মেনিদা ঘড়াইবাবুর রোয়াকে বসে ওর পেল্লাই নাক খুঁটে খুঁটে টুস্কি মেরে রাস্তায় পোঁটা ফেলছিলো আকাশে একটা চীল উড়ছিলো। মেনিদা উর্ফ ভজ কার্তিক হাতি বসে বসে সেটা দেখছিলো না উড়ন্ত পীরিচ খুঁজছিলো বলা মুশকিল। তবে এই সময় ডেঙ্গুতে ভোগা ট্যালারাম অর্থাৎ আমি একটা হাঁটুফাটা তাতে আবার তালি লাগানো জিন্সের পাৎলুন পরে সেই ছোটবেলার মতো লাফাতে লাফাতে হাজির হলাম।
“মেনিদা ফার্স্ট হৈচি আমরা ফার্স্ট হৈচি” পেছনে পেছনে ভ্যাবলা দুহাতে দুটো মোমোর প্যাকেট নিয়ে হাজির।
“আরে ভেইয়া, ফার্স্ট ফির কাঁহাসে ভৈলবা?” ও পাটনাইয়া ছেলে এই বুড়ো বয়সেও মাঝে মাঝে হিন্দি বুকনি ঝাড়ে।
বাবুল অবশ্যই গন্ধে গন্ধে হাজির “ফাস্ট হৈসে হেইডাই ঐল কথা, কিসের লগে হেইডা জিগাইয়া কী কাম?”
মেনিদা জিজ্ঞেস করলো “ট্যালা তুই আবার তালিবান হলি কবে থেকে?”
বাবুল গিরি আঁৎকে হাঁউমাউ করে বললো “এহানে তালিবান ক্যামনে আইলো?”
মেনিদা মহা বিরক্ত হয়ে বললো “আরে তালি দেওয়া পেন্টুল পরেছে, তাই তালিবান বললাম। কচুপোড়া যতসব! ঢাকাই পরোটা কোথাকার এসে জুটেছে?”
“ফার্স্ট আবার কে হোলো?”
আমি সগর্বে উত্তর দিলাম “বাংলা”
বাবুল বললো “কিসে ইসে হৈসে?”
আমি একটা দিগ্বিজয়ী হাসি দিয়ে বললাম “একশো দিনের কাজে”
ভ্যাবলা লাফিয়ে উঠলো “আরে টাকাটা কে দিয়েছে? ঐ কেন্দ্রীয় সরকারই তো দিয়েছে। তাহলে ফার্স্ট সেকেন্ডের কথা আসে কোত্থেকে?”
ততক্ষণে আমাদের সব মোমো সাবাড়। আমাদের মানে মেনিদাই এক প্যাকেট আর আমরা বাকিরা মিলে বাকিটা সাবড়েছি। একটা নেড়ি কৌকৌ এসে ফেলে দেওয়া মোমোর প্যাকেটটাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছিলো।
বাবুল গিরির সদ্য ছানি অপারেশন হয়েছে। ও কালো চশমার ভেতর থেকে মিটমিটে ডানের মতো পিটপিট করে বললো “কথাডা তো সৈত্য। অন্যের ট্যাঁহায় ফুটানি”
মেনিদা যথারীতি মোমো শেষ করে আঙুল চাটছিলো। ওর খাঁড়ার মতো নাক দিয়ে মেনিদা একটা ভয়ঙ্কর শব্দ করলো “ঘ্রুঁৎ”
ওমনি ঐ তীব্র শব্দে নেড়িটা ল্যাজট্যাজ গুটিয়ে কান নিচু করে অনেকটা পালিয়ে তবে আবার ফিরে তাকালো।
ভ্যাবলা তেরিয়া হয়ে বললো “ঘ্রুঁৎ মানে কি? ঘ্রুঁৎ করলে ক্যানো?”
মেনিদা আবার বললো, বললো মানে মেনিদার নাক বললো “ঘ্রুঁৎ”
ভ্যাবলা বললো “এসব অপমানজনক শব্দ চলবে না”
আমি আর বাবুল একযোগে বললাম “চলছে না চলবে না”
মেনিদা যথাসম্ভব গুরুগম্ভীর গলায় বললো “দিনে কতো টাকা?”
আমার ঠিক জানাছিলো না। কালো চশমার ভেতরে বাবুলও মনে হয় চোখ উল্টে দিয়েছে। ভ্যাবলা চিরকাল ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে বড়ো বড়ো চাকরি করেছে।
মেনিদা ওকে বলে “একটা ফার্স্টক্লাস চাকর। বরং বাবুলটা ভালো। জুতোর দোকান দিয়েছে। স্বাধীন ছেলে”
আমি তো চিরকালের টেলুরাম। চাকরি মানে বেচুবাবু ছিলাম। দিশী স্নো ক্রিম লিপস্টিক – এসবের বেচারাম।
তাই ভ্যাবলা চটপট উত্তর দিয়ে দিলো “একশো বিরাশি টাকা ”
মেনিদা হাই পাওয়ারের বাইফোকালটা কপালে তুলে বললো “না আসলে তার থেকে কিছু কম। এরমধ্যে কাঁচামাল ইত্যাদি বাদ যায়, এবার বল বছরে ক’দিন কাজ পায়?”
ভ্যাবলা উত্তর দিলো “একশোদিন!একশো দিনের কাজ মানে একশোদিন! ই কোঈ বাৎ হুয়ি? একশো দিনের কাজ আবার কতো দিন করবে? যত্তসব বুর্বাক”
আগে হলে মেনিদার একটা রামগাঁট্টা ওর পাওনা ছিলো কিন্তু আপাততঃ নাতনিকে কোলে তুলতে গিয়ে মেনিদার কোমরে সাঙ্ঘাতিক রকমের টান লেগেছে। ডাক্তার বলেছে রেস্টে না থাকলে মেরুদন্ড কেটে দেবে। মেনিদা তাই অগ্নিবর্ষী দৃষ্টি হেনেই ক্ষান্ত দিলো। “কারা পাবে এই একশো দিনের কাজ?”
আমি ক্ষণিক ভেবে বললাম “নিশ্চয়ই যারা গরীব তারাই পাবে”
“হ্যাঁ বেকার গরীব গ্রামবাসীদের জন্য, তারাই নিশ্চয়ই পাবে” তারপর পরবর্তী প্রশ্ন করলো “তাহলে বছরে মোট কতো টাকা?”
আমরা হাঁ করে বললাম “কতো?”
“তা এই ধর বছরে সাতেরো হাজার টাকা এক একটা পরিবারের জন্য”
ছ্যাটকা ব্যাটকা কুকুরটা পর্যন্ত ঠোঙা চাটা বন্ধ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বাবুল একটা খাবি খেয়ে বললো “খাইসে বছরে মাত্তর সাতেরো হাজার? কারা পাইবো এই কামকাজ? বিপিএল কার্ড যাদের আছে ত্যাগোর লগেই তো হেইসব না?”
মেনিদার মুখচোখ হঠাৎ সিঙাড়ার মতো হয়ে গেলো। “না” কঠোর কন্ঠ মেনিদার “যে কোনও গ্রামবাসী”
“আমাদের দেশে বিপিএল কার্ড কতোজনের আছে?” ভ্যাবলার আকুল আকুতি।
“আমাদের দেশের ছাব্বিশ লক্ষ পরিবারের বিপিএল কার্ড আছে। আর রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বলেছে মোট জনসংখ্যার পঁচিশ দশমিক সাত শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে তার মানে প্রায় ছত্রিশ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। এছাড়া গৃহহীন মানুষের সংখ্যা প্রায় দশকোটি। এটা দুহাজার এগারোর আদমসুমারি অনুযায়ী। তাহলে মোটসংখ্যাটা দাঁড়ালো…”
জুতোর ব্যবসা করে বাবুলের মাথাটা অনেক পরিষ্কার হয়েছে। ও ফটাফট উত্তর দ্যায় ” ছিচল্লিশ কোটি”
আমি চামচিকের মতো মুখ করে বললাম “আমার মাথায় একটা প্রশ্ন গজগজ করছে”
মেনিদা ডাঁটসে উত্তর দিলো “করে ফ্যাল ট্যালারাম”
“তারমানে বিপিএল কার্ড ছাড়া অন্য কেউও কাজ পেতে পারে?”
দেওয়াল থেকে একটা মাকড়সা ওর জাল ধরে ঝুলছিলো। মেনিদা উদাস চোখে ওটার দিকে তাকিয়ে রইলো। যাকে বলে নিরীক্ষণ করতে লাগলো। অবশেষে বললো “এসব প্রশ্ন করতে নেইরে ট্যালা। এসব জিজ্ঞেস করা পাপ”
বাবুল ঢোঁক গিলে টিলে প্রশ্ন করলো “ও মেনিদা, কে একশো দিনের কাজ পাবে আর কে পাবে না সেটা কে ঠিক করবে?”
মেনিদা মন দিয়ে মাকড়সা দেখতে থাকে। তারপর মুখটা গাজরের হালুয়ার মতো করে উত্তর দিলো “রাজনৈতিক দল, মানে গ্রাম পঞ্চায়েত” আমাদের মিলিত হাঁ বোজার আগেই বললো “ট্যালা তোর ফাইন। ঐ কুলফিওয়ালা যাচ্ছে। কুইক কুইক এরপর গিয়ে রান্না করতে হবে”
ও বলা হয়নি। মেনিদার বৌ মানে আমাদের বৌদি একটা বড়সড় চাকরি করে। আর মেনিদা এখনও সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিচ্ছে। বোধহয় পঞ্চাশ বছর যাবৎ পরীক্ষা দিয়েই যাচ্ছে। আমি কাঁউমাউ করে উঠলাম “কেন? কিসের আবার ফাইন?”
মেনিদা একটা দার্শনিক হাসি দিয়ে বললো “বোকা বোকা খবর দেওয়ার জন্য। একশো দিনের কাজে এগিয়ে মানে বেকার গরীব লোকের সংখ্যা বেশী। স্বাধীনতার এ্যাতো বছর পরেও গরীব সবহারাদের ভিক্ষা নিয়ে পেট চালাতে হচ্ছে। এটাকে ফার্স্ট হওয়া বলে না বুঝলি রে গাধা!?”