অত্যন্ত চিন্তার এবং বিচলিত করবার মতো একটা ঘটনা দেখে কিছু লিখবার তাগিদ অনুভব করছি। একটি দু:খজনক ঘটনা ঘটেছে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। একজন তরুণ ক্যান্সার রোগে মারা গিয়েছেন। কি ক্যান্সার? কি চিকিৎসা চলেছে আমি জানি না। মৃত্যুর পর মৃতের মা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে শারীরিক ভাবে হেনস্থা করেছেন। এই পর্যন্ত ঘটনাটি মোটামুটি সাধারণ। হ্যাঁ চিকিৎসক হেনস্থার ঘটনাটিও। আমার পরিচিত এক মা যিনি অত্যন্ত ঈশ্বরভক্ত ছিলেন সন্তানের অকাল মৃত্যুর পর দেবতার মূর্তি ও আসন ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। তাই পুত্রশোকে কাতর মায়ের চিকিতসক হেনস্থাকেও স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া বলে ধরে নেওয়া যায়।
কিন্তু তারপর সংবাদ মাধ্যমে চিকিৎসককে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সত্যি-মিথ্যা বিচার না করে যে ভাবে তাঁর সম্মানহানি করা হচ্ছে তাতে ক্যান্সার চিকিৎসক হিসেবে শিউরে উঠছি। ক্যান্সার চিকিৎসায় অনিশ্চয়তা সম্পর্কে সবাই অবগত। সাফল্য কখনোই ১০০ শতাংশ নয়। মৃত্যু দুর্ভাগ্যজনক এবং অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও তা ক্যান্সার চিকিৎসার সঙ্গী। চিকিৎসায় (যে কোনও অসুখের) সাফল্য নির্ভর করে চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর, ডাক্তার সেই ব্যবস্থার একটা অংশ মাত্র। সঠিক সময়ে চিকিৎসা হওয়া, ইমার্জেন্সি সময়ে মেডিকেল হেল্প কাছাকাছির মধ্যে পাওয়া, সেবা প্রদানকারী আরো অনেক মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা একজন রোগীকে সুস্থ করতে সাহায্য করে।
সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক আমার পরিচিত। মুম্বাইয়ের বিখ্যাত টাটা মেমোরিয়াল হসপিটাল থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ ডিগ্রি ডি এম পাশ করা। উনি স্বেচ্ছায় একদম একা মেডিক্যাল কলেজে একটা ক্যান্সার বিভাগ চালান। মানুষ হিসেবে অত্যন্ত ভালোমানুষ বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। উনি মেডিকেল অঙ্কোলজি বিভাগ একা চালান। এইটে অসম্ভব যে ওনার চিকিৎসার গাফিলতি কোন মৃত্যুর কারণ। অভিযোগ উনি রোগী র পরিজনকে আশা দিয়েছিলেন রোগী ভালো হয়ে যাবেন। কিন্তু তা হয়নি।
হায়রে মিডিয়া আর বাংলার মানুষ, যাঁরা আগাপাশতলা না জেনে চিকিৎসকের মুন্ডুপাত করছেন। ক্যান্সার ক্যানো? যেকোনো চিকিৎসার সাফল্য নির্ভর করে রোগী ও তার পরিজনের মনোবলের উপর। যেখানে ক্যান্সার মানেই মৃত্যু বলে দেগে দেওয়া হয় সেখানে ক্যান্সার চিকিৎসকদের লড়াই টা শুরুই হয় আশায় ভরসা করে, পজিটিভ বাতাবরণ তৈরি করে রোগীর মনোবল বাড়িয়ে এক কঠিন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে। এই আশাটুকু না দিতে পারলে সমস্ত জেতা যুদ্ধ আমরা হেরে যাবো যে। মনে বিশ্বাস যদি না থাকে রোগটাকে জয় করা যায়, কাউকে আমরা সুস্থ করতে পারব কি?
সকাল থেকে এই সংবাদের ওপর খাপ পঞ্চায়েত বসেছে। মানুষ উগরে দিচ্ছেন ঘৃণা। সংবাদপত্র বিন্দুমাত্র অনুসন্ধান না করে ছেপে দিচ্ছে চিকিৎসকের নাম। দেগে দিচ্ছে তাঁকে অপরাধী হিসাবে।
এরপর ওই চিকিৎসক সরকারি হাসপাতাল ত্যাগ করলে তাঁকে অর্থপিশাচ বলে দেগে দেওয়া হবে। ক্ষতি কার হবে যানেন? এই এত বছরে যে হাজার হাজার ক্যান্সার রোগী মেডিকেল কলেজে ওনার তত্বাবধানে সুস্থ হয়ে উঠেছেন তাঁদের মত আরো হাজার হাজার রোগীর। মিডিয়া পাবে টিআরপি আর সাধারণ মানুষের হাতে থাকবে পেন্সিল।
চলুক গালাগালির ধারা, পারলে সমস্ত চিকিৎসকদের পিটিয়ে মেরে ফেলুন, তাতেই যদি আপনাদের বিশ্বাস শুধরে যাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা।