…..রান্নার গ্যাস দরকার। কেরোসিনের ষ্টোভে আর কতদিন! গোটা কালিম্পং মহকুমায় একটাই গ্যাস ডিষ্ট্রিবিউটর, কালিম্পং শহরের ডেভিড গ্যাস। অনেক প্রতীক্ষার পরে ওরা জানাল যে হেল্থ সেন্টার থেকে লিখিয়ে আনলেই হবে, সঙ্গে সরকারী পোষ্টিং অর্ডার। তখন এইসব আধার-প্যানের চক্কর ছিল না।
বাসে করে চলে গেলাম কালিম্পং। ডেভিড গ্যাস খুঁজে কাগজপত্তর জমা দিয়ে ঘুরে নিলাম শহরটা। বিশেষ করে গ্রাহাম হোমস। অপূর্ব সুন্দর মিশনারী স্কুল। পিঠে ফেট্টি বেঁধে তাতে গ্যাসের সিলিন্ডার ঝুলিয়ে চড়াই-উৎরাই রাস্তা পেরিয়ে গাড়ি অবধি পৌঁছে দিল ওদের লোক। সত্যি, কি অমানুষিক পরিশ্রম করতে পারে এরা।
পাহাড়ের যুবকেরা খুব উচ্চাভিলাষী ছিল না তখন। ওদের লক্ষ্য ছিল, হয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া, অথবা মারুতি গাড়ির ড্রাইভার হওয়া। সরু, বিপজ্জনক পাহাড়ি রাস্তায় কি অবিশ্বাস্য দক্ষতায় যে গাড়ী চালাত ওরা! পাহাড়ের এইসব তুখোড় ড্রাইভারকে আবার দেখেছি শিলিগুড়ির রাস্তায় বোকার মত সিগন্যাল ভেঙে জরিমানা দিতে। পাহাড়ে এবং সমতলে গাড়ী চালানো দুটো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।
সেবার প্রশাসনিক প্রয়োজনে দার্জিলিং যেতে হয়েছে। কি মনে হল মংপু হয়ে যাই। রাস্তা তখন একটু ভালো। আর এই রাস্তায় সময় লাগে কম । ভালুকখোপের সেই বিপজ্জনক বাঁকগুলো পার হলাম বেশ ভয়ে ভয়ে। গৌতমদার সাথে দেখা হল। সুপ্রিয়-র কথা বলল। সুপ্রিয়কে দেখেছিলাম জয়েন করার সময়। মিষ্টভাষী সুদর্শন তরুণ। সবে পাশ করে এসেছে সার্ভিসে। দার্জিলিং জেলের মেডিক্যাল অফিসার। বেশী বেশী করে হরলিকস লিখে দিতে হবে এই অদ্ভুত আবদার না মানার ফলে ওর উপর চড়াও হয়ে নিগ্রহ করে কিছু বন্দী। কোথাও কোনো বিচার পায় নি সে। কর্তৃপক্ষ চোখ বন্ধ করে ছিল।
দার্জিলিংয়ের সিএমওএইচ অফিসে কাজ সেরে কেভেন্টার্সে আশ মিটিয়ে খেয়ে বাসে উঠে পড়লাম। কার্শিয়াং হয়ে শিলিগুড়ি। সহজ, চেনা পরিচিত রাস্তা। কিন্তু বিধি ছিল বাম। কার্শিয়াংয়ে পৌঁছে ড্রাইভার বলল আর যাবে না। ড্রাইভাররা ষ্ট্রাইক করেছে। তখন প্রায় পাঁচটা বাজে। আর কোনো গাড়ী যাবে না শিলিগুড়ির দিকে। হিলকার্ট রোড বন্ধ।
অনেক সাধ্যসাধনার পরে একটা লড়ঝরে মাহীন্দ্রা গাড়ী পাওয়া গেল। কয়েকজন মজুরকে নিয়ে পাঙ্খাবাড়ী রোড ধরে প্রায় লুকিয়ে শিলিগুড়ির দিকে যাচ্ছে।
স্পার্ক প্লাগে কি সমস্যা হয়েছিল। দুটো খোলা তার মুখোমুখি ছুঁইয়ে গাড়ী স্টার্ট করল। কখন আবার স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায় কে জানে!
সবুজ জঙ্গলের ভিতর দিয়ে রাস্তা। খাড়া উৎরাই। হেয়ার-পিন বাঁক। অন্ধকার হয়ে এল। রাস্তায় আলো নেই। হেডলাইট সমস্যা করছে। যখন তখন নিজের মত জ্বলছে-নিভছে। চাঁদনী রাত। জ্যোৎস্নার ভরসায় নেমে চলেছি। জানি না পৌঁছব কি না। একটা হরিণ দৌড়ে গেল সামনে দিয়ে।
গাড়িধুরা পৌঁছে ধড়ে প্রাণ এল। সমতল। শিলিগুড়ির আলো দেখা যাচ্ছে।
পরের দিন অনিল বলল,
‘রাতে পাঙ্খাবাড়ি রোড দিয়ে আসবেন না।’
‘হুঁ, বেশ বিপজ্জনক।’
‘ শুধু তাই নয়। ডাকাতি হয়। হাতিও বেরোতে পারে।’
‘ বাপরে! তাই নাকি?’
অনিল বেশ ঝরঝরে বাংলা বলে। কোনো অবাঙালী টান নেই। অথচ ওরা মাড়োয়ারী। ওদের পরিবার পাহাড়ে আছে দেড়শ’ বছর। দার্জিলিং কমলালেবুর পাইকারী বাজার লোহাপুলে। পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে অনিলের পরিবার । ও দুপুরে মাঝ মাঝে রাম্ভীর হোটেলে খেতে আসে। দেখা হয়। সীজন শুরু হতেই বাড়ির জন্য দিয়ে দিল প্রায় এক ক্রেট লেবু।
একদিন আউটডোরে বসে আছি। বেশ ফাঁকা-ফাঁকা। এক নেপালী মহিলা এল। হাতে এক বড় ব্যাগ। প্রত্যেক টেবিলে এসে দিয়ে যেতে লাগল কমলালেবু। ডাক্তার, নার্স, গ্রুপ ডি ষ্টাফ- সবাইকে। টারজং বস্তীতে ওদের কমলালেবুর বাগান আছে। রাম্ভী-তে ওর মেয়ের ডেলিভারী হয়েছিল দু-মাস আগে। তাই এত খুশী।
রোদ পড়ে আসা বিকেলে জঙ্গলে হাঁটছি। পায়ের সামনে দিয়ে খচমচ করে চলে গেল কাঠবেড়ালী। মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল এক ঝাঁক টিয়া। টারজং বস্তীর দিকটা কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে। দূরে শিরীষ গাছটার উপরে কেউ যেন চড়ে বসে আছে মনে হচ্ছে। কাছে যেতেই নেমে এল লোকটা। রিয়াং পুলিশ ফাঁড়ির মুখার্জীদা।
‘আরে, গাছে উঠে কি করছিলেন?’
‘পাখী ধরছিলাম।’
‘অ্যাঁ? কি পাখী?’
‘ময়না।’
পুলিশফাঁড়ির বারান্দায় নতুন খাঁচায় ময়নার অধিষ্ঠান হল। মুখার্জীদা আরেকটা কাজ খুঁজে পেল। অবশ্য কাজের তার অভাব খুব একটা হয় না।
সেবার পুরোনো ভাঙা ব্রীজটার কাছে খয়ের গাছটায় বিরাট এক মৌচাক হয়েছে। মুখার্জীদা স্থানীয় ছেলেপুলে জুটিয়ে ধোঁয়া দিয়ে মৌমাছি তাড়ালো। তারপর চাক ভেঙে মধু বের করল। সবাইকে দিয়েছিল এক শিশি করে। আমাকেও।
একদিন রাতে ডিনার করে জয়ন্তদা, মুখার্জীদা আর আমি রাস্তায় হাঁটছি। আমি বললাম,
‘দার্জিলিং-এর পাহাড়ে অপার শান্তি বিরাজ করছে মনে হচ্ছে!’
‘কে বলল?’
‘পুলিশ চোর না ধরে পাখী ধরছে, মৌচাক ভাঙছে- তাই ভাবলাম আর কি!’
জয়ন্ত-দা হেসে উঠল।
আকাশ পরিস্কার থাকলে রাতে পুব দিকে নজর করলে দার্জিলিং পাহাড়ের আলো দেখা যায়। আজকে সেদিকে আলোয় আলো।
‘এত আলো কিসের?’
‘দেওয়ালি হচ্ছে।’ মুখার্জীদা বলল।
‘দেওয়ালি তো অনেকদিন হয়ে গেছে!’
জয়ন্তদা বলল,
‘আরে মশাই আপনিও যেমন! ওটা আগুনের আলো। পাহাড়ে আগুন লেগেছে।’
‘দাবানল?’
‘হ্যাঁ’
আগুন শুধু পাহাড়েই নয়। আমার কোয়ার্টারেও লেগেছিল। হাসপাতালের ট্রান্সফরমারটা ছিল আমার কোয়ার্টারের ঠিক পাশে। শীত পড়েছে। একদিন সন্ধ্যায় বেশ কিছুক্ষণ ব্যাডমিন্টন খেলে ক্লান্ত হয়ে ঘরে বসে আছি। হোটেলে খেতে যাব। এমন সময় বাইরে হইচই। আমার নাম ধরে চিৎকার। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি কোয়ার্টারের পেছনের দিকটা জ্বলছে। ট্রান্সফরমার থেকে আগুন লেগেছে। ছেলেপুলেরা ঝোরা থেকে জল এনে আগুন নেভাতে লাগল। আমি দৌড়ে ঘরে গিয়ে সার্টিফিকেট, কাগজপত্র, জামাকাপড় যা পারলাম বের করে আনলাম। ঘরের বেশ কিছু জিনিস পুড়ে গেল।
সবাই চলে গেছে। বারান্দায় একা বসে আছি। অরুণ এসে বলল,
‘আগুন নিভে গেছে স্যার।’
‘হ্যাঁ, ঠিক সময়ে তোমরা নিভিয়েছ।’
‘কিন্তু আপনি রাতে থাকবেন কোথায়?’
‘এই বারান্দায় থেকে যাব। কোন অসুবিধা নেই।’
‘না না। চলুন আমার কোয়ার্টারে।’
কোনো ওজর-আপত্তি শুনল না অরুণ। টেনে নিয়ে গেল ওর কোয়ার্টারে। খাবার এনে দিল হোটেল থেকে। একমাত্র ঘরটা আমাকে ছেড়ে দিয়ে ওই শীতের রাতে বাচ্চা নিয়ে নিজেরা শুয়ে রইল বারান্দায়।
আর কেউ খোঁজ নিতে এল না। এমনকি দু-ঘন্টা আগে যার সাথে ব্যাডমিন্টন খেললাম, সে-ও না।
( ক্রমশঃ)