরা তির্যক দৃষ্টিতে কেউ কেউ রোষ কষায়িত, কেউ বা দুষ্টু মিষ্টি হাসি দিয়ে স্যারকে অবলোকন করছে। এত কটাক্ষ দেখে স্যার অবাক।
একটু জলটল খেয়ে ধাতস্থ হয়ে চেয়ারে বসে ধীরে সুস্থে কোশ্চেন পেপার পড়তে গিয়ে তাঁর আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেল।
আসলে প্রেসে গিয়ে প্রুফ দেখার কথা তাঁরই। কিন্তু সেদিন মাসতুতো শালী সপরিবারে বাড়িতে আসায় তিনি স্কুলের সুইপার ভজনকে হাতে গোটা তিরিশ টাকা ধরিয়ে প্রেসে পাঠিয়েছিলেন। — যা তো বাবা, ছাপতে গিয়ে কোনও বানানভুল করল কিনা একটু দেখে আয়।
সে ফিরে এসে রিপোর্টও দিয়েছিল, — না স্যার, দেখে দিয়েছি। কোন্নো বানাম ভুল নেইকো। ঝকঝকে স্টেনলেস ইস্টিলের থালার মত চকচকে।
ইতিহাস স্যার দেখছেন, না, সত্যিই একটাও ‘বানানভুল’ নেই কোশ্চেন পেপারে। শুধু প্রথম তিনটে প্রশ্নের দুএকটা অক্ষর বাদ পড়ে গেছে নইলে অক্ষর বদল ঘটেছে। প্রথম প্রশ্ন ছিল আকবরের রাজত্বে শান্তির প্রাচুর্য। ‘আ’ অক্ষরটা গায়েব হয়েছে।
সেকেন্ড কোশ্চেনে মৌর্যসাম্রাজ্যের ‘ম’য়ের বদলে ‘চ’ ছাপা হয়ে চৌর্য হয়ে গেছে।
আর তৃতীয় প্রশ্ন ছিল, কলিঙ্গের উত্থান ও পতনের কারণ সবিস্তারে বর্ণনা কর। ‘ক’ অক্ষরটা বাদ পড়ে ইতিহাস তৈরি করেছে। ইতিহাসে ফেল ভজন সুইপারের বানান জানা ছিল। ইতিহাস জানা ছিল না।
হেড স্যার সব শুনে বললেন, — যা হয়েছে… হয়েছে। ভয় নেই। ডিপার্টমেন্টের মাথাগুলো সব প্রেসিডেন্সিতে। বাকিগুলোও গেল বলে। শুধু একটাই… ছেলেমেয়েগুলো এক ধাক্কায় একটু বেশি পেকে গেল, এই যা!