বছর দুই আগে| আমার মায়ের বাড়ির পাশেই থাকত দুটো মিষ্টি-মস্তি বাচ্চা| মিষ্টি-মস্তি মানে —যেমন ফুলের মত দেখতে তাদের তেমনি শস্যশ্যামল তাদের মন| দিনের সবসময়ই আনন্দের চাষাবাদ সে মনে| ভাইবোন , দুটোই সদা ফুটছে মৌজ উল্লাসে| কতবার দেখেছি বাবার সাথে সাইকেলে ঝুলে আছে, দুজনে দুপাশ থেকে| একই স্টাইলে দুজনের ইজের নেমেছে দুহাঁটুতে| কখনো সিম্পল বাঁদর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বাগানের লতানে গাছের গোড়ায়| চোখেমুখে প্ল্যান লতায় চড়বে| ডগায় মারবে লাফ|
ভাইটা খুব ভালোবাসত আমায়| শুধু আমাকেই বা বলি কেন, আমাদের বাড়ির সবাইকেই সে ভালোবাসত| রিহার্সাল ফেরত ভারি ব্যাগ নিয়ে বাবার ওপরের উঠতে কষ্ট হলে সে আগেই ব্যাগটা নিয়ে ওপরের ঘরে রেখে আসত| মায়ের দাবি, আমাদের বাড়ির আরো নানারকম সাংসারিক কাজ করত নাকি ওই দুই ভাই বোন| তিন থেকে সাত বছর বয়সের মধ্যেই অনেক কিছু দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছিল তারা|তাদের নিজেদের মতো করে|তবে তা কতটা পড়া ফাঁকি দেবার জন্য আর কতটা অন্যরকম কাজকর্ম করার মজায় বলা মুশকিল|
সমস্যায় পড়লাম বোনটিকে নিয়ে| ভাই ভালোবাসলেও বোন কিছুতে ভালোবাসবে না আমায়| ভাল না বাসার যেন পণ করেছে সে মেয়ে| বিশ্বাস করুন, গায়ে হাতও লাগাইনি –দূরে দাঁড়িয়ে আছি, তাও আমায় দেখলেই কাঁদতে শুরু করবে| মুখ ভেঙচে নিরীহ হাসি দেবে| আমার প্রতি তার এই বীতরাগ চুপচাপ হজম করতাম| সেদিন আমারও খুব জেদ| ভালোবাসিয়েই ছাড়ব বাঁদরটাকে| একবার কেবল ভদ্রভাবে বললাম, আয় কোলে আয়| নাক কুঁচকালো|
রেডি ছিলাম ভেতরে ভেতরে| উল্টো করে কোলে তুলে নিলাম তাকে| মানে মুখটা তার রইল মেঝের দিকে| মুন্ডু আমার এক হাতে, পা দুটো অন্য হাতে| পাতালে ঢুকে যাচ্ছে ভেবে প্রথমটায় চুপচাপ আমার কাছে সমর্পণ করলো নিজেকে| মাটির সমান্তরালে আকাশে যেন উড়ল এক পাখি| আমার পুতুলপাখি|
বিছানায় এনে ফেললাম| নামতেই সম্বিৎ ফিরলো পাখির| চিল্লাতে লাগলো বেজায়| পুরুষ না মজলে শরীরমন জ্বলে না আজকাল| কিন্তু বাচ্চা ভালো না বাসলে খেপি| খুব খেপি| আজো খুব খেপে গিয়ে জানলায় রাখা মায়ের লাল টিপের পাতা থেকে টিপ খুলতে শুরু করলাম| খুলছি — ফের লাগাচ্ছি পাতায়| ভালোবাসার কুস্তি চলছে পাখির সাথে| জানলার শিকে লেগেছে গন্ধরাজ গাছের পাতা| অন্যমনস্ক হয়ে কখন জানি একটা টিপ তুলে লাগিয়ে দিয়েছি গাছের পাতায়|
দেখি কান্না থামছে মেয়ের| মন দিয়ে দেখছে আমার কাণ্ড। কী দেখিস পাখি মেয়ে ? এক উজবুক মাকে? বেশ বেশ আমি তাই| ? পটাপট কটা টিপ তুলে লাগিয়ে দিতে থাকলাম গন্ধগাছের কটা পাতায়| যতদূর জানলা দিয়ে হাত যায় আমার আর যতদুর দেখতে পায় আমার কোলের পাখি —ঠিক ততদূর| সবুজ সবুজ পাতায় ইয়া ইয়া টুকটুকে সব টিপ| ভাদ্রের রোদ তাতে চিকচিক| খানিক পরেই মেঘের ছায়া পড়ে সে লাল টিপ পানের খয়ের হয়!
অবাক মেয়ে! ফটাশ! কোলে চড়ে বসেছে পুতুল| হি হি হি! আরে! কোলের মধ্যে কাতাকুতু লাগছে যে তোর নরম নাকের ঘষায়| চুক চুক চুক| তিনটি সলিড চুমু| মাইরি! মাত্তর তিনটি চুমু| অখন্ড! ব্রহ্মান্ড!
★★শিশুর ভালোবাসার ক্ষমতা অসীম| দরকার সামান্য কিছু ভাবনা ও উপকরণ|★★
কী সুন্দর একটা মিষ্টি লেখা। কুচো লেখা। ঠিকই শিশুর মন সবুজ পাতা ।সবুজ পাতায় লাল টিপ – টিপের পাতা, পাতার টিপ। শিশুকে বুঝতে পারলেই কেল্লা ফতে। এই লেখায় শিশুর ভালোবাসার যে ছবি এঁকেছেন তা একথায় অনবদ্য ।