সুদাম চৌধুরি ব্যাধ নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না! কলকাতার থেকে বাবুরা এসছেন তাকে বায়না করতে, তাকে বলা ভুল হলো, তাদের। তাদের মানে পুরো দলটাই, লক্ষ্মণ বিট্টার, শ্যামসুন্দর চৌধুরী ব্যাধ আর প্রবীর চৌধুরী ব্যাধ-সহ। প্রবীরেরই একমাত্র বয়েস কুড়ির কোঠায়, বাকিদের চল্লিশ পার, সুদামের তো দুবছর পরে পঞ্চাশ হয়ে যাবে!
এই দেখুন, মাঝখান থেকে বললে আপনারা আর কি করে বুঝবেন! ব্যাধ শুনেই নিশ্চয়ই ভাবছেন কপালে ফেট্টি, হাতে বাঁশের তির ধনুক নিয়ে পাখিশিকারীর দল? আরে না না, এরা তত হিংস্র পেশায় নেই, সে ছিলো ওদের ঠাকুর্দার ঠাকুর্দারা আশি একশো বছর আগে! তারপর শিকার বেআইনি হলো, ওদের বনে ঢোকা নিষিদ্ধ হলো ওরা ছিটকে গেলো নানান পেশায়। কিভাবে যেন কোন এক পূর্বপুরুষ এক নর্তকীর কাছে প্রসাধন অভিনয় শেখেন, তারপর থেকে তাদের পেশার শুরু। নামে ব্যাধ আর চৌধুরি থাকলেও, না ওরা উঁচু জাত, না শিকারী, ওরা অন্ত্যজ উপজাতি , যাদের আমরা চিনি বহুরূপী বলে।
বহুরূপী একটা অদ্ভুত পেশা। এমনি দিনে গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় শিব দুর্গা কালী সেজে ঘোরা অথবা পরব এলে তিনজন চারজন মিলে মনসা বা কালীর পালা করা, এই এদের কাজ। তাতে কখনো চাল আনাজ জোটে, কখনো বা টাকাপয়সা, তবে বহুরূপীরা বহু রুপি পায় না কখনো, জীবন এদের বড় কষ্টে কাটে। সুদাম, প্রবীররা থাকে বোলপুর থেকে প্রায় মাইল কুড়ি দূরে, গ্রামের নাম বিষয়পুর। সেখানেই এককোণে ওদের বাস, নিচু জাত বলে প্রায় কোনো ঘরেরই ভেতর অবধি ওদের যাতায়াত নেই, ছোঁয়াছুঁয়ি না থাকলেও, এই ব্যাপারটা এখনো গাঁয়ে আছে, ২০২৪ ছুঁয়েও ধ্যানধারণায় বিশেষ প্রভাব ফেলেনি লোকের মনে। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ওরা যখন শিব দুর্গা কালী সাজে, সেই লোকেরাই ওদের প্রণাম করে, আশীর্বাদ চায়। শুধু একটু মেক-আপেই যেন আমূল বদলে যায় পুরো মানুষটা।
কোথায় যেন ছিলাম? বয়েস কালের এই দোষ, গুলিয়ে ফেলি, ও হ্যাঁ, সুদামের কথা।
তা সুদাম গেছিলো সোনাঝুরির হাটে, ওর দলের সাথে বেহুলা লখিন্দরের বহুরূপী অ্যাক্টো নিয়ে । সেখানেই বাবুদের সাথে দেখা, সামনের মাসেই ‘মূলের কাছে ফেরা’ অনুষ্ঠান নাকি তাঁদের, তাতে ওরা কলকাতায় বীরভূমের সংস্কৃতিকে নিয়ে আসতে চান। ওদের পুরো দলকেই নিয়ে যাবেন, ট্রেনের রিজার্ভেশন, ওখানে থাকা খাওয়া সব ওঁদের দায়িত্ব।
অনুষ্ঠানের ক’দিন আগেই যেতে হবে, কারণ গানের সাথে মহড়া চলবে, বাবুরা যাকে ‘কোরিওগ্রাফি’ বলেন। এতে হ্যাঁ বলা ছাড়া অন্য কিছু ভাবেওনি সুদাম, লক্ষ্মণ, প্রবীর আর শ্যামসুন্দর।
ওফফফফ, সে কি অসম্ভব ঝকমকে অনুষ্ঠান! শীততাপনিয়ন্ত্রিত হল, বিখ্যাত গায়ক ও গায়িকারা বাংলার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তের গান তুলে ধরছেন এক এক করে.. ভাটিয়ালি, বাউল, কীর্তন.. কত না রকমে , কত না গলায়! পেছনের পর্দায় বাংলার পল্লী ভেসে উঠছে! মঞ্চে এবার ঘোষক বলে উঠলেন ‘ কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন মিস করছেন? আসুন আপনাদের সোনাঝুরির হাটে নিয়ে যাবো। আজকের সেরা আকর্ষণ, সোজা বোলপুর থেকে, স্রেফ আপনাদের জন্য.. বহুউউউরূপীইইই’ পেছনে মঙ্গলকাব্যের গান বিখ্যাত গায়কের কণ্ঠে, সামনে সুদামদের বেহুলা লখিন্দর অ্যাক্টো, জীবনে এই প্রথম স্টেজের ওপরে শ্যামসুন্দর মনসা সেজেছে, প্রবীর মৃত লখিন্দর, সুদাম শিব হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে, লক্ষ্মণের বেহুলা হয়ে স্বর্গভোলানো নাচ। অ্যাক্টোর শেষে সারা হল দাঁড়িয়ে সে কি হাততালি!
প্রচণ্ড সফল অনুষ্ঠানের শেষে যেমন নিয়ম, তেমনি সুবেশ ঘোষক স্টেজে এসে পরিচয় করাতে থাকলেন সবাইকে দর্শকের সাথে। প্রথমে গায়ক গায়িকা আবৃত্তিকার, তারপর একে একে যন্ত্রীদের সঙ্গে, তারপর লাইট, সাউন্ড, স্পনসর…পর্দা পড়ার পরে প্রবীর ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো সুদামকে, ‘ আমাদের নাম বললো না কেন গো জ্যেঠু?’
সুদাম হি হি করে হেসে বললো, ধুর বোকা! আমরা তো শুধু মেক-আপ রে! লাগালে লোকে অন্যরকম ভাবে।